skip to Main Content

আলাপন I ‘বাংলাদেশে অর্গানিক চায়ের কোনো প্রতিযোগী এখনো তৈরি হয়নি’ — সৈয়দ শোয়েব আহমেদ

দার্জিলিং থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে তেঁতুলিয়ায় গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী এক চা-বাগান। এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে শতভাগ ভেষজ চা— দেশে ও বিদেশে। কেমন করে পানীয়টির বাজার গড়ে উঠল? উৎপাদনের রহস্যই-বা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হয়েছেন কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

ক্যানভাস: কাজী অ্যান্ড কাজী টি প্রতিষ্ঠার গল্প শুনতে চাই।
শোয়েব আহমেদ: কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. দার্জিলিংয়ের মাত্র ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ায় অবস্থিত। শুরুতে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের জমিগুলো ছিল পতিত, অনুর্বর এবং বালুময়। ২০০০ সালের দিকে জেমকন গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শাহেদ আহমেদ কাজী অ্যান্ড কাজী এস্টেট লি. প্রতিষ্ঠা এবং এই অঞ্চলে প্রথম চা চাষের গোড়াপত্তন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে অর্গানিক পদ্ধতিতে চা উৎপাদন করা এবং পিছিয়ে পড়া স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। নিজস্ব চা-বাগানে উৎপাদিত রাসায়নিক কীটনাশকমুক্ত ভেষজ ও ঔষধি পাতার মিশ্রণে তৈরি বায়োপেস্টিসাইড এবং জৈব সার ব্যবহার করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ও আন্তর্জাতিকভাবে E.U, NOP/USDA, JAS, KOSHER, Rainforest Alliance, FairTrade, HACCP দ্বারা সনদপ্রাপ্ত কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ১০০% অর্গানিক চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান; যা বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বে (USA, UK, Germany, Japan & France) এ Single Estate Traceable Organic পরিচিতি লাভ করেছে।
ক্যানভাস: চা-শিল্পে গত দুই দশকে কী পরিবর্তন দেখেছেন?
শোয়েব আহমেদ: গত দুই দশকে চা-শিল্পে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। চা-শিল্প বাংলাদেশের ১৫০ বছরের বেশি পুরোনো কৃষিভিত্তিক এবং রপ্তানিমুখী একটি উল্লেখযোগ্য ও সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্প ১৮৫৪ সালে সিলেট জেলার মালনীছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়ে বর্তমানে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি জেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাসহ পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই অঞ্চলের চা-বাগানগুলো বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চা উৎপাদনকারী দেশ। বাণিজ্যিক চা-বাগানগুলোর মধ্যে কাজী অ্যান্ড কাজী টি উন্নত মানের চা উৎপাদনে বর্তমানে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত দুই দশকে চায়ের ভিন্ন স্বাদের ভোক্তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্যসচেতন, তাদের কাছে গ্রিন ও হারবাল চা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ক্যানভাস: বাজারে অনেক ব্র্যান্ড আছে। এগুলোর মধ্যে আপনাদের পণ্যের স্বাতন্ত্র্য কোথায়? প্রতিযোগিতাটি কীভাবে চলছে?
শোয়েব আহমেদ: বাজারে অনেক ব্র্যান্ড আছে। এগুলোর মধ্যে আমাদের স্বাতন্ত্র্য হলো, আমরা ১০০% অর্গানিক চা উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাজারজাতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি.-এর রয়েছে নিজস্ব ফ্যাক্টরি এবং এই ফ্যাক্টরিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল চা যেমন White Tea, Earl Gray Tea, Orthodox Tea, Oolong Tea, Bai Mu Dan Tea, Massala Teaসহ আরও উল্লেখযোগ্য হারবাল চা; যেমন , Jasmine Tea, Green Mint Tea, Ginger Tea, Tulshi Tea, Steavia Tea, Turmaric Tea, Maringa Tea, Bashaka Tea, Lemongrass Tea, Neem Nectar Tea ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। উল্লেখ্য, এর জন্য আমরা গত Tea Expo-২০১৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ‘Tea Product Diversification’ category তে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করি। আমাদেরই রয়েছে দেশের একমাত্র সুসজ্জিত মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ল্যাব, যেখানে চায়ের গুণগত মান সুনিশ্চিত করতে স্যালমোনেলা, ইকোলাই, কলিফর্ম, ইস্ট, মল ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। এতে করে চায়ের সর্বোচ্চ গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিযোগিতা যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশে অর্গানিক টি-এর কোনো প্রতিযোগী এখনো তৈরি হয়নি।
ক্যানভাস: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টি গার্ডেনগুলো ট্যুরিজমে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে কি এর বিকাশ ঘটেছে?
শোয়েব আহমেদ: বাংলাদেশেও টি ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটেছে; বিশেষ করে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বর্তমান সময়ে ট্যুরিস্টদের সমাগম হয়। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে কাজী অ্যান্ড কাজী টি-এর অর্গানিক ও সমতল ভূমিতে চা-বাগান দেখার জন্যও ট্যুরিস্টদের দিন দিন সমাগম বাড়ছে।
ক্যানভাস: দেশে উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
শোয়েব আহমেদ: প্রধানত দেশে চায়ের উৎপাদন যে হারে বেড়েছে, সেই হারের তুলনায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় চা রপ্তানি তুলনামূলক হারে কমে গেছে বা বৃদ্ধি পায়নি।
ক্যানভাস: রপ্তানি বাড়ানোর উপায় কী?
শোয়েব আহমেদ: বিশ্বব্যাপী চায়ের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ৯৬ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। সে ক্ষেত্রে চা রপ্তানিতে সরকারের বিশেষ সহযোগিতা যেমন: রপ্তানি শুল্ক হ্রাস, অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের মতো চা রপ্তানিতেও প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন বিশেষায়িত চা উৎপাদনের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ক্যানভাস: শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আপনারা কিছু ভেবেছেন কি?
শোয়েব আহমেদ: কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. শুরু থেকেই শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন বাগানেরই আশপাশের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. শ্রমিকদের বিনা মূল্যে বাসস্থান, খাওয়ার বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটারি ল্যাট্রিনসহ নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম ও কম্পিউটার চালানোর ওপর বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেডে বর্তমানে এক হাজারের বেশি পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক কর্মরত; যা এই এলাকায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ক্ষমতায়নে এবং বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সমবায় পদ্ধতিতে ডেইরি থেকে গরু প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনেও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে একমাত্র আমরাই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফেয়ার ট্রেড সনদপ্রাপ্ত।
ক্যানভাস: ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন?
শোয়েব আহমেদ: কাজী অ্যান্ড কাজী টি বাংলাদেশের অর্গানিক চা উৎপাদনকারী একমাত্র ব্র্যান্ড। আমাদের ব্র্যান্ডের জায়গা থেকে আমরা গ্রাহকের কাছে অর্গানিকভাবে উৎপাদিত চা বাগান থেকে সরাসরি সেরা মান বজায় রেখে পৌঁছে দিই। ‘A Cup of Goodness’ ‘100% Organic’ চা এবং বাগানের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা, চায়ের চুমুকে ভোক্তার কাছে ব্র্যান্ডের জায়গা থেকে পৌঁছে দিতে আমাদের সব আয়োজন। চা-বাগানের অর্গানিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সেরা মানের চা উৎপাদন এবং এরই সঙ্গে বিপণনের জন্য আকর্ষণীয় প্যাকেট ডিজাইন করা, ভিডিও বার্তাসহ নানা ধরনের যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে আসছি।
ক্যানভাস: শোনা যায়, কোম্পানিগুলো উন্নত মানের চা রপ্তানি করে। দেশীয় ভোক্তাদের ভাগ্যে সেই মানের চা জোটে না। সত্যি কি তাই?
শোয়েব আহমেদ: কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. ইতিমধ্যে একাধিক আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্ত, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো ব্র্যান্ডের নেই। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের দর্শন হলো: স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য ‘প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশকে সমর্থন করে উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদন ও বাজারজাত করা। আমাদের চা অন্য কোনো বাগানের চায়ের সঙ্গে মিশ্রণ না করায় এর স্বাদ ও মান উভয়ই থাকে অনন্য এবং এটি একক বাগানের চা হিসেবেও পরিচিত। তাই আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের উৎপাদিত ও দেশীয় বাজারে বিপণন করা চায়ের মান আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা চায়ের মানসম্পন্ন।
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top