skip to Main Content

ফিচার I মানারকলি থেকে মেনজ স্যুট

বিয়ের ট্র্যাডিশনাল আউটফিটই নতুন করে ফিরে আসছে। অলংকরণে এমনকি বোতামেও থাকছে নান্দনিকতার স্পর্শ। ডিজাইনে দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্য। লিখেছেন সারাহ্ দীনা

বিয়ের এই মৌসুমে বরের পোশাক নজর কাড়বে। নিশ্চয়ই। কেননা, অতিমারিজনিত সামাজিক দূরত্বের কাল প্রায় ফুরিয়েছে কিংবা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সময়। এ যেন নতুন করে উৎসবের দিকে ফেরা। এর প্রভাব বরের পোশাকেও লক্ষণীয় হবে বলে অনেকের ধারণা।
আমাদের দেশে বরের চিয়ারত পোশাক হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে শেরওয়ানি। স্যুট, প্রিন্স কোট, কুর্তা-পাজামা, চিপকান, আংরাখা— এসবের সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছে মানারকলি। দারুণ ভিন্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে নান্দনিক এই পোশাক। এথনিক এই পোশাক সবার নজর কেড়েছিল দীপিকা-রণবীরের বিয়েতে। রণবীরের পোশাকের নাম মানারকলি। নেট দুনিয়ায় নজরকাড়া এই ড্রেসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
নান্দনিক নকশার মানারকলি মূলত জনপ্রিয় আনারকলি থেকে অনুপ্রাণিত। অভিজাত পোশাক লাইনে এর অবস্থান। ফ্রক স্টাইলে তৈরি এই কুর্তা মূলত উপমহাদেশের নারীদের পোশাক হিসেবে বর্তমানে বিবেচিত। তবে এর শুরু পুরুষের পোশাক হিসেবে। মোগল সম্রাটদের পরিধেয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এ পোশাক। এটি পরতেন সম্রাট আকবর এবং শাহজাহান।
বলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র মোগল-ই-আজমে আনারকলি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন মধুবালা। এখান থেকেই পোশাকটির পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা সব সময়েই ইন-ফ্যাশন। কত্থক এবং কথাকলি নৃত্যের শিল্পীদের কস্টিউম হিসেবেও স্থান পায় আনারকলি।
রুপালি পর্দা, নৃত্য মঞ্চের বাইরেও আমরা এটি দেখতে পাই। উৎসবের পোশাক হিসেবে এর রয়েছে ব্যাপক সমাদর। বিয়েতে আনারকলি এখন বেশ প্রচলিত।
এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে মানারকলি। ফ্যাশন ফোকরা মেনস লাইনে এই ডিজাইন নিয়ে আসার জন্য নাম দিয়েছে মানারকলি।
মানারকলি উজ্জ্বল এবং সাটল কালার দুটোতেই ভালো দেখায়। আবার, এক রঙা হবে, এমন নয়। প্রিন্ট জমকালো লুক নিয়ে আসবে মানারকলিতে। ফ্লোরাল, কলকি প্রিন্টে আসবে নান্দনিকতা। ম্যাচিংয়ের জন্য নেহরু জ্যাকেট, লং কটি বেছে নিতে হবে।
এবারের সিজনেও বরের পোশাক হিসেবে শেরওয়ানির চাহিদা ব্যাপক। একই ধাঁচের কাটে তৈরি আচকানের কদরও রয়েছে। এই দুয়ের মধ্যে মূল ভিন্নতা দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে। আচকানের থেকে শেরওয়ানিতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেশি হয়ে থাকে। বরের জন্য রেডিমেড অথবা মাপমতো বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রাধান্য দিতে হবে সঠিক মাপকে। আগের মতো বডি ফিটিং পোশাকের চাহিদা নেই বললেই চলে। কারণ, বিয়ের আসরে বরের আরামই আসল কথা। উৎসবের এই পোশাকের দৈর্ঘ্য বরের উচ্চতার সঙ্গে যেন সঠিকভাবে মানিয়ে যায়, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। আর প্রস্থ নির্ভর করে পোশাক দেহের সঙ্গে ঠিক কতটুকু ফিট হবে, তার ওপর।
একটু ভারী বুননের ফ্যাব্রিক যেমন রেশমি, ব্রকেড, ভেলভেট, বেনারসি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলোর সোনালি, লাল, মাখন, দুধ সাদা, নেভি ব্লুর পাশাপাশি উজ্জ্বল রং বেশ মানানসই। এর বাইরে প্যাস্টেল শেডও থাকতে পারে।
শেরওয়ানির গঠনগত নকশায় পকেট থাকে, আচকানে থাকে না। একই ধাঁচের কাটে তৈরি আচকানের চাহিদা রয়েছে।

আহমেদ তুহিন রেজা

এবারের বিয়ের পোশাকে বরের চাহিদার বিষয়ে ডিজাইনার ব্র্যান্ড হাউস অব আহমেদের স্বত্বাধিকারী আহমেদ তুহিন রেজা বলেন, ‘আমাদের দেশে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শুরু থেকেই বরের পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইদানীং অনেক বিয়েতেই আনুষ্ঠানিক কাবিনের আয়োজন হচ্ছে আলাদা করে, সেখানে দেখা যাচ্ছে পাঞ্জাবি ও পাজামার সঙ্গে কটির ব্যবহার। এখানে কালারের ক্ষেত্রে কনের পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে বরের পোশাক নির্বাচন করা হচ্ছে। এরপরে আসে হলুদ এবং মেহেদি আয়োজন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পাঞ্জাবির সঙ্গে লেয়ার করে বান্ধগলা অর্থাৎ বন্ধ নেক লাইনের কটি অথবা জ্যাকেটের উপস্থিতি। আনুষঙ্গিকে হাতে বাঁধা পাগড়ি এখন রয়েছে ফেভারিটের তালিকায়। এর সঙ্গে অনেকে যোগ করছেন স্টোল। আভিজাত্য এবং নান্দনিকতার মিশেলে বর এখন নিজেকে তৈরি করতে চান বিশেষ দিনের জন্য। রঙের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে স্বকীয়তা। অনেকেই পাগড়িতে বেছে নিচ্ছেন কনের পোশাকের রং। পকেট স্কয়ারের ক্ষেত্রেও তাই। অলংকরণে থ্রেড এমব্রয়ডারি এবং জারদৌসির চাহিদা বেশ। বিশেষ করে প্রিন্স কোটে কলারের অংশে জারদৌসি সমাদৃত। এই কোটের বাইরে স্যুটও রয়েছে ক্রেতার পছন্দের তালিকায়।’
অলংকরণে জারদৌসি এবারও থাকছে। হাতের জমকালো কাজ যদি স্থান করে নেয় শেরওয়ানিতে, তবে তার নান্দনিকতার জুড়ি মেলা ভার। এর বাইরে সেলফ ওয়ার্ক প্রিন্টের কাপড়ে তৈরি শেরওয়ানির চাহিদাও থাকছে। এ ক্ষেত্রে জ্যামিতিক মোটিফের প্রিন্টের কদর আছে বলে ডিজাইনার ব্র্যান্ড জুরহেমের স্বত্বাধিকারী মেহরুজ মুনির জানান, ‘পাঞ্জাবির সঙ্গে বটমের ক্ষেত্রে পাজামা, চুড়িদারের লেন্থ এবার কিছুটা বাড়বে। একই সঙ্গে সাদা রঙের পাজামার চিরায়ত ধারাতে আসবে পরিবর্তন। পাঞ্জাবির সঙ্গে রং মিলিয়ে পাজামা দেখা যাবে।’

মেহরুজ মুনির

রিসেপশনে বরের পরনে অধিকাংশ সময় দেখা যায় দুটি পোশাকের যেকোনো একটি। স্যুট অথবা প্রিন্স কোট। টাক্সেডো এবং বেসপোক ডিজাইন সব থেকে বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায় বরের পোশাকে। আর রঙের ক্ষেত্রে সাদা, কালো, নেভি ব্লু, মেরুন, বারগ্যান্ডি, ক্যামেল শেড লক্ষণীয়। এর বাইরে গ্রেও থাকছে। ল্যাপেল ডিজাইন, ফ্যাব্রিক এবং জ্যাকেটের লেন্থ ভূমিকা রাখে বরের লুকে। শীতের মৌসুমে ভেলভেট ফ্যাব্রিকে হতে পারে বরের পোশাক। ভিনটেজ লুকের জন্য ডাবল ব্রেস্টেড স্যুট বেশ উপযোগী হবে। প্রিন্স কোটকে যোধপুরি স্যুট বলে অনেকে। এর কারণ, যোধপুরের ট্র্যাডিশনাল কোটের প্যাটার্ন এমনই। প্রিন্স কোট-স্যুট এক রঙা কাপড়ে হয়। সেলফ প্রিন্টেড ফ্যাব্রিকেও তৈরি করা যেতে পারে। গাঢ় রং, যেমন কালো, নীলের শেড এতে মানিয়ে যাবে, সঙ্গে ক্রিম ও বাদামিও মানাবে।
বরের স্যুটে মূলত তিনটি বিষয় জরুরি— ফ্যাব্রিক, স্টাইল এবং ফিট। কারণ, যত স্যুটই থাকুক না কেন বরের আলমিরাতে; বিয়ের স্যুটের স্মৃতি বেশি মূল্যবান। আমাদের দেশের এবারের বিয়ের সিজনে কেমন ধরনের স্যুট হবে হট ফেভারিট, এর উত্তর দিয়েছেন ডিজাইনার ব্র্যান্ড জুরহেমের স্বত্বাধিকারী মেহরুজ মুনির। তিনি বলেন, ‘নিউ নরমালে উৎসব পালনের সব ক্ষেত্রে আনন্দকে প্রাধান্য দিচ্ছে মানুষ। বরের পোশাক পরিকল্পনা এর বাইরে নয়। যেমন সেলফ প্রিন্টেড এবং বুননের অলংকরণে আগ্রহ বেড়েছে। জ্যাকারড এ ক্ষেত্রে সমাদর পাচ্ছে বেশ। এক রং ফ্যাব্রিকের নিজস্বতা তৈরি করে দেয় এ ধরনের নান্দনিক নকশা।’ স্যুটের প্যাটার্ন সম্পর্কে মেহরুজ বলেন, ‘আমাদের দেশে বরের স্যুট ডিজাইনে সিঙ্গেল ব্রেস্টেডের চাহিদা সব সময়েই। এর পাশাপাশি ডাবল ব্রেস্টেডও বেছে নেন অনেকে।’
অলংকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘থ্রেড এমব্রয়ডারির চাহিদা বেড়েছে। সুতার কাজের আভিজাত্য নজর কেড়েছে ফ্যাশন-সচেতনদের।’ মোটিফের ক্ষেত্রে তরুণ এই ডিজাইনার দেখেছেন একটি নতুন ধারা, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফ্লোরাল মোটিফের রাজত্ব থেকে বেরিয়ে এসে এবার ক্রেতা মনোযোগী জ্যামিতিক মোটিফে।’
রং
বরের ওয়্যারড্রোব প্ল্যানিংয়ে টাক্সিডো বেশ পরিচিত। ভেলভেট ফ্যাব্রিকের ব্যবহার ছিল কয়েক বছর ধরে। এখানে বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন মেহরুজ। তিনি বলেন, ‘জ্যাকারড বুননের ফ্যাব্রিকে মানুষের চাহিদা বাড়ছে।’ এথনিক লাইনের ফ্যাব্রিক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক তন্তু অর্থাৎ ন্যাচারাল ফাইবারের চাহিদা বেড়েছে বলে আমি মনে করি। সিল্ক, কটন, লিনেনেও চাহিদা বাড়ছে।’
পাঞ্জাবি বরের ওয়্যারড্রোব প্ল্যানিংয়ের ক্ষেত্রে আবশ্যক। হলুদের পোশাক হিসেবে বেশির ভাগ সময়েই এটি থাকে পছন্দের তালিকার প্রথম দিকে। আজকাল কাবিন ও বিয়ে আলাদা হচ্ছে। বরের ডালায় যোগ হচ্ছে কাবিনের পাঞ্জাবি। হলুদের আয়োজনে হলদে পোশাক পরতেই হবে এমন কিন্তু নয়। স্নিগ্ধ ও শুভ্র দেখাবে এমন রং বেছে নেওয়া যেতে পারে। উজ্জ্বল রং যেমন ম্যাজেন্টা, সবুজ, বেগুনি, নীল, লাল এই তালিকায় থাকতে পারে। আরও কয়েকটি পর্ব থাকে বিয়ের উৎসবের। আংটিবদলেও পরা যায় পাঞ্জাবি। প্যাস্টেল শেড এবং মিনিমাল নকশা বরকে মানিয়ে যাবে এমন অনুষ্ঠানে। দিনের আয়োজন হলে পাঞ্জাবিতে ভারী অলংকরণ না রেখে সেলফ প্রিন্ট রাখতে হবে। সঙ্গে নেক লাইনে থাকতে পারে এমব্রয়ডারির কাজ। অলংকরণ না চাইলে বাটনের ব্যবহারের দিকে আলাদা করে নজর দিতে হবে। নান্দনিক নকশার বোতাম পাঞ্জাবিটিকে আকর্ষণীয় করে তুলবে। পাঞ্জাবির সঙ্গে বটমে থাকতে পারে স্লিম কাটের পাজামা অথবা চুড়িদার। এর বাইরে বিকল্প হিসেবে আছে ধুতি, রেগুলার কাট পাজামা।
বরের পোশাকের চাহিদায় ডিজাইনার কালেকশনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। প্রয়োজনের পোশাক নয়, শখকে প্রাধান্য দিয়ে বর নিজের পোশাক পরিকল্পনা করছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ডিজাইনারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করে নেওয়া যেতে পারে। বরের দৈহিক গড়নের সঙ্গে মিল রেখে ডিজাইনার ফ্যাশন সাজেশন দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সময় হাতে রাখতে হবে। বিয়ের উৎসবের সময়, ভেন্যু, কেমন মানুষের সমাগম, অতিথি আপ্যায়ন, কনের পোশাকের রং, পছন্দের ট্রেন্ড ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত থাকলে ডিজাইনার বরকে গাইড করতে পারবেন। পোশাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এবার অবশ্যই ডিজাইনারের কাছ থেকে অ্যাকসেসরিজ কেমন হবে, সে বিষয়ে জেনে নিতে হবে। পোশাকের সঙ্গে মানানসই ফুটওয়্যার, জুয়েলারি, ঘড়ি, পাগড়ি বরকে আত্মবিশ্বাসী রাখবে।

মডেল: রাব্বি, রূপম ও রাজ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ওয়্যারড্রোব: হাউজ অব আহমেদ ও জুরহেম
ছবি: জিয়া উদ্দীন ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top