পাতে পরিমিতি I চর্বি কর্তনের সহজপাঠ
‘মেদ ভুঁড়ি কী করি’ কিংবা ‘ভুঁড়ি ম্যান-ভুঁড়ি গার্ল’—এমনতর টিপ্পনী হয়তো আপনি পাত্তাই দেন না! ঠিক আছে। কিন্তু অজান্তেই রক্তে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন না তো? পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
ভূরিভোজ খুবই আনন্দের। কবজি ডুবিয়ে খাওয়া মানেই যেন রাজকীয় এক ব্যাপার। তবে ভূরিভোজ রোজ রোজ করলে ভুঁড়ি যেমন বাড়ে, তেমনি রক্তের কোলেস্টেরল বা চর্বিও। চারপাশে তাকালেই দেখা যায় অনেক কম বয়সী ছেলে-মেয়ের পেটেও বাড়তি মেদ। এই মেদ মানেই ফ্যাট। মানবদেহে সবচেয়ে বেশি ফ্যাট জমে পেটে ও পিঠে। এর মূল কারণ দুটি। একটি হলো খাবার খাওয়ার পর মেটাবলিজমের ধাপটি স্লো হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় কারণ ব্যায়াম বা এক্সারসাইজের অভাব।
তবে অনেকেই রক্তের কোলেস্টেরলকে ভিজ্যুয়ালি মোটা বা শুকনা দিয়ে বিবেচনা করেন, যা অনেক সময় সঠিক হয় না। কেননা অনেককে বেশ রোগা-পাতলা দেখালেও তার রক্তে কিন্তু চর্বি থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে জানতে হবে চর্বির ধরন সম্পর্কে। রক্তের ফ্যাটের পরিমাণ স্বাভাবিক রয়েছে কি না, সেটি জানতে অবশ্যই রক্তের লিপিড প্রোফাইল কেমন আছে, চেক করিয়ে নেওয়া ভালো। প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছর পর পর এটি চেক করানো যেতে পারে। লিপিড প্রোফাইলের মধ্যে পড়ে চার ধরনের ফ্যাট। যেমন: কোলেস্টেরল, এইচডিএল, এলডিএল ও টিজি। তবে সব কোলেস্টেরলই যে শরীরের জন্য খারাপ, তা নয়। এইচডিএল গুড কোলেস্টেরল, যা রক্তের খারাপ চর্বি সরিয়ে শরীরকে রাখে সুস্থ। সে ক্ষেত্রে যারা কোলেস্টেরলময় জীবন নিয়ে ভারাক্রান্ত, খাদ্যতালিকায় তারা রাখতে পারেন বিশেষ কিছু খাবার। যেমন বাদাম। যাদের এইচডিএল কম, বাদাম তাদের জন্য বেশ ভালো একটি চয়েস। প্রতিদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে একটু কাঁচা বাদাম ভর্তা রাখা যেতে পারে। তাতে কয়েক কোয়া রসুন যোগ করলে হয়ে উঠবে আরও স্বাস্থ্যকর। কেননা রসুনে থাকা ‘অ্যালিসিন’ উপাদানটি রক্তের কোলেস্টেরল কমায়। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও রাখে ভূমিকা।
জলপাই: এই শীতে জলপাই সহজলভ্য। এটি খাওয়া যায় ভর্তা, আচার কিংবা ডালে যোগ করে। প্রতিদিন এক-দুটি জলপাই খেলে এই শীতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গুড কোলেস্টেরলের লেভেল বাড়বে।
ফ্ল্যাক্স সিড: রক্তের চর্বি কমাতে এটি উপকারী। রক্তের খারাপ চর্বি কমানোর পাশাপাশি এটি গুড কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায়। ফ্লাক্স সিড বিভিন্নভাবে খাওয়া যেতে পারে। এই সিড গুঁড়া করে সকালের রুটির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে পারেন। এতে রুটির টেস্ট ও পুষ্টি উভয়ই এনরিচ হবে। তা ছাড়া এটি টক দই বা মিক্স ফ্রুটের সঙ্গে খাওয়া যায়।
শরীরের ওজন বাড়ছে কি না, দেহের শেপ ঠিক আছে নাকি পাল্টে যাচ্ছে—অনেকেই তা দীর্ঘদিন খেয়াল রাখেন না। পুরোনো জামাকাপড়গুলো যখন পরতে অসুবিধা হয়, দেখতে খারাপ লাগে, তখনই তাদের খেয়াল হয় পেটের ভাঁজে ভুঁড়ির লেয়ার। বডি যদি ফ্যাট কাজে না লাগিয়ে ডিপোজিট করে, তাহলে অবস্থা তো এমন দাঁড়াবেই! তাই কম ক্যালরি গ্রহণের পাশাপাশি ক্যালরি বার্ন করতে হবে প্রতিদিন। অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই পশ্চারে বসে থাকেন কোনো ধরনের মুভমেন্ট ছাড়াই। সে ক্ষেত্রে এমন আপত্তিকর গড়ন দেখা যায়। এ বিষয়ে কিছু টিপস রইল:
প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে আদর্শ ওজন। আপনার ওজন ঠিক কত হওয়া উচিত, তা জেনে নিতে হবে। কেননা বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম বা বেশি থাকলে তা বেমানান লাগে; অস্বাস্থ্যকরও।
দৈনন্দিন কত ক্যালরি খাওয়া হচ্ছে, তার হিসাব রাখা চাই। সেই সঙ্গে জেনে নিতে হবে, কত ক্যালরি গ্রহণ করা সমীচীন। সে ক্ষেত্রে কোনো পুষ্টিবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
সঙ্গে সেলফোন বা ঘড়ি থাকলে খেয়াল রাখুন, কোন সময়ে আপনি কী করছেন। প্রয়োজনে প্রতি এক ঘণ্টায় এক মিনিট হাঁটুন বা পশ্চার পরিবর্তন করে নিন।
নিজেকে সুন্দর দেখাতে কে না চায়? কিন্তু এই সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য থাকা চাই ইনার বিউটিফুলনেস। সে ক্ষেত্রে যাদের কোলেস্টেরল বেশি, তাদের দ্রুত তা কমাতে হবে। কেননা দীর্ঘদিন কোলেস্টেরল বেশি থাকলে হার্টের সমস্যা, লিভার ডিজিজ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া যাদের কোলেস্টেরল বেশি, তাদের ক্ষেত্রে গলস্টোন হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। কোলেস্টেরল কমানোর সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি হলো ডায়েট ও লাইফস্টাইল মডিফিকেশন। সে ক্ষেত্রে কিছু খাবার বাদ দিতে হবে খাদ্যতালিকা থেকে:
বাদ দিন দৃশ্যমান চর্বির লেয়ার, যাকে বলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট। গরু-খাসির চর্বি, নেহারি, মেয়নেজযুক্ত বার্গার বা ফাস্ট ফুড কোলেস্টেরল বাড়ায়। তাই এগুলো পরিহার করুন।
প্যাকেটজাত খাবার, প্রসেসড খাবার, রেডি টু ইট ফুডগুলোতে হিডেন ফ্যাট থাকে, যা আপনার কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এগুলোকে ‘না’ বলুন।
কোলেস্টেরলের কথা মাথায় রেখে তেলে আনুন ভিন্নতা। সে ক্ষেত্রে অলিভ অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল বা রাইস ব্র্যান অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। তবে অনেকেই খাবারে তেলের ধরন পাল্টে ফেলেন ঠিকই, কিন্তু তেল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেন না। সে ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েই যায়। তা ছাড়া তেল ব্যবহারে নিতে হবে আরও বাড়তি সতর্কতা। একবার ব্যবহারের পর সেই তেল পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। এতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
যাদের রক্তে চর্বির পরিমাণ বেশি, দেখা যায় তারা সব সময়ই একটু টেনশনে থাকেন। ফলে রাতে সহজে ঘুম আসে না। দেখা দেয় স্লিপ অ্যাপনিয়া। এ ক্ষেত্রে অনেকে মূল খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’, তাই না খেয়েও তো আর থাকা যায় না। সে ক্ষেত্রে তারা ছোট ছোট স্ন্যাকসকে জীবনের অংশ করে নেন। তাতেই তাদের রক্তে চর্বি আরও বাড়তে থাকে। কেননা স্ন্যাকস বলতেই তারা সিলেক্ট করেন চিপস, বিস্কিট, কুকিজ, ক্রাকার ইত্যাদি।
রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রিপ্লেস করতে হবে কিছু খাবার। এই ব্যস্তময় জীবনে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে যারা সত্যি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য রয়েছে কিছু ডায়েট সমাধান। যেমন:
রক্তের চর্বি কমাতে খেতে পারেন ওটস। শীতের সবজি দিয়ে গরম-গরম ওটস সকালের নাশতা হিসেবে দারুণ। তবে যাদের সকালে সবজি খাওয়াটা কিছুটা অপছন্দ, তারা সয়া মিল্কের সঙ্গে ওটস মিলিয়ে সঙ্গে কিছু আমন্ড যোগ করে সুপার ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিতে পারেন।
রুটি খেতে খেতে যারা বিরক্ত, তাদের জন্য নতুন একটি মেনু হলো পোহা। সবজি ও চিড়ার মিশ্রণে ঝটপট তৈরি করে ফেলুন চিড়ার পোহা। এটি বিকেলের নাশতা, এমনকি ডিনারেরও একটি ভালো অপশন।
বিকেলের নাশতায় অনেকেই কাবাব বা ফ্রায়েড কিছু পছন্দ করেন, সে ক্ষেত্রে চিকেন গার্লিক দিয়ে স্টিম করা ডাম্পলিং বা ভাপানো পিঠা খেতে পারেন।
চর্বি কমাতে দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেতে পারেন গাঢ় সবুজ শাক; যেমন: পালংশাক। টফু দিয়ে রান্না করা পালংশাক বা স্পিনাচ সুপ খেতে সত্যিই সুস্বাদু। শাকে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ডায়েটারি ফাইবার ও ফোলেট। এটি কোলন পরিষ্কার রাখে এবং রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
আমরা বেশ আরামপ্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। তবু বলি, ছোটখাটো শারীরিক পরিশ্রম গৃহকর্মী বা অন্যদের কাঁধে চাপিয়ে না দিয়ে নিজে করাই শরীরের জন্য ভালো। জানা কথা, ‘চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’। তাই আমাদের সব সময় চেষ্টা করতে হবে যেন রক্তে কোলেস্টেরল না বাড়ে। তবে যদি বেড়েই যায়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই নিতে হবে বাড়তি যত্ন। সামান্য অ্যাকটিভিটি বাড়িয়ে শুধু ডায়েট ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং কোলেস্টেরলমুক্ত জীবন গড়া সম্ভব।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট