রসনাবিলাস I পর্তুগিজ মরিচের সসে
ঝগড়া চলতেই পারে, পিরি-পিরি তুমি কার? দক্ষিণ আফ্রিকা যেমন এটিকে তাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত করেছে, তেমনি এই মরিচের বিশ্বায়ন বা উপনিবেশায়ন—যা-ই বলি, সেটা হয়েছে পর্তুগিজদের হাত ধরে। সেই পিরি-পিরি রসে কুক্কুট চেখে দেখতেই এবারে টিম ক্যানভাস বনানীর খাবারপাড়ায়
বাংলাদেশে পিরি-পিরির আগমন বেশ আগে, ২০০৯ সালে। বিশ্বখ্যাত পিরি-পিরি ব্র্যান্ড নান্দো’স এ দেশে এটিকে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ২০২১ সালের মার্চ থেকে সেই স্বাদবঞ্চিত আমরা। এই তালিকায় যে কেবল বাংলাদেশই আছে, তা ভাবলে ভুল হবে, আরও গোটা বিশেক দেশ থেকে তারা পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। তবে তার আগেই পিরি-পিরি চিকেনের বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা দেখে হাতে গোনা বেশ কটি পিরি-পিরি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছিল, নান্দো’স-এর পাশাপাশি। কেউ ঝরে গেছে, আবার কেউ বহাল তবিয়তে আকারে-আয়তনে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এই দ্বিতীয় দলেই রয়েছে রুস্টারস পিরি-পিরি।
শীতের পড়ন্ত এক দুপুরে রুস্টারস পিরি-পিরির রট আয়রনের সিঁড়ি বেয়ে টিম ক্যানভাস উঠে পড়ল ছোট্ট, কিন্তু বেশ গোছানো রেস্টুরেন্টে। দরজা খুলতেই কাচের দেয়ালজুড়ে বসার জায়গা। ব্যস্ত রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া দেখতে দেখতে রাজা-উজির মারার মতো আড্ডা দেওয়ার জন্য নিখুঁত পরিবেশ। ডানে চোখ ফেরাতেই গ্রুপ করে বসার জন্য চেয়ার-টেবিল পাতা। মাঝে হাঁটা-চলার পথ রেখে দেয়ালের কোণ ঘেঁষে আরও দুটো টেবিল পাতা, দুজন করে সেখানে বসতে পারে। সেটা পেরিয়ে কাউন্টার। টেবিলে কম্পিউটার, আর দেয়ালে সাজানো-গোছানো শেল্ফ। সাদামাটা দেয়াল। সিলিং থেকে ঝুলে নেমেছে অনেকগুলো লাইট। কয়েকটায় শেড আছে, আবার কয়েকটা তার আকৃতির জন্যই দর্শনীয়। এগুলো পেরিয়ে পেছনের দিকে একটা কিচেন, আর সেটা পেরিয়ে আরও একটি ঘরে দুটো টেবিলে বসার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে একসঙ্গে ২৪ জন বসে খেতে পারে।
আরাম করে বেতের গদি আঁটা আসনে বসতেই এক দফা ধাক্কা খেতে হলো। রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী খালিদ জানালেন, ‘এই রকম অনেকেই চমকায়, অনেক কষ্ট করে কারিগর খুঁজে বানিয়েছি এই প্লাস্টিকের জিনিস।’ চমক লাগল মেনু হাতে নিয়েও। শুরুতেই গর্ডন রামসে আর শেষে ভ্যান গঘ। বললাম, মেনুতেও কি আলাদা কোনো মুনশিয়ানা আছে? তিনি অভয় দিয়ে বললেন, ‘এখানে যা পাবেন সবই অথেনটিক, গর্ডন রামসে প্রিয় শেফ হিসেবে আর ভ্যান গঘকে রাখা হয়েছে কেবল প্রিয় শিল্পী হিসেবেই।’ ক্ল্যাসিক পিরি-পিরি চিকেন আর উইংসই অর্ডার করা হলো। ওদিকে কিচেনেও ডাক পড়ল দেখার জন্য। অনেক রেস্টুরেন্টেই যাওয়া হয়, খাওয়া হয় টিম ক্যানভাসের, তবে হলফ করে বলতে পারি, খুব কম রেস্টুরেন্টই সাহস করে কিচেনে নিয়ে গেছে আমাদের। এর মূল কারণ অনেক রেস্টুরেন্টই হাইজিন মেইনটেইন করতে পারে না, দেখাতে চায় না তাদের অপরিষ্কার হেঁসেল। গ্যাস বার্নারে ফ্লেম গ্রিল হতে দেখা গেল মেরিনেটেড চিকেন, তাতে হালকা সসের প্রলেপ দেওয়া, এ যেন এক অন্য অভিজ্ঞতা। তবে বেশি দুঃসাহসী হয়ে মুরগি পোড়ানোর আগেই প্রত্যাবর্তন করলাম নিজের আসনে। চিকেন আসতে তখনো খানিক সময় লাগবে। তাই মন দিলাম পিরি-পিরির ইতিহাসে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় রীতিমতো ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া এই মরিচের প্রথম চাষাবাদ হয়েছিল পর্তুগিজদের হাত ধরেই। সোয়াহিলি শব্দ ‘পিরি-পিরি’ অর্থ ‘মরিচ-মরিচ’, যেটা আফ্রিকায় পিলি-পিলি, পেরি-পেরি অনেক নামেই পরিচিত। মোজাম্বিক আর তার সঙ্গে লাগোয়া দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোয় এই মরিচের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হয়ে আসছে প্রায় ছয় শতক ধরে। তবে বলা হয়, এই মরিচ হয়তো তারও আগে আমেরিকা থেকে সেখানে গেছে; কারণ, এটা আমেরিকায় উৎপন্ন হওয়া ক্যাপসিকাম ফ্রুটাসেন্সের কাল্টিভার হিসেবেই এখন বিবেচিত। পর্তুগিজরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্য গড়তে ব্যর্থ হলেও (গোয়া ছাড়া) আফ্রিকায় সফল ছিল অনেকখানি, আর সেই সূত্রেই তারা এই মরিচ পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারতের গোয়ায়, বাংলাদেশের কর্ণফুলীর তীরের চট্টগ্রামে দিয়াং এলাকায় আর থাইল্যান্ডে। গোয়া আর থাইল্যান্ডের বার্ড’স আই চিলি খাবারের জগতে বেশ প্রসিদ্ধ হলেও চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে এই মরিচ আজও বাজারে বিকোয়, পাহাড়ে আদিবাসীদের হাত ধরে চাষাবাদও হচ্ছে বহুদিন ধরেই, আমরা স্রেফ ইতিহাসটা ছেঁটে ফেলেছি। আর এই মরিচ থেকে সস তৈরির কৃতিত্ব পর্তুগিজদের; আফ্রিকার পর্তুগিজ কলোনি—অ্যাঙ্গোলা অথবা মোজাম্বিকে প্রথম এই মরিচের সস তৈরি করা হয়েছিল।
যাহোক, কিছু সময় পরেই টেবিলে এলো ফ্লেম গ্রিল্ড পিরি-পিরি চিকেন, পিরি-পিরি উইংস সঙ্গে কর্নকব, কোলস্লো আর চার পদের হাউস-মেইড পিরি-পিরি সস—মাইল্ড, হট, এক্সট্রা হট আর লেমন অ্যান্ড হার্ব সস। চিকেন আর উইংস দুটোই হট সস দিয়ে গ্রিল করা ছিল, তাই হট সস দিয়েই সার্ভ করা হলো; অন্য সসগুলো ডিপ হিসেবেই চেখে দেখা। মাইল্ড সসটায় আমাদের স্বাদেন্দ্রিয় অনুযায়ী ঝাল প্রায় নেই বললে চলে, তবে হালকা ঝাল-ঝাল গন্ধ রয়েছে। হট সসটায় সবার সহনীয় মাত্রার ঝালের উপস্থিতি পাওয়া যায় আর স্বাদে দারুণ। তবে ঝাল ব্যাপারটার জন্য এক্সট্রা হটের বিকল্প নেই। অন্যদিকে সামান্য ঝালের উপস্থিতির সঙ্গে একটু হার্ব আর লেবুর স্বাদ নিতে চাইলে রয়েছে লেমন অ্যান্ড হার্ব সস। পিরি-পিরি চিকেন আর উইংসের স্বাদ নিখুঁতভাবে পাওয়ার জন্য আর তেমন কিছু অর্ডার করা হয়নি, এমনকি কোনো মকটেল বা ড্রিংকসও না। স্রেফ বরফ-ঠান্ডা পানি দিয়েই চলল ঝাল সামাল দেওয়ার চেষ্টা। খেতে খেতেই কর্ণধার খালেদ হাসান জানালেন, যুক্তরাজ্যে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজমের এক কোর্স করতে গিয়ে তিনি খন্ডকালীন কাজ করেছিলেন এক পিরি-পিরি রেস্টুরেন্টে। সেই থেকে পিরি-পিরি তার ধ্যান-জ্ঞান। সেখানেই পিরি-পিরির নাড়ি-নক্ষত্র জেনেছেন প্রায় তিন বছর ধরে। পরে দেশে ফিরে পিরি-পিরি রেস্টুরেন্ট দিতে চাইলেও সেটা হয়নি মূলত খাবারের ব্যবসায় পরিবারের অনুমতি না মেলায়। অবশ্য চার বছর পরে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পথচলা শুরু হয় পান্থপথে রুস্টারস পিরি-পিরির, পরিবারের অনুমতি মেলায়। এই চার বছর কাজে লেগেছিল বাজার যাচাইয়ে। আর তিনি চাইছিলেনও, লোকে যেন একে নান্দো’স-এর কপি না বলে। তিনি বলেন, ‘আফ্রিকার দেশগুলোতে পিরি-পিরি সসের নানা ভ্যারিয়েশন আছে, পর্তুগিজদের সসের স্বাদ যেমন আলাদা, তেমনি মোজাম্বিক বা জিম্বাবুয়ে কিংবা সাউথ আফ্রিকার একটার সঙ্গে আরেকটার স্বাদ মিলবে না। আমি অথেনটিক পর্তুগিজটাই করার চেষ্টা করেছি এখানে। যেখানে নান্দো’স দক্ষিণ আফ্রিকার সসটাকেই মূলমন্ত্র মানা হতো।’ বাজার যাচাই এতটাই যথার্থ হয়েছিল যে এর চার বছরের মাথায় আবার দ্বিতীয় শাখা খোলা হয় বনানীতে। এখন তৃতীয় শাখার পরিকল্পনা চলছে।
রুস্টারস পিরি-পিরিতে নানা পদের পিরি-পিরি চিকেন বা উইংস ছাড়াও মিলবে বিভিন্ন পদের অ্যাপেটাইজার, সাইডস, প্ল্যাটার, স্টেক, ফিশ অ্যান্ড চিপস, পিরি-পিরি বার্গার, র্যাপ, পাস্তা, স্যালাড, ডেজার্ট আর পানীয়। ফেব্রুয়ারি মাস ঘিরে ভ্যালেন্টাইন অফারও থাকছে তাদের, জানিয়েছেন খালেদ। বনানীর শাখা খোলা থাকে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে মধ্যরাত অব্দি, পান্থপথেরটা বেলা ১১টা থেকে রাত ১১টা। এ শাখায় আবার লাইভ মিউজিকেরও ব্যবস্থা রয়েছে বিশেষ দিনগুলোয়।
ঠিকানা: বনানী শাখা: বাড়ি ৬৮, সড়ক ১০, ব্লক ডি, বনানী, ঢাকা। ফেসবুক: : RoostersBanani; পান্থপথ শাখা: ৫৭/১২, পূর্ব রাজাবাজার, পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা। ফেসবুক: Team.Roosters।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক