বিশেষ ফিচার I ‘হাওয়া’ঘোর
সদ্যই মুক্তি পেয়েছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’। একে ঘিরে নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সংগীতকারের বয়ান
সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু
—মেজবাউর রহমান সুমন
পরিচালক
‘হাওয়া’ আমার কাছে সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশন প্রডাকশন, টিভিসিসহ বিভিন্ন অডিও ভিজ্যুয়াল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, তাই এটি নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম হলেও শুটিং আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবু ‘হাওয়া’ নির্মাণের অভিজ্ঞতা আমার কাছে দারুণ এক জার্নি হয়ে রয়েছে। যে জনপদের কথা বলতে চেয়েছি এই সিনেমায়, সেই জনপদের মানুষগুলো কেমন, কী রকম তাদের আচার-আচরণ, কীভাবে তারা জীবন কাটান এবং জীবনকে দেখেন—এসব বোঝার জন্য দীর্ঘদিন আমি তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে, সুযোগ পেলেই ছুটে গেছি তাদের কাছে। কখনো কখনো টানা ১০-১৫ দিন কাটিয়েছি সমুদ্রে। আর এর ফাঁকে এগিয়ে নিয়েছি স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। মাঝেমধ্যে খুঁজে বেরিয়েছি শুটিংয়ের সম্ভাব্য লোকেশন। এই খোঁজই আমার কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং ছিল।
‘হাওয়া’ যেহেতু জলের ছবি, আর এ ধরনের ছবি যেহেতু সাধারণত স্টুডিওতেই শুট করা হয়, অথচ আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল অন-লোকেশনে শুট করার, তাই বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে অনেকেই সতর্ক করে দিয়েছিল, গভীর সমুদ্রে শুটিং করা সম্ভব হবে না। আপাতদৃষ্টে সেটি সম্ভব হওয়ার কথাও নয়। কেননা, সমুদ্রে শুট করলে তার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া এই সিনেমায় বেশ কিছু রাতের দৃশ্য রয়েছে। সমুদ্রে রাতের লাইটিং করাও অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। সব মিলিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেও হাল ছাড়িনি। বারবার ছুটে গেছি সমুদ্রে। এদিকে, বিশ্ব সিনেমায় সমুদ্রের অন-লোকেশনে শুট করা ছবি যে একেবারেই নেই, তা তো নয়। সেগুলো যথাসম্ভব খুঁটিয়ে দেখেছি। কিন্তু সেই সব সিনেমার শুট সাধারণত করা হয়ে থাকে কোনো শান্ত সমুদ্রে, কিংবা সৈকতের একদম কাছে। অথচ আমাদের সমুদ্র তুলনামূলক যথেষ্ট উত্তাল। আর আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল গভীর সমুদ্রে যাওয়ার। তাই সৈকত থেকে বোটে ১-২ ঘণ্টা দূরের গভীর সমুদ্রে গিয়েও একের পর এক চালিয়েছি রিসার্চ। অবশেষে পেয়েছি কাঙ্ক্ষিত লোকেশনের খোঁজ। সিনেমাটির প্রেক্ষাপট যদিও খুলনার শরণখোলা; কিন্তু সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গিয়ে খেয়াল করলাম, এর ডান দিকে যখন উত্তাল ঢেউগুলো আছড়ে পড়তে থাকে, তখন বিপরীত প্রান্তে সমুদ্র থাকে তুলনামূলক শান্ত। এভাবে রিসার্চের সাহায্য নিয়ে, সমন্বয় করে অবশেষে শুট করতে পেরেছি।
এই ছবির জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল টিমওয়ার্ক। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই প্রডাকশনের কলাকুশলী সবাই ছিলেন অনেক বেশি সহযোগিতাপ্রবণ, পরস্পর অনেক বেশি সম্পৃক্ত। ‘হাওয়া’ একটা চেম্বার ড্রামা। বোটের মধ্যে শুট। বোট ছিল তিনটা। মেইন বোটেই শুট হয়েছে। সেই বোটে ৫০-৬০ জন গাদাগাদি করে থেকেছি। বাকি দুই বোট ছিল সাপোর্টিভ। ওখানেও থাকতেন ২০-২৫ জন। ডাঙায় শুট করলে সাধারণত কাজ শেষে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু গভীর সমুদ্রে সেই সুযোগ ছিল না। তাই পরস্পর সুখ-দুঃখ-মান-অভিমান ভাগাভাগি করে সেখানে ৩২-৩৩ দিনের শুটসহ ৪৫ দিন এতগুলো মানুষ একসঙ্গে কাটানোর ফলে আমাদের মধ্যে দারুণ একটা বন্ডিং হয়ে গেছে।
‘হাওয়া’কে মিস্টেরি জনরার বলতে চাই আমি। ফর্ম-কালের রূপকথা। একে আসলে মিক্সড জনরার ছবি বলা চলে। এই সিনেমা দর্শকের মনে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, নির্মাতা হিসেবে তা দেখার অপেক্ষায়।
আর বুঝি ফিরতে পারব না
—চঞ্চল চৌধুরী
অভিনেতা
আমি বরাবরই চ্যালেঞ্জিং চরিত্র বেছে নিতে পছন্দ করি। চেষ্টা থাকে, আগে যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছি, তার চেয়ে ভিন্ন ধরনের কিছু যেন করতে পারি। ‘হাওয়া’র চরিত্রটিও চ্যালেঞ্জিং। তবে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রকে সহজ করে তোলার দিকে ঝোঁক আমার। যেন অভিনয় দেখে দর্শকের মনে হয়, খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজ চরিত্র।
‘হাওয়া’ মাঝিদের গল্প। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় স্ট্রাগল ছিল মাঝ সমুদ্রে একটানা ৪৫ দিন কাজ করা। আমরা আগে থেকেই ঢাকায় দু-তিন মাস রিহার্সাল করে নিয়েছিলাম। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়, পুরো টিমই যে যার দায়িত্বের রিহার্সাল করে নিয়েছে। ফলে শুটিংয়ের একদম প্রথম মুহূর্ত থেকেই পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই মাঝ সমুদ্রে এত দিন ধরে শুটিং করা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা ছিল। দুর্যোগে পড়েছিও। শুটিং চলাকালেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে চার দিন কক্সবাজারসহ সারা দেশের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওই চার দিন আমাদের খোঁজ কেউ পায়নি; আমরাও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। ফলে একধরনের আশঙ্কা ও আতঙ্ক কাজ করেছে। একপর্যায়ে তো মনে হয়েছিল, আর বুঝি বেঁচে ফিরতে পারব না!
‘হাওয়া’ টিম একটি পরিবারের মতো একসঙ্গে কাজ করেছে। এর ফলাফল এখন সবার সামনে উপস্থিত। তাই দর্শকদের কাছে অনুরোধ, এই যে আমরা এত কষ্ট করে, জীবন বাজি রেখে একটি চলচ্চিত্র হাজির করলাম, এখন আপনাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা এমনিতেই খুব একটা ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে আপনারা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিংবা ছোট স্ক্রিনে বিনা মূল্যে ‘হাওয়া’ দেখার অপেক্ষা না করে যদি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেন, তাহলে সার্বিকভাবে তা এ দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির উপকারে আসবে।
যে জার্নি ভোলার নয়
—নাজিফা তুষি
অভিনেত্রী
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করেছি। সেগুলো মুক্তিও পেয়েছে। কিন্তু কোভিডের কারণে ‘হাওয়া’ মুক্তি পেতে একটু বেশি সময় লেগে গেল। তবে এই চলচ্চিত্রের গুলতি হিসেবেই আমার প্রথম ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করা। গুলতি খুবই শক্তিশালী একটি চরিত্র। বেদেনির চরিত্র। তবে বেশ রহস্যময়। চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয় টের পেয়েছেন। চরিত্রটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপে যেতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই, অনেকেই পাশের বাড়ির মেয়ে কিংবা সাধারণ প্রেমকাহিনির নায়িকার মতো খুব চেনা-জানা ও অপেক্ষাকৃত সহজ চরিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পথচলা শুরু করলেও আমার ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। গুলতির মতো একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিতে হয়েছে। অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বেদেজীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয়েছে। কেননা, এই চরিত্রে রয়েছে অনেকগুলো বাঁক। আর প্রতিনিয়ত প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে আমি শিখেছি, কী করে একটি চরিত্রকে চরিত্রায়ণ করার শিক্ষা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পক্ষে পাওয়া সম্ভব।
‘হাওয়া’ ছিল আমার জন্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ের একটি স্কুলিং। প্রডাকশনে যাওয়ার ছয় মাস আগেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম আমি। শুধু আমাদের, অর্থাৎ অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই নয়, পুরো টিমকেই একধরনের মিলিটারি ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আর এ কারণে ও রকম মাঝ সমুদ্রে, প্রতিকূল পরিবেশে শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। কেননা, সম্ভাব্য যেকোনো দুর্যোগের জন্য আমরা ছিলাম প্রস্তুত। আর ‘হাওয়া’ টিম সব সময়ই এক হয়ে পাশে থেকেছে। এখন সিনেমাটি যখন দর্শকের সামনে, আমি অবাক হয়ে ভাবি, কী করে এত চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম!
শুটিংয়ের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। সারাক্ষণ গুলতি চরিত্রটির ভেতরই ডুবে থাকতাম। তাই একজন ব্যক্তিমানুষ থেকে ও রকম একটি চরিত্রে পরিণত হওয়ার জার্নিটা আমার কাছে খুব অর্থবহ। এখন মাঝেমধ্যে আনমনে ভাবি, আবার কবে এমন কোনো চরিত্রে, এমন কোনো পরিবেশে, এমন কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে নিজেকে দাঁড় করাতে পারব।
দর্শকের কাছে আমার বিশেষ কোনো প্রত্যাশা নেই। জোর করে নিজের অভিনয় কাউকে দেখাতে চাই না; বরং তাদের যদি ‘হাওয়া’ ভালো লাগে, তাদের যদি গুলতিকে ভালো লাগে, নিশ্চয় তারা নিজে থেকেই এগিয়ে আসবেন। সিনেমাটি দেখবেন, হয়তো একাধিকবার। আর সেটিই আমার প্রাপ্তি।
দিয়ে যাক দোলা
—রাশিদ শরীফ শোয়েব
মিউজিক স্কোর কম্পোজার
‘হাওয়া’র সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় জড়িয়ে ছিলাম। এর অরিজিনাল মিউজিক স্কোরের কাজও অনেক দিন ধরে করেছি। এই সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন আমার ব্যান্ডমেট [মেঘদল] ও বন্ধু। সেই সূত্রে সিনেমাটির স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্টের সময় থেকেই এর সঙ্গে আমি যুক্ত।
আমরা জানি, ভিজ্যুয়ালের মিউজিক সব সময় গল্পটার সঙ্গে, চরিত্রগুলোর সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করে। ‘হাওয়া’ যেহেতু মাঝ সমুদ্রের গল্প, জল ও হাওয়ার সঙ্গে মিউজিক যেন কমপ্লিমেন্ট করে, একাত্ম হয়ে ওঠে, সেই চেষ্টা ছিল আমার। ছবির মিউজিকে আমরা কিছু মোটিফ ব্যবহার করেছি। মূলত সারিন্দা, বাঁশি ও একজন নারী বাউলের ভোকাল—এই তিনটি ইনস্ট্রুমেন্ট বেসিক মোটিফ হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে, গুলতি চরিত্রটির থিম মিউজিক ক্রিয়েট করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা নিয়েছি আবহমান বাংলার গীত এবং কফিল আহমেদের গান থেকে। মূলত ট্র্যাডিশনাল ইনস্ট্রুমেন্টই ব্যবহার করেছি। সেই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি এ সময়ের ইনস্ট্রুমেন্টও। কেননা, ‘হাওয়া’ তো একধরনের আধুনিক রূপকথা।
সেই ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে যখন ‘হাওয়া’ টিমের একজন হলাম, তখন থেকেই এই সিনেমার মিউজিকের জার্নি শুরু আমার। ২০২২ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসে সেই জার্নির আপাতত সমাপ্তি ঘটল সাউন্ড মিক্সিংয়ের মাধ্যমে। এমনও হয়েছে, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মিউজিকের স্কোর নিয়ে পরিচালক ও টিমের অন্যদের সঙ্গে নিরন্তর বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটা পর্যায় দাঁড় করানো গেছে, আর চূড়ান্ত পর্যায়ে বাদ দিয়ে দিয়েছি সেটি! এই শেষ মুহূর্তের দায়িত্ব পালন, অর্থাৎ সাউন্ড মিক্সিং করার সময়ে পুরো জার্নিটাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। এ আমার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
বলে রাখি, ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন ফিল্ম কম্পোজার হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু আবহসংগীতের প্র্যাকটিস আমাদের এখানে খুব একটা দাঁড়ায়নি এখনো। অনেকেই মিউজিকের স্কোর বলতে গানের সুর-সংগীতের কথা বোঝেন। তা নিয়ে মন খারাপ করি না; বরং কাজ করে যেতে চাই। একই সঙ্গে জানাতে চাই, আমি সেই মিউজিকে বিশ্বাসী নই, যেটা সিনেমাকে ছাড়িয়ে যাবে। ‘হাওয়া’ আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি জার্নি। আমি এই সিনেমার মিউজিক স্কোরগুলোর সাউন্ডট্র্যাক আলাদাভাবে রিলিজ করার আশা রাখি। সিনেমাটি দেখতে দেখতে আবহসংগীত যদি দর্শক-শ্রোতার মনে সংগতিপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়, তাহলেই নিজেকে সফল মনে করব।
রুদ্র আরিফ
ছবি: ‘হাওয়া’ টিমের সৌজন্যে