ফিচার I কুলপি যেন ক্ষুদে হিমালয়
কুষ্টিয়ার লোকপদ্ধতিতে তৈরি অসাধারণ এক খাবার। শীতল, সুস্বাদু। তবে নগরে এসে এর মৃত্যু ঘটেছে
কুলপিমালাই হচ্ছে কুষ্টিয়ার লোক-আইসক্রিম। মজা করে ফোক-আইসক্রিমও বলা যেতে পারে। অনেকে বলেন ‘কুলপিবরফ’। মূল নাম শুধুই ‘কুলপি’। বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় কুলপি অতটা নিজস্ব নয়, যতটা কুষ্টিয়ায়। এবং সেটা শত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপ্রিয় শখের খাদ্য। অতএব, সেটা নিয়ে যদি মামুলি প্রতিবেদন লেখা যায়, তাহলেও তা প্রকারান্তরে একধরনের লোকসাহিত্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ওই জেলার মানুষ হিসেবে কুলপির সঙ্গে আমার ঢের দিনের সখ্য, সুখস্মৃতি এবং দুর্বলতা যে রয়েছে, তা অস্বীকার করবো না বা সেই সত্যকে চেপেও যাবো না। সেই বিস্ময়কর স্বাদু কুলপিকে এখন দেখি ঢাকায় ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু তার বিকিকিনির যেসব ঐতিহ্যবাহী চারিত্র্য, সেগুলোর যেন মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সিলভারের বড় পাতিলের মধ্যে বরফ দিয়ে কুলপিমালাই জমিয়ে ছোট্ট পলি প্যাকে করে সেটা বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা সেই প্যাকের নিচে, কোনায় দাঁত দিয়ে ফুটো করে, সেখানটায় মুখ লাগিয়ে চুষে চুষে খাচ্ছেন। আর যে রিকশাভ্যানে করে বহন বা ফেরি করা হচ্ছে, তাতে মাইক লাগিয়ে ঠাসা গলায় বিজ্ঞাপন বাজছে: ‘খাঁটি কুষ্টিয়ার আসল কুলপি মালাই’। ঘটনা দেখে মেজাজটা খিঁচে গেল। বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম: বাড়ি কোথায়? উত্তর দিলেন: কুমারখালী। কুমারখালীর কোথায়? তিনি কথার টানে বুঝে ফেললেন, আমি তার ওদিককার লোক। মানুষটা হেসে জবাব দিলেন: স্যার, খোরশেদপুর। খোরশেদপুর হলো রবিঠাকুরের শিলাইদহের পাশের গ্রাম। এই ঘটনাটা শাহবাগে। বিশ টাকার একটা কুলপি নিয়ে পলি প্যাক ফুটো করে চুষতে শুরু করলাম। কিন্তু স্বাদে-গন্ধে অনেক দূর। খাওয়ার পদ্ধতি দেখেও আমার রুচি ও স্বাদ প্রত্যাশার আনুকূল্য পেলো না। বিক্রেতাকে বললাম: দূর ভাই, এইডা কি আসল? তার উত্তর: কারিকর আসলই স্যার, কিন্তু ঢাকায় কি আর দেশের মতোন হয়। পড়তা হয় না। চড়া দাম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র যারা পড়েছেন, তারা জানেন। তাতে তিনি শাহজাদপুর ও শিলাইদহ অঞ্চল থেকে স্থানীয় গাওয়া ঘি জোড়াসাঁকোয় পাঠানোর জন্য লিখেছেন। এটা একটা সূচক যে এতদঞ্চলে সেকালেও গরুর দুধের ভালো উৎপাদন ছিল। এখানে এখনো দুগ্ধজাত মিষ্টান্ত অনেক মানসম্পন্ন। যে কথা বলতে এত কথা, সেটা হলো আমাদের আলোচ্য কুলপিমালাইও দুগ্ধজাত শখের খাবার। শিশু-বুড়ো-জোয়ান বাঙালিমাত্রই যেমন আম খুব পছন্দ করে, আমাদের অঞ্চলে কুলপিমালাইও ঠিক সেই রকমের জনপ্রিয়। তো ঢাকায় মাইক টাঙিয়ে, ভ্যান ঠেলে, যেভাবে ওটা বিক্রি করা হচ্ছে এবং ‘আদি ও আসল খাঁটি’ বলে যে হেঁড়ে গলায় চিৎকারটা করা হচ্ছে, তাতে বিরক্ত হবার কী আছে? আছে তো বটেই, আলবত আছে। আসলে কুলপিমালাই জিনিসটা বানানোর, সংরক্ষণের, পরিবেশনের হাঁক ছাড়ার যে কিছু ধরনগত ঐতিহ্য আছে, সেটা খাওয়ার মধ্যেও যে কিছুটা গেঁয়ো আর্ট আছে, ঢাকায় তার সবটাই যেন মারা পড়েছে। ওই সব কায়দা-কানুনগুলোকে এতটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে যে, কুলপি আর কুলপি থাকেনি। যেমন ‘কুষ্টিয়ার খাঁটি’ না বলে বলা হচ্ছে যে ‘খাঁটি কুষ্টিয়ার’। অর্থাৎ কুষ্টিয়া খাঁটি, কুলপি খাঁটি কি না সে কথা নয়।
কুলপিমালাই বানানোর পেছনে রয়েছে শত বছর ধরে অনুশীলিত একটি বিশেষ লোকবিজ্ঞান। যার পুরোটাই প্রকৃতিনির্ভর এবং নিরক্ষর সাধারণের মেধাপ্রসূত। এটা তৈরিতে যেসব উপাদান লাগে, তা হলো, দীর্ঘক্ষণ জ্বাল দিয়ে লালচে-ঘন করা গরুর ঠান্ডা দুধ, দুধের সর, চিনি আর ছোট এলাচির সামান্য মিহি মিশ্রণ। এ তো গেল খাদ্যসামগ্রী। সহায়ক অন্য উপাদানগুলো হলো- নুন গোলানো পানি, পাটা বরফ আর আটা-ময়দার লেই। পাত্র-যন্ত্র যেগুলো লাগে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মাটির মাঝারি সাইজের একটা কোলা, মেটে ঢাকনি। কোলাটাকে মুড়িয়ে ডেকোরেটেড করাও লাগে এক প্রস্থ লাল সালু কাপড়। পরিবেশনের প্লেট হলো চৌকো এক টুকরো কলাপাতা। কেটে কেটে খাওয়ার জন্য যে চামচটা, সেটা হলো আড়াই-তিন ইঞ্চি লম্বা এক টুকরো নারকেল অথবা তালের পাতা। কলার পাতায় তুলে গ্রাহককে দেয়ার সময়, খাওয়ার সুবিধার্থে বিক্রেতা একটা চাকু দিয়ে কুলপি মালাইটাকে লম্বালম্বি দুটো ফালি করে দেন। ততক্ষণে কিছুটা গলে যে তরল হয়ে গেছে, বেশির ভাগ পোলাপান মুখ লাগিয়ে সুড়ুৎ করে সেটা টেনে নেয়। আহা, কী তৃপ্তি!
এ তো গেল উপাদান, পরিবেশন আর খাওয়ার গল্প। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয় ওটা? সেটা বেশ মজার লোকপদ্ধতি এবং গ্রামীণ কেমিস্ট্রি। লম্বা লম্বা টিনের গোলাকার ছাঁচ। তার মধ্যে ওই দুধের ঘন দরদরে স্বাদু তরলটি ঢেলে ঢাকনা লাগিয়ে আটার লেই দিয়ে বন্ধ করা হয়। এইবার, ওই কোলার ভেতরে যে নুন পানি আর বরফ রয়েছে, তার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হলেই ওটা কৌটার মধ্যে জমে যায়। মাঝে মাঝে ছন্দোবদ্ধ তালে ওই কোলাটাকে ঝাঁকিয়ে দুলিয়ে বরফের মধ্যে প্রক্রিয়ামান কুলপিগুলোকে ওপর-নিচে ওলট-পালট করে দেয়া লাগে। একসময় ওই কোটার ভেতরে নাজুক, নরম, ঘিয়ে রঙের কুলপি তৈরি হয়ে যায়। এবার ওই কোলাটি মাথায় করে কুলপিঅলা বেরিয়ে পড়েন ফেরি করতে। তখন তিনি চড়া স্বরে হাঁক ছাড়েন- ‘অ্যাই কুলপি…’। গ্রাহক মিললে শীতল কোনো ছায়াবৃক্ষের তলে বসে কোলার মুখ খুলে বরফের শীত থেকে কুলপির কোটা বের করে চাকু দিয়ে আটা-ময়দার লেই ছাড়িয়ে ঢাকনা খোলেন। কৌটা থেকে কুলপিটাকে কলার পাতায় ঢেলে দেয়ারও একটা বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি আছে। শিশুর মুখের মতো তুলতুলে হলেও ওর মধ্যে তো ওটা মাপে-খাপে জমে আছে। অর্থাৎ কৌটাটাকে উপুড় করলেই তো আর সেটা বেরিয়ে আসবে না। তখন সেই মুখ খোলা কুলপিসহ কৌটাকে দুই হাতের তালুতে ধরে রগড়ে-রগড়ে কয়েকবার যেন উল্টো-সোজা দড়ি পাকানো হয়। তাতে কিছুটা তাপে, কিছুটা ঠাসা খাওয়ায় জমাট কুলপিটা কৌটার ভেতরে ঢিলা হয়ে যায়। এবার আস্তে করে উপর-নিচে দুটো আদুরে আলতো ঝাঁকি দিয়ে কলার পাতার ওপর ঢেলে দিলে টুপ করে বেরিয়ে আসে জমাটি, কিন্তু আশ্চর্য নরম আর ছোট্ট হিমালয়ের মতো কুলপিমালাই। তারপর বিক্রেতা ঘ্যাচ করে চাকু চালিয়ে ওটাকে দুভাগ করে একটা নারকেল পাতার চামচ বিঁধিয়ে আপনার হাতে ধরিয়ে দেবেন। উফ্…কী ঠান্ডা। একটুখানি মুখে তুলে টাকরায় জিভ বাজিয়ে খান, তখন বুঝবেন আসল কুলপিমালাই কাকে বলে। আরও খান, মন তো ভরবেই না, পেটও যেন আরও চাইবে! সত্যি, পরীক্ষা প্রার্থনীয়। এই যেখানে সংস্কৃতি, সেখানে মাইক বাজিয়ে, পাউডার দুধের কুলপিকে পলিথিনের ঠোঙায় ভরে খাওয়ালে বা খেলে, অন্তত কুষ্টিয়ার মানুষ হিসেবে আমার মেজাজ কেন সপ্তমে চড়বে না?
পুনশ্চ: বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার তিলেখাজা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তার তুলনায় ঢের বেশি স্বাদু, মানসম্পন্ন, খ্যাতিতে ঐতিহ্যবাহী হলো কুমারখালীর মটকা আর খোকসার চমচম। অন্তত মটকা যে একটা অসম্ভব ধরনের অন্য রকম শখের খাবার, না খেলে বোঝা যাবে না। একটা খেলে আর লোভ সংবরণ করা যায় না। তবে খ্যাতির সর্বোচ্চ মর্যাদার মুকুটটি যে কুলপির মাথায় শোভা পায়, সেটায় কোনো বেমানান ঘটেনি। কুলপি যথার্থই একটা ‘ছেলেধরা মার্কা’ খাবার। আইসক্রিমও না- ফালুদাও না, সে-ই এক আশ্চর্য। সে আমাদের বর্তমান এবং বহুদিনের ইতিহাস। দূর ভবিষ্যৎকেও যে জয় করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিলু কবীর
ছবি: লিটন আব্বাস ও আরকে জামান রিপন, কুষ্টিয়া