ত্বকতত্ত্ব I যন্ত্রযোগে যত্ন
স্কিন কেয়ার টুলস। ত্বকযত্নে বাড়ছে কদর। তবে নিয়ম মেনে, সুরক্ষা নিশ্চিত করে ব্যবহার করা ভালো
ফেসওয়াশ, সেরাম, টোনার, ময়শ্চারাইজার, সানস্ক্রিন ক্রিম—এ ধরনের আরও নানা প্রডাক্ট সচরাচর ব্যবহার করা হয় স্কিন কেয়ার বা ত্বকযত্নে। পরিষ্কার, বলিরেখামুক্ত, টান টান ত্বকের পেছনে বাজারের এসব প্রডাক্টের পাশাপাশি অবদান আছে বেশ কিছু অনুষঙ্গেরও; সৌন্দর্যচর্চার জগতে যেগুলো পরিচিত স্কিন কেয়ার টুল হিসেবে। মূলত ২০২০ সালে এসবের ব্যবহার বাড়ে কয়েক গুণ! সে বছর করোনা মহামারির সময়টায় চলা লকডাউনের কারণে বাড়ির বাইরে ট্রিটমেন্ট নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই ঘরে বসে ত্বকের যত্ন নেওয়ার নতুন পন্থা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় নানা গড়নের, নানা রঙের, নানা ঢঙের স্কিন কেয়ার টুল।
আচ্ছা, এমন কোনো যন্ত্র থাকলে কেমন হতো, যার সুইচ চাপলেই তা নিজ থেকে আপনার ত্বকের প্রতিটি অংশের গভীরে থাকা ময়লা ও ত্বকের মরা চামড়া দূর করে দেবে! একই সঙ্গে হালকা ম্যাসাজও করবে! হরেক রকমের এসব কাজের জন্য রয়েছে সিলিকনের ব্রিসলযুক্ত ফেসওয়াশ ডিভাইস। এগুলোর মধ্যে আবার কিছু ডিভাইস আছে ব্যাটারিচালিত। সেই ডিভাইসগুলো সাধারণত ভাইব্রেশনের মাধ্যমে ত্বকের ম্যাসাজ করে থাকে। এতে যেমন মুখ পরিষ্কার হয়, তেমনি খুব কম সময়ে ছোট্ট একটা স্পা সেশনও হয়ে যায়!
ঘরে বসেই স্পা ট্রিটমেন্ট নেওয়ার জন্য কার্যকর আরেকটি টুল হলো ফেশিয়াল স্টিমার। এ যন্ত্র থেকে তৈরি উষ্ণ ধোঁয়া ত্বকে এনে দেবে সতেজ অনুভূতি। সাধারণত মুখ পরিষ্কার করার কিংবা সেরাম, ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের পর এ ধরনের ট্রিটমেন্ট নেওয়া হয়। স্টিমিং ডিভাইসে ধোঁয়া তৈরি করার জন্য আবার সব সময় শুধু পানি ব্যবহার করা হয় না; বরং টোনার কিংবা ময়শ্চারাইজিং কোনো তরলের মিশ্রণও ব্যবহার করা যায় স্টিমারে। ফেশিয়াল স্টিমিং ডিভাইসগুলোর দাম যদিও কিছুটা বেশি, তবে একটিমাত্র ডিভাইস দিয়ে স্পা ট্রিটমেন্টের সুযোগ কেই-বা হারাতে চায়!
আপনি যদি সম্প্রতি মুভি-সিরিজের নামকরা তারকাদের স্কিন কেয়ার রুটিন নিয়ে কোনো ভিডিও দেখে থাকেন, তাহলে ‘জেড রোলার’ শব্দযুগল আপনার কাছে অপরিচিত নয়। খুবই সহজভাবে কাজ করা এই অনুষঙ্গে রোলার হিসেবে মূলত প্রাকৃতিক জেমস্টোন ‘জেড’ ব্যবহার করা হয়েছে। রূপচর্চায় সবুজ রঙা এ রত্নপাথরের ব্যবহার শুরু প্রাচীন চীনে। এত শত বছর পর আবারও সৌন্দর্যচর্চার একটা বড় অংশজুড়ে এ পাথরগুলোর ব্যবহার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। জেড রোলার দিয়ে ত্বকে মূলত লিমফেটিক ম্যাসাজ করা হয়। সহজ করে বললে, মুখের ফোলা ভাব কমাতে এটি কাজে আসে। ডিভাইসটি দিয়ে খুব সামান্য চাপে এ ট্রিটমেন্ট নেওয়া যায়। জেড রোলার দিয়ে পুরো মুখে যথাযথভাবে রোল করার মাধ্যমে চামড়ার ভেতরের স্তরে অবস্থিত লিম্ফ ভেসেলে জমে থাকা ফ্লুইড ও টক্সিন দূর করা সম্ভব।
তবে সচরাচর জেড রোলার শব্দযুগল ব্যবহার করলেও ত্বকে ম্যাসাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া প্রতিটি পাথরের রয়েছে একেক গুণ। এমনই একটি পাথর হলো রোজ কোয়ার্টজ। একে বলা হয় দ্য ক্রিস্টাল অব লাভ। ত্বকযত্নের পাশাপাশি মানসিক সমস্যা নিরাময়েও এ ক্রিস্টাল ব্যবহারের প্রচলন আছে। মূলত ত্বককে ডিটক্সিফাই করার জন্য রোজ কোয়ার্টজ রোলার ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সূক্ষ্মরেখা ও বলিরেখার মতো বার্ধক্যজনিত লক্ষণ থেকে মুক্তি পেতেও এর ব্যবহার রয়েছে। রোলারের পাথর হিসেবে ইদানীং অ্যামেথিস্টও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই টুল ত্বকের দৈনন্দিন চাপ কমাতে সাহায্য করে। তা ছাড়া ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি যাদের অ্যাকনে প্রোন স্কিন রয়েছে, তাদের মুখের ব্রণ কমাতেও কাজে আসে অ্যামেথিস্ট।
ইনফ্ল্যামেশন দূর করতে আরও কার্যকর পাথর হলো ব্লু সোলাডাইট। ত্বকের কোষগুলোকে হাইড্রেট করার জন্য এটি প্রচলিত। তা ছাড়া ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা নিরাময়ের পাশাপাশি টেক্সচার উন্নত করতেও ব্যবহার করা হয় এটি। এসব পাথর ছাড়া রংবিহীন আরেকটি পাথর হলো ক্লিয়ার কোয়ার্টজ। দেখতে খুব সাধারণ হলেও এটি ত্বককে সুস্থ ও সতেজ করে তুলতে বেশ কাজে দেয়। সবশেষে বলা যায় সাধারণ জেড পাথরে তৈরি রোলারের কথা। জেড রোলার ইনফ্ল্যামেশন কমিয়ে ত্বকের ইলাস্টিসিটি অর্থাৎ টান টান ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ফেশিয়াল রোলারের মতো রত্নপাথর দিয়ে তৈরি আরেকটি স্কিন কেয়ার টুল হলো গুয়াশা। দেখতে অতি সাধারণ, ত্রিকোণাকার এ পাথর প্রথম চীনারাই রূপচর্চায় ব্যবহার শুরু করে। প্রাচীন চীনে এ পাথর ব্যবহার করা হতো রক্তসঞ্চালন উন্নত করার কাজে। এ ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশ যেমন পিঠ, ঘাড়, হাত ও পা ম্যাসাজেও গুয়াশার ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে এটি ব্যবহার করা হয় ত্বক টান টান করার কাজে এবং ত্বক থেকে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে।
স্কিন স্কাল্পটিং টুল হিসেবে জেড রোলার ও গুয়াশার পাশাপাশি অবদান আছে আরও কিছু ফেশিয়াল টোনিং ডিভাইসের। ইংরেজি ‘Y’ অক্ষরের মতো দেখতে এসব ডিভাইসের সাহায্যে সহজে মুখের ফোলা ভাব দূর করা যায়। এ ছাড়া কিছু কোম্পানি ফেস ম্যাসাজার ও টোনার হিসেবে বাজারে এনেছে ‘গোল্ড স্কাল্পটিং বার’ ডিভাইস। ব্যাটারিচালিত এ যন্ত্রের মাথায় থাকে সরু আকারের একটি ধাতব দণ্ড, যা ভাইব্রেশনের মাধ্যমে মুখের ম্যাসাজ করে। তা ছাড়া ভাইব্রেশনের ফলে ত্বকের ভেতরের স্তরে সেরাম বা ক্রিমজাতীয় প্রডাক্ট পৌঁছানো সহজ হয়। জেড রোলার হোক কিংবা টোনিং ডিভাইস—এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার একদিকে যেমন ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে, মনকেও করে উজ্জীবিত।
সৌন্দর্যচর্চার জগতে প্রতিদিনই নিত্যনতুন ডিভাইসের উদ্ভব হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন বলা যায় এলইডি মাস্কের কথা। অভিনব এ মাস্ক পরা অবস্থায় কাউকে দেখে যে কারও স্টার ওয়ারস বা রোবটের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু রূপচর্চায় এলইডি রশ্মির ব্যবহার কি আসলেই যৌক্তিক? ২০১৮ সালে ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড অ্যাসথেটিক ডার্মাটোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এলইডিকে রূপচর্চায় ব্যবহারের ডিভাইস হিসেবে ইতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। তবে ইদানীং এ ডিভাইসের পরিচিতি বাড়লেও ত্বকের চিকিৎসায় এলইডি রশ্মির ব্যবহার চলছে কয়েক দশক ধরে। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও অ্যাসথেটিশিয়ানরা অনেক দিন ধরে ফেশিয়ালের পর ত্বকের প্রদাহ ও ব্রেকআউট কমাতে এবং সামগ্রিকভাবে ত্বক-সুরক্ষায় এলইডি মাস্ক ব্যবহার করে আসছেন।
বর্ণালিতে সাত রঙের আলো রয়েছে। প্রতিটি আলোই ত্বকের যত্নে আলাদা কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লাল আলোর কথা। রক্তসঞ্চালন বাড়ানোর পাশাপাশি ত্বকের কোলাজেনকে উদ্দীপিত করতে কাজে আসে এ আলোর এলইডি মাস্ক। তা ছাড়া বলিরেখা ও বার্ধক্যের ছাপ কমাতেও এটি কার্যকর। অন্যদিকে, নীল আলো মূলত ত্বকের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ব্রণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এলইডি মাস্কে লাল ও নীল রঙের ব্যবহার বেশি দেখা গেলেও অন্যান্য রং, যেমন হলুদ (ত্বকের লালচে ভাব কমাতে) এবং সবুজ (পিগমেন্টেশন কমাতে) রঙের ব্যবহারও দেখা যায়।
কথায় বলে, ত্বক সুস্থ থাকলে মন সুস্থ থাকে। তবে ত্বকের যত্নে স্কিন কেয়ার ডিভাইস ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রত্যেক মানুষ যেমন একজন আরেকজনের চেয়ে আলাদা, তেমনি ত্বকের ধরনও ভিন্ন। তাই সর্বোচ্চ সুরক্ষা বজায় রেখে ত্বকের যত্ন নেওয়া চাই।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল