ফিচার I মাংসের পদের দেশভ্রমণ
দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে মাংসের জানা-অজানা নানান পদ। ঈদ উৎসবে যারা ভিন্ন স্বাদে মেতে উঠতে চান, আঞ্চলিক রেসিপি ঠাঁই দিতে পারেন নিজেদের হেঁশেলে। তার আগে জানা চাই কোন অঞ্চল কী ধরনের মাংস রান্নায় প্রসিদ্ধ
মাংসের দারুণ সব রন্ধনশৈলী স্বাদের মহত্ত্বে উৎপত্তিস্থল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। যেমন বগুড়ার মাংস আলু ঘাটি। পদটির কদর এখন শহুরে মানুষদের মধ্যেও। আগে শুধু মাছ দিয়ে তৈরি করা হতো; মাংস যোগ হওয়ার পর এর চাহিদা আরও বেড়েছে।
মাংস আলু ঘাটি রান্নার পদ্ধতি এতই সহজ, বড় কোনো আয়োজনে এ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন বগুড়ার বাসিন্দারা। সেই জেলা থেকে পদটি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উত্তরাঞ্চলে। এটি মূলত শীতকালেই রান্নার চল। ওই ঋতুতে এর স্বাদ ও গন্ধ বেশি খোলতাই হয়। যদিও এখন সারা বছর রান্না হচ্ছে। বেশির ভাগ অঞ্চলে এতে গরুর মাংস যুক্ত করা হলেও কোথাও কোথাও খাসির মাংস দিয়েও হয়। নওগাঁ-বগুড়ার কিছু অঞ্চলে এতে ব্যবহৃত হয় সুঘ্রাণযুক্ত রাঁধুনি পাতা। তাতে স্বাদ ও গন্ধ পায় অন্য মাত্রা।
আমাদের দেশের আরেকটি মাংসল পদের নাম পিঠালি। এটি জামালপুরের পদ। বলা হয় এর ইতিহাস শত বছরের পুরোনো। সাধারণত বিশেষ কোনো দিনে এ খাবার তৈরি করা হয়। এলাকাভেদে একে ম্যান্দা কিংবা মিলি নামেও ডাকা হয়। যে নামেই ডাকা হোক, এ খাবার জামালপুরবাসীর বেশ প্রিয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারও চল্লিশায় তৈরি করা হয় পিঠালি। কয়েক বছর আগেও খাবারটি কলাপাতায় পরিবেশন করা হতো। সেই চল উঠে গেছে। বর্তমানে থালায় করেই অতিথিদের সামনে দেওয়া হয় সুস্বাদু এই পদ। স্থানীয়দের কেউ কেউ শখের বশে নিজেদের বাড়িতে পিঠালি রান্না করেন। শত বছর আগের রেসিপি হলেও ঠিক কবে থেকে এবং কেন এর উদ্ভব ঘটেছিল, তা অজানা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বিচার-সালিসের বৈঠকে এই পদ পরিবেশন করা হতো। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে পিঠালি তৈরির চল ছিল। গরু, খাসি কিংবা মহিষের মাংস দিয়ে তৈরি হয় খাবারটি। রান্না করতে বিভিন্ন ধরনের মসলা ও চালের গুঁড়ার সঙ্গে মাংস মেশানো হয়। এটি ঝাল স্বাদের হওয়ায় অনেকের পছন্দ। জামালপুর ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এই রেসিপির বিস্তার ঘটেছে।
আরেকটি সুস্বাদু পদ হলো সাতকরা দিয়ে মাংস। এটি সিলেট জেলার অন্যতম খাদ্য ঐতিহ্য। অতিথি আপ্যায়নে এ ধরনের পদ রান্না করা হয় বিভিন্ন বাড়িতে। মূলত সাতকরা ও গরুর পায়ের হাড় দিয়ে খাট্টা তৈরি করা হয়। ঝোলজাতীয় এই খাবারের বেশ কদর রয়েছে দেশজুড়ে। অবশ্য মাংস ভুনাতেও দেওয়া হয় সাতকরা। এর ঘ্রাণের জন্য পদটির এত কদর।
এ রকমই আরেকটি পদ খুলনা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী চুইঝালের মাংস। প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আবাদ হয়ে আসছে চুইঝাল। বাংলাদেশের কিছু চাষি স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে অনেক আগে থেকে এর চাষ করে আসছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, যশোর, বাগেরহাটে এর আবাদ হয়। মাংস, বিশেষ করে খাসির মাংসের সঙ্গে চুইঝাল মিশিয়ে রান্না করা হয় এই পদ। কোথাও কোথাও দেওয়া হয় মাছ কিংবা ডালের সঙ্গেও।
মাংস রান্নার পদের বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী একটি পদের নাম দুরুস কুরা। কেউ কেউ একে দম দুরুস নামেও চেনেন। এটি মূলত আস্ত মুরগি দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার। প্রথমে চামড়া ও পশম ছাড়িয়ে মুরগি ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হয়। তারপর ঘন করে মসলাযোগে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয় পদটি। পরিবেশন করা হয় পোলাও অথবা খিচুড়ির সঙ্গে। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে এই পদ রান্নার চল রয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মুরগিকে বলা হয় কুরা। তাই দুরুস কুরা রান্নার মূল উপকরণ মুরগি। এর আঞ্চলিক নাম থেকে খাবারটির এমন নামকরণ।
চট্টগ্রামের আরেকটি মাংসের পদ হালা ভুনো। একে কালা ভুনা নামেই চেনেন অন্য অঞ্চলের মানুষ। প্রচুর মসলাদার একটি পদ। গরু কিংবা খাসি—দুই ধরনের মাংস দিয়ে রান্না করা যায়। অবশ্য গরুর মাংস দিয়ে চল বেশি। প্রচুর মসলা দিয়ে রান্না করার ফলে একপর্যায়ে পদটি কালো হয়ে যায়। তাই এমন নামকরণ।
আরেকটি বহুল প্রচলিত পদ হলো মেজবানি মাংস। এটিও চট্টগ্রামের আইটেম। বিশেষ অনুষ্ঠানে ভিন্ন রেসিপি অনুসরণে রান্না করা হয়। ভীষণ সুস্বাদু। মেজবানি মাংস দুই রকমের হয়। একটি রেজালা। এতে মাখা মাখা ঝোল দিয়ে রান্না করা হয়। অন্যটি ছোলা দিয়ে মাংস। এর চাহিদা এতই তুঙ্গে, চট্টগ্রামে খাবারটির রান্না করা পদ বিক্রি হয় কেজি দরে। বর্তমানে ঢাকার বেশ কিছু হোটেলেও এ ধরনের মেজবানি মাংস রান্না করা হয়। গরম ভাতের সঙ্গে খেতে বেশ লাগে। চট্টগ্রামের মেজবানি মাংসের রেসিপি দেশ ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে লন্ডন ও আমেরিকাতেও।
ময়মনসিংহ জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম কবাক। আগে শুধু ময়মনসিংহের অধিবাসীরা খেতেন। কারণ, ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা ছাড়া এর রেসিপি অন্য জেলার লোকেরা জানতেন না। এখন ধীরে ধীরে অন্য জেলার মানুষও এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছেন। এর স্বাদ এতই উন্নত যে এখানকার রাজকীয় খাবার বলা হয় একে।
কবাক রান্না হয় দেশি মোরগ দিয়ে। চামড়া ও পশম ভালোভাবে ছাড়িয়ে মাখা হয় মসলা। এরপর শিকে গেঁথে পুড়তে দেওয়া হয়। শেষে বেশি করে পেঁয়াজ, মসলা ও শিকে পোড়া মোরগ নিয়ে কোটা হয় ঢেঁকিতে। কোটা শেষে শর্ষের তেল মেখে গরম ভাত কিংবা পিঠার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী কবাক।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের আরেকটি সুস্বাদু পদ মাংসের শুঁটকি। বাড়িতেই গরুর মাংস শুকিয়ে এই খাবার তৈরি করা হয়। এ উদ্দেশ্যে হলুদ ও লবণ মাখানো মাংস লোহার তারে গেঁথে রোদে শুকানো হয়। শেষে বয়ামে ভরে সংরক্ষণ করা হয় সারা বছর। এই মাংস সাধারণত ভর্তা করে খাওয়া হয়। কেউ আবার সারা রাত ভিজিয়ে, নরম করে সাধারণ মাংসের মতো রান্না করে খান। মাংস সংরক্ষণ করে রাখার জন্য এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়।
আহমেদ সজিব
ছবি: সংগ্রহ