পাতে পরিমিতি I ওয়েডিং ডায়েট
বিয়ে আসন্ন? ডায়েট নিয়ে দুশ্চিন্তা? রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আচার-আচরণ প্রভৃতিতে। একসময় আমাদের দেশে ঘরোয়া বিয়ের বেশ প্রচলন ছিল। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন সেই প্রচলনের দেখা মেলা ভার! আজকাল বিয়ে মানেই দারুণ জমকালো আয়োজন। তার মধ্যে রয়েছে মেহেদি, হলুদ, রিসেপশন পার্টি…আরও কত কী! মোটকথা, ওয়েডিং সিরিমনি মানেই বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের সমারোহ। এসব আয়োজনে পারফেক্ট লুক আনতে বর ও কনে—উভয়েরই থাকে নানা প্রচেষ্টা।
সত্যি বলতে, ন্যাচারাল লুকের তো অবশ্যই, এমনকি মেকআপের মাধ্যমেও চেহারার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য গ্ল্যামারাস থাকা প্রয়োজন। তবে শারীরিক বা মানসিকভাবে পারফেক্ট থাকা না গেলে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতেও পারফেক্ট লুক আনা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই ওয়েডিংয়ের প্রতিটি প্রোগ্রামেই গ্ল্যামারাস থাকতে চাইলে বেশ আগে থেকেই এড়িয়ে চলতে হবে কিছু খাবার। কোনগুলো? চলুন, জানি—
ট্রান্সফ্যাট: ভাজাপোড়াজাতীয় ও অতিরিক্ত মসলাদার খাবার সুস্বাদু হলেও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় তা আমাদের শরীরে বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাধারণত অতিরিক্ত তেল দিয়ে তৈরি বাইরের যে খাবারগুলো আমরা গ্রহণ করি, সেগুলোতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেই যায়। কেননা, ভোজ্যতেল একবার ব্যবহারের পর তা বারবার ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় পুড়ে গিয়ে তাতে তৈরি হয় ট্রান্সফ্যাট, যা রক্তে ফ্রি র্যাডিক্যাল তৈরি করে এবং আমাদের সাধারণ সুস্থ জীবনকে করে তোলে অসুস্থ। এই ফ্যাট হার্ট ও লিভারের অসুখের নেপথ্যে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
স্পাইসি ফুড: অতিরিক্ত ঝাল অনেকেরই খুব পছন্দ; অথচ এ ধরনের খাবার অ্যাসিডিটি বাড়াতে কলকাঠি নাড়ে। তাই ওয়েডিংয়ের আগে ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ভালো রাখার জন্য অতিরিক্ত ঝাল মসলাযুক্ত খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া চাই।
সিম্পল সুগার: সাধারণত মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো সিম্পল সুগারের মধ্যে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব কম গ্রহণ করা শ্রেয়। কাঙ্ক্ষিত ওজনের চেয়ে দেহের ওজন বেশি থাকলে ওয়েডিং ড্রেসও খুব একটা মানাবে না। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বন্ধ রেখে আনতে পারেন দারুণ বডি শেপ!
বিয়ের আগে নানাবিধ স্ট্রেসের কারণে অনেকে চোখের নিচে কালো দাগ পড়া, অ্যাকনে বা ব্রণের বাড়াবাড়ি, স্কিন রাফ হয়ে যাওয়া, চুল ঝরাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় পড়েন। এ সময়ে চুল ও ত্বকের যত্নে প্রয়োজন বাড়তি সচেতনতা। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে পান করতে পারেন এই বিশেষ পানীয়: ৫০০ মিলিলিটার পানিতে কিউকাম্বার স্লাইস, মাল্টা স্লাইস, ২ টেবিল চামচ চিয়া সিড, পাঁচ-ছয়টি মিন্ট, দুই ইঞ্চি দারুচিনি ভিজিয়ে রাখতে হবে তিন-চার ঘণ্টা। এরপর খালি পেটে কিংবা সুবিধাজনক সময়ে পান করতে পারেন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টফুল এই ডিটক্স ওয়াটার।
যাদের বিএমআই নরমাল রেঞ্জের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ ওবেসিটি রয়েছে, তারা প্রায়শই একটি ভুল করে থাকেন। তা হলো, ওজন কমানোর কথা ভেবে হুট করে খাবার বন্ধ করে দেন অথবা পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত কম খান, যাকে বলে ক্রাশ ডায়েট। বিয়ের সময় এ ধরনের ডায়েট হতে পারে অসুস্থ হওয়ার অন্যতম কারণ। ওজন কমাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বিয়ের প্রোগ্রামের আনন্দই যে নষ্ট! এ ক্ষেত্রে ফিটনেস ধরে রাখতে মানা চাই কিছু টিপস:
যাদের রাত জাগার অভ্যাস খুব পুরোনো, ওয়েডিংয়ের আগে তাতে একটু পরিবর্তন আনা চাই। রাত জাগলে মেটাবলিক সিস্টেম নষ্ট হয়, ডার্ক সার্কেল পড়ে চোখের নিচে এবং মানসিক প্রশান্তিও কমে আসে যথেষ্ট পরিমাণ রেস্ট না পেলে।
আর্লি মর্নিং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস সব সময়ই ভালো। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করলে প্রভাতের নির্মল বাতাস গ্রহণের সুযোগ মেলে। তাতে ফুসফুস ভালো থাকে। শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালের পরিমাণ কমে যায়। শরীরকে হেলদি রাখতে কাজে দেয়।
সারা বছর যারা ওয়ার্কআউট করেন না, তাদেরও বিয়ের আগে অন্তত এক মাস একটু বিশেষ দেহযতনের অভ্যাস করা চাই। হালকা ব্যায়াম কিংবা মর্নিংওয়াক শরীর সুস্থ এবং মন চাঙা রাখতে অনেক উপকারী। তা ছাড়া বডি শেপিংয়ের জন্যও ওয়ার্কআউট বা হালকা ব্যায়াম বেশ ভালো কাজ করে।
বিয়ের আগে কালারফুল খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় বেশি রাখার চেষ্টা করুন। খেতে পারেন টমেটো স্যুপ। বাসায় এই স্যুপ বানানো খুব বেশি ঝামেলার নয়। চিনি, টেস্টিং সল্ট আর কনফ্লাওয়ার বাদ দিয়ে, শুধু টমেটো পিউরি যোগেই ঝটপট হালকা তেল ও রসুনের সহযোগে তৈরি করা যেতে পারে লাইকোপেন সমৃদ্ধ টমেটো স্যুপ। এ ছাড়া সুগারবিহীন লাল রঙের বিটরুট কিংবা পমেগ্রেনেটের জুস বানিয়ে পান করতে পারেন। স্ট্রবেরি কিংবা মাল্টাও নিতে পারেন জুস বা ফল হিসেবে। এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর।
যেকোনো মানুষের জন্যই ঘুম থেকে উঠে পেট ক্লিয়ার করা স্বাস্থ্যকর। কন্সটিপেশন সমস্যায় যারা ভোগেন, তাদের মুখে অ্যাকনে কিংবা স্কিন রাফের সমস্যাও বেশি থাকে। সে ক্ষেত্রে সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস কুসুম গরম পানি গ্রহণ করতে পারেন। এতে দ্রুত টয়লেটের বেগ আসবে এবং পেট পরিষ্কার হবে।
যেহেতু বিয়ের সময় কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, সে ক্ষেত্রে হেলথ কন্ডিশন ভালো না রাখলে পুরো আয়োজন সম্পন্ন হতে না হতেই দেখা দিতে পারে নানাবিধ শারীরিক সমস্যা। তা ছাড়া নতুন জীবনের শুরুতে সুন্দর দিনগুলো উপভোগ করা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে শুধু শারীরিকভাবে ফিট না থাকার কারণে। তাই এ সময় সুস্থ থাকতে নিয়মিত খাবারদাবার গ্রহণের পাশাপাশি মানসিক চাপ কমানো চাই।
বিয়ে যাদের আসন্ন, এমন বর-কনে বেছে নিতে পারেন এ ধরনের ডায়েট:
ব্রেকফাস্ট: বিয়ের আগে কী খাব, কী খাব না, খেতে ভালো লাগে না ইত্যাদি নানা ধরনের দুশ্চিন্তা যাদের বেশি, তারা অনেক সময় সকালের নাশতা মিস করে ফেলেন। অথচ হালকা হলেও ব্রেকফাস্ট যেন বাদ না পড়ে, খেয়াল রাখা চাই। এ ক্ষেত্রে খেতে পারেন ওটস, টক দই ও কাঠবাদাম দিয়ে বানানো একটি হেলদি ব্রেকফাস্ট।
মিড মর্নিং: গ্রিন আপেল, অ্যাভোকাডো, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি ও পেয়ারা হতে পারে দারুণ মিড মর্নিং স্ন্যাকস।
লাঞ্চ: এ সময়ে যারা ভাত খেতে চান, তাদের জন্য ব্রাউন রাইস হেলদি। যাদের ওজন একটু বেশি, ভারী খাবার বাদ দিতে চান; ভাতের পরিবর্তে তারা গ্রহণ করতে পারেন বাসায় বানানো স্যান্ডউইচ। সেটি তৈরি করে নিতে পারেন ব্রাউন ব্রেড, লেটুস, টমেটো, শসা, চিকেন আর এগ বয়েল দিয়ে। এ ছাড়া ফিশ বা চিকেন কাটলেট দিয়ে ব্রকোলি যোগে স্যালাদও গ্রহণ করতে পারেন এক কাপ ইয়োগার্টসহ।
ইভনিং স্ন্যাকস: মিক্সড নাট কিংবা চিকপি স্যালাদ অথবা ভেজিটেবল ক্লিয়ার স্যুপ হতে পারে হবু বর ও হবু কনের জন্য বিকেলের স্বাস্থ্যকর নাশতা।
ডিনার: ওজন বেশি থাকলে ওয়েট কন্ট্রোলের জন্য হাতে বানানো ব্রাউন রুটি কিংবা ওটস খেতে পারেন। সঙ্গে ফিশ বা চিকেনের একটি আইটেম একটু স্যালাদ যোগে খেয়ে নিলেই হয়ে যাবে ব্যালেন্স ডায়েট।
সুস্থ থাকতে হলে খাদ্যতালিকায় দুধ রাখা একটি হেলদি চয়েস। ইনডাইজেশনের কোনো সমস্যা না থাকলে এক কাপ লো ফ্যাট মিল্ক পান করতে পারেন রাতে ঘুমানোর আগে।
মনে রাখা চাই, যেকোনো কিছুই ইমব্যালেন্স হলে তা পারফেক্ট হয় না। আর পারফেক্ট থাকার জন্য খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলে ব্যালেন্স রাখা জরুরি। তাই বিয়ের আগেই আপনার ডায়েট পারফেক্ট রয়েছে কি না, তা জানার জন্য কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট