ফিচার I দূর অতীতের বিবাহভোজ
কেমন ছিল সুদূর অতীতে এই অঞ্চলের বিয়ের ভোজ? কী কী খাওয়ার চল ছিল তখন? জানা যাক ইতিহাস, পুরাণ ও সাহিত্য ঘেঁটে
নানা মুনির নানা মত। এই যেমন লেখক অতুল সুর তার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ বইয়ে জানাচ্ছেন, বৈদিক যুগে ভারতীয় যেকোনো পদ্ধতির বিয়েতেই বিশেষ কোনো আচার-অনুষ্ঠান হতো না। মানে তখনকার দিনে আজকের মতো খাবারের ধুম পড়ত না। বিয়েতে বাহারি আনুষ্ঠানিকতার চল শুরু অথর্ববেদ ও গৃহসূত্রসমূহের যুগে। তা ছাড়া জাতপাতের কারণে সবার হাতের রান্না সবাই খেত না; তাই বিয়েবাড়িতে খাবারের পসরা বসত না। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলে প্রাচীনকালে বিয়ের খাবার কেমন ছিল, তা জানতে হলে কথা শুরু করতে হবে অথর্ববেদ ও গৃহসূত্রসমূহের যুগের পর থেকে। অবশ্য বিপরীত মতও রয়েছে।
প্রাচীনকালের বিয়ের খাবার কেমন ছিল, তার কিছুটা আঁচ মেলে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ের কিছু অংশে। সেকালে উচ্চকোটির বিয়ের ভোজে ঘি সহযোগে ধূমায়িত ভাত খাওয়ার চল ছিল বলে জানা যায়। সমাজের এই স্তরের মানুষের বিয়ের অনুষ্ঠানে এত বেশি পদের নিরামিষ ও আমিষ পরিবেশন করা হতো, গুনে শেষ করা যেত না! মাছ ও রকমারি মাংসের বসত পসরা।
শ্রীহর্ষ লিখিত ‘নৈষধচরিত’ গ্রন্থে প্রাচীন বিবাহভোজের যেটুকু বর্ণনা মেলে, তা থেকে জানা যায়, বিয়েতে মাছ, হরিণ, ছাগল ও পাখির অসংখ্য পদ থাকত। তার ভাষ্য, খেয়ে শেষ করা তো দূরের কথা, অতিথিরা ডিশের সংখ্যা গুনেও শেষ করতে পারতেন না! সেকালে বাঙালির বিয়েতে হরিণের মাংস ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। ছিল পিঠাপুলির আয়োজনও। সীতার বিয়েতে অতিথিদের মেনুতে ‘পরমান্ন পিষ্টকাদি’র হদিস মেলে।
প্রাচীনকালের বিয়ের খাবারের উপকরণ আসত গৃহস্থের চাষাবাদ থেকেই। নিজেদের খেতের চাল, পুকুরের মাছ এবং জমির সবজি দিয়ে তৈরি হতো নানান পদ। বাইরে থেকে কিছু আনা হতো না।
বেহুলা-লখিন্দরের বিয়েতে নিরামিষের পাশাপাশি আমিষও ছিল প্রচুর। এই বিয়ের নিরামিষের তালিকায় ছিল ঘি কিংবা তেলে ভাজা বেতের কচি ডগা, বারোমাসি বেগুনভাজা, ঘি দিয়ে ভাজা হেলেঞ্চাশাক, তেলে ভাজা পাটশাক, কচি লাউ শাকভাজা, মুগ ডাল, তিলুয়া, ঘিয়ে ভাজা মুগের বড়ি, তিলের বড়া, তিল দিয়ে মিষ্টিকুমড়ো, ঝাল দিয়ে চই, মেটে আলুর তরকারি, পাকা কলার অম্বল বা টক ও আদা দিয়ে রান্না করা শুক্তো। এই শুক্তো অবশ্য বর্তমানের মতো ছিল না। তখন একে ‘তিতো’ বলা হতো। বেগুন, কাঁচা কুমড়া, কাঁচকলা ও মোচাবাটা মসলা কিংবা বেসনের সঙ্গে মেখে রান্না করা। যুক্ত করা হতো হিং, জিরা ও মেথি।
বেহুলার বিয়েতে আরও ছিল মাছের পদের বাড়াবাড়ি। ছিল চিতল, মহাশোল, মাগুর, কই, ছোট চিংড়ি, রুই, পোনা মাছ, কাতল, পাবদা, খলশে, বোয়াল ও ইলিশ। রান্না হয়েছিল চিতলের কোল, ঝাল দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, মহাশোলের অম্বল, কই মাছ ভাজা, রুই মাছের মাথা দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল, পাবদা মাছ দিয়ে শুক্তো, আম দিয়ে কাতল মাছ, আমচুর দিয়ে শোল মাছের পোনা, খলশের অম্বল, বোয়াল মাছের ঝাঁটি, ইলিশ ভাজা ইত্যাদি।
লখিন্দরের জন্য রান্না হয়েছিল হরিণ, খাসি, কবুতর, ভেড়া, কচ্ছপ—এই পাঁচ প্রাণীর মাংস। সে সময় তরকারি রান্না করা হতো তেল ও ঘি দিয়ে। তার জন্য ছিল পিঠাও। চন্দ্রপুলি, দুধ ক্ষীরশা, মনহরা, চন্দ্রকাতি, লাল বড়া, রুটি পিঠা, দুধ চুহির উপস্থিতি ছিল ওই বিয়ের মেনুতে।
লখিন্দরের পাতে প্রথমে তুলে দেওয়া হয়েছিল তেলে ভাজা শাক। পরে শুক্তো এবং ঝাল খাবার। এরপর অম্বল ও পিঠেপুলি। সবশেষে মুখশুদ্ধির জন্য দেওয়া হয়েছিল পানসুপারি। তখনকার দিনে নিরামিষ পদ চাখতে গিয়েই অতিথিদের পেট ভরে যেত। তাই মাংস-মাছ বেশি খেতে পারতেন না কেউই। এটি ছিল সেকালের বিয়েতে কনেপক্ষের চালাকি!
আরেক মতে, ১৮০০ সালের আগে বাংলার হিন্দু বিয়েবাড়িতে রান্না করা খাবারের প্রচলন সেই অর্থে ছিল না। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ যে বাড়িতেই বিয়ে হোক, ব্রাহ্মণ ভোজন ছিল আবশ্যিক। যদিও সেকালে ব্রাহ্মণকে রান্না করে খাবার দেওয়া হতো না। যে পদ্ধতিতে দেওয়া হতো, সেটিকে বলে ‘সিধা’। এই প্রক্রিয়ায় মাটির সরায় কিংবা কাঁসা-তামার পাত্রে আতপ চাল, ডাল, সবজি, চিড়া, ফল, মুড়কি, শর্ষের তেল, বাতাসা ও রান্নার বিভিন্ন মসলা তুলে দেওয়া হতো। ব্রাহ্মণেরা অন্যের হাতের রান্না গ্রহণ করতেন না বলেই এই ব্যবস্থা। অন্যদিকে নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের জন্য বাড়ির নারীদের হাতে রান্না করা খাবার তুলে দেওয়া হতো। সেগুলোর মধ্যে থাকত বিভিন্ন সবজি, বাতাসা ইত্যাদি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরোভাগে বিয়ের প্রধান খাবার হিসেবে থাকত ফলাহার। এর মূল উপকরণ ছিল চিড়া, দই, ঘি, আম, কাঁঠালি, কলা, মণ্ডা, বাতাসা ইত্যাদি। তখন ব্রাহ্মণেরা অন্য জাতের রান্না করা খাবার না খেলেও বিয়ের অনুষ্ঠানে বসেই ফলাহার করতেন। এ সময় কিছু ধনী বাঙালির বাড়ির বিয়েতে নিরামিষ খাবার রান্না শুরু হয়েছিল।
১৮৭০ সাল নাগাদ বাংলায় ময়দার প্রচলন ঘটে। তাতে বদলে যায় বিয়ের খাবারের ধরন। ময়দার লুচির সঙ্গে আলুনি কুমড়ার ছক্কা তুলে দেওয়া শুরু হয় অতিথিদের পাতে। এর কিছু সময় পরে বাংলায় ‘বিলাতি কুমড়া’ নামে একটি সবজির প্রচলন ঘটে। তখন ধনী বাড়ির বিয়েতে ওই কুমড়ার ঘন্ট লুচির সঙ্গে দেওয়ার চল শুরু হয়। ঠিক তখনই বাঁধাকপির প্রচলন শুরু বাঙালির বিয়েতে। ফলে কুমড়ার সঙ্গী হয় বাঁধাকপির ঘন্ট। লুচি পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় কচুরিতে। কলাইয়ের ডালবাটা, আদা ও মৌরি যোগে ময়দার ভেতরে পুর দিয়ে বিয়ের অতিথিদের জন্য তৈরি হতো কচুরি। পরিবেশন করা হতো বড় মাটির সরায়। তাতে আরও থাকত নিমকি, মতিচুর, খাজা, চারকোনা গজা ইত্যাদি। শেষ পাতে দেওয়া হতো দই ও ক্ষীর।
বলা হয়, ১৮৭৩ সালের পর বিয়েবাড়ির মেনুতে জায়গা পায় রসগোল্লা। সঙ্গে দেওয়া হতো তিলকুট ও বিভিন্ন সন্দেশ, যেগুলোর মধ্যে ছিল কামরাঙা সন্দেশ, আম সন্দেশ, কড়া পাঁকের সন্দেশ প্রভৃতি।
ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের পর বিয়েবাড়ির খাবারে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। কুমড়োর ছক্কার জায়গা দখল করে নেয় ছোলার ডাল ও আলুর দম। এই শতকের শেষ দিকে বিয়ের খাবারের তালিকায় যোগ হয় চাটনির সঙ্গে পাঁপর। আর বর্তমানের বিয়ের খাবারের মেনু সম্পর্কে তো কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল!
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট