টেকসহি I বিত্তের বেড়াজালে
যেন চড়া মূল্যের ট্যাগেই আটকে যাচ্ছে সাসটেইনেবল ফ্যাশন চর্চার আকাঙ্ক্ষা। প্রতিকূলতা পেরিয়ে একে উতরানোর উপায় তাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে নানা সেক্টরে। খোঁজ করেছেন সারাহ্ দীনা
এথিক্যাল ওয়্যার, স্লো ফ্যাশন, ইকো ফ্রেন্ডলি, সোশ্যালি রেসপনসিবল—ভারী এই শব্দগুলোর দেখা সাধারণত পাওয়া যায় লাক্সারি ব্র্যান্ডের পোশাকের লেবেলে। অর্থাৎ বিস্তারিত বয়ানে। এ ধরনের পোশাকের প্রধান লক্ষ্য ক্রেতাদের আশ্বস্ত করা, ফ্যাশন বর্জ্য তৈরি করে পরিবেশের ক্ষতি না করার ব্যাপারে। ধরণীর প্রতি মায়াময়, গুণমানে দারুণ এমন পোশাকগুলো দামি পোশাকের কাতারে থেকেছে দীর্ঘ সময়। কয়েকটি কারণে সাসটেইনেবল ফ্যাশন যেন শুধু ধনীদের পোশাক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। কারণের মধ্যে রয়েছে ইকোলজিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালের উচ্চ মূল্য, ব্যয়বহুল উৎপাদনপ্রক্রিয়া, টাইমলেস ডিজাইন, রিসাইকেলিং এবং সার্টিফিকেশন প্রসেস।
সাসটেইনেবল অর্থাৎ টেকসই ফ্যাশনধারার পোশাক তৈরির জন্য কাঁচামাল বাছাই করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় গুণগত মানের ওপর। প্রাকৃতিক অথবা রিসাইকেল করা কাঁচামালই বেছে নেওয়া হয় সবার আগে। ম্যানমেইড র ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয় না এই ক্যাটাগরির পোশাকে। উচ্চমানসম্পন্ন কাঁচামালের দাম তুলনামূলক বেশি। এথিক্যাল সোর্সিং সাসটেইনেবল পোশাকের দাম বেশি হওয়ার এটি একটি কারণ।
ফ্যাব্রিক থেকে পোশাক প্রস্তুত করার প্রতিটি ধাপে নিখুঁত সেলাই, আরামপ্রদ ভাব, ক্লিন কাট, নকশার ছন্দসহ উৎকর্ষ বৃদ্ধির চাহিদার কারণে প্রস্তুতপর্বেও খরচের পরিমাণ কম রাখা সম্ভব হয় না। তুলনামূলক বেশিই পড়ে।
পোশাকের নকশার ক্ষেত্রে চেষ্টা করা হয় টাইমলেস ডিজাইন তৈরির। উদ্দেশ্য, ট্রেন্ডে টিকে থাকা। শুধু চলমান সময়ের জন্য নয়, বরং দীর্ঘ সময়ে ব্যবহার উপযোগী করে তোলাই লক্ষ্য।
সাসটেইনেবল ফ্যাশনের দর্শন পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানকে এগিয়ে রাখে। স্মল ব্যাচ প্রোডাকশন তারই একটি প্রতিফলন। প্রোডাকশন খরচ এখানেও বাড়ে।
রিসাইকেলড ফ্যাব্রিক ব্যবহারের কারণে টেক্সটাইল বর্জ্য ও ব্যবহৃত গার্মেন্টস প্রোডাক্ট পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ব্যয় এখানেও কিছুটা যোগ হয়।
টেকসই ফ্যাশন তত্ত্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য শ্রমিকের যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান। অর্থাৎ ফেয়ার ওয়েজ। কোম্পানিগুলোর এমনতর প্রচেষ্টাও ফ্যাশন আইটেমের বিনিময় মূল্য বাড়াতে ভূমিকা রাখে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ফাস্ট ফ্যাশনের চেয়ে খরচ পড়ে অনেক বেশি। যার কারণে মোট উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
সাসটেইনেবল ফ্যাশন শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, জীবনদর্শন। পরিবেশের প্রতি মমত্ব পরিধানকারীদের উৎসাহিত করে পোশাকের মাধ্যমে পৃথিবীর ক্ষতি না করতে। সৌন্দর্য, স্টাইল, আরামের পাশাপাশি ফ্যাশন বর্জ্য তৈরি না করা, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনা উদ্দেশ্য। এসব দিক রক্ষা করতে গিয়ে সাসটেইনেবল ফ্যাশনে ইকো সার্টিফিকেশন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই সার্টিফিকেশন টেক্সটাইল পণ্যটির স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়। টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় পরিবেশের ইতিবাচকতা বিষয়ে সচেতনতা। এ ধরনের সার্টিফিকেটের মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়ান সার্টিফায়েড অর্গানিক, দ্য বেটার কটন ইনিশিয়েটিভ, ব্লু সাইন, সার্টিফায়েড বি করপোরেশন, এথিক্যাল ক্লদিং অস্ট্রেলিয়া, ফেয়ার ট্রেড, দ্য ফরেস্ট স্ট্রেওয়ার্ডশিপ কাউন্সিল, দ্য গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড, স্ট্যান্ডার্ড ১০০ ওইকেও-টেক্স, ওয়ার্ল্ডওয়াইড রেসপনসিবল অ্যাক্রিডেটেড প্রোডাকশন।
রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েট নামের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, একটি সাধারণ ক্যাটাগরির ইকো ফ্রেন্ডলি সার্টিফিকেটের জন্য অন্তত ৫ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন পড়ে। এমনকি বেভারলি হিলস সার্টিফিকেটের জন্য দিতে হয় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দামের পারদ ঊর্ধ্বগতি হওয়ার কারণে স্বভাবতই এসব লেবেলের ক্রেতাদের বড় অংশ উচ্চবিত্ত। যারা সরল নকশার সৃজনে বোনা পোশাক গায়ে জড়িয়ে নিজের আরাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধরণীকে ভালোবেসে দূষণ প্রতিরোধে সচেষ্ট। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ক্রেতাসামর্থ্য। ধরণী রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েও টেকসই ফ্যাশনতত্ত্বের পোশাক কেনা ও ব্যবহার সবার নাগালের মধ্যে নেই বলা যেতে পারে।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখা যেতে পারে, সব ব্র্যান্ডের পক্ষে উচ্চমূল্য খরচ করে টেস্টিং এবং সার্টিফিকেশন সম্ভব না-ও হতে পারে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া স্বীকৃতি ক্রেতার কাছে প্রকাশ করা জরুরি; কিন্তু আবশ্যক নয়। যদি সার্টিফিকেট গ্রহণ কোনো কারণে সম্ভব না হয়, তাহলে লেবেলটি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ ও আস্থা অর্জনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইট এবং নানাবিধ প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের কাজের প্রতিটি ধাপ প্রকাশ করতে পারে। এথিক্যাল ব্র্যান্ডের গুণাবলি সম্পর্কে জানাতে পারে যথাযথ তথ্য।
ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর পোশাকের মতো সহজলভ্য নয় সাসটেইনেবল ফ্যাশন লেবেলগুলোর পণ্য। সাসটেইনেবল ফ্যাশনের গায়ে চড়া মূল্যের ট্যাগ লাগানো ব্র্যান্ডগুলোর বাইরেও কিছু ব্র্যান্ড রয়েছে, যেগুলো বর্তমান সময়ের ক্রেতাদের ক্রয়মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা চলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘অলওয়েজ অর্গানিক’ ট্যাগের সাসটেইনেবল ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘প্যাক্ট’-এর কথা। এটি যেসব পণ্য তৈরি করে, সেগুলোর দাম অতিরঞ্জিত নয় বলে জানা যায় বেটার ওয়্যার অ্যাপারেল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। প্যাক্ট গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। ফেয়ার ট্রেড ফ্যাক্টরি থেকে পণ্য প্রস্তুত করে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা রাখে, প্যাকেজিংয়ে রিসাইকেলেবল উপাদান ব্যবহার করে। প্যাক্টের লক্ষ্য, ক্রেতাদের শুধু জরুরি পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করা; অর্থনৈতিকভাবে মূল্যমানসম্পন্ন এবং পরিবেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এমন পণ্য বেছে নেওয়া।
একই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্র্যান্ডের তালিকায় রাখা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ‘রিফ অ্যান্ড লজ’কে, যাদের শার্টের দাম শুরু হয় ১৮ ডলার থেকে। কানাডিয়ান সাসটেইনেবল ব্র্যান্ড ‘কটন’-এর প্রধান র ম্যাটেরিয়াল ইজিপশিয়ান কটন। পণ্যমূল্য ১০০ ডলারের কম। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকটিভওয়্যার কোম্পানি ‘আউটডোর ভয়েস’-এর প্রোডাক্ট লাইনও প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে অনুসরণ করে একই নীতি। অর্থাৎ দাম ১০০ ডলারের নিচে। প্রিমিয়াম জিনস ব্র্যান্ড ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড প্র্যাকটিস’। মূল্য শুরু ৪০ থেকে, পৌঁছায় ৮০ ডলার পর্যন্ত। সাইজ ইনক্লুসিভ জিনস তৈরি করে ব্র্যান্ড ‘ওয়ারপ অ্যান্ড ওয়েফট’। এখানেও দাম ১০০ ডলার। লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘বেলা+ক্যানভাস’ একটি বেসিক বেসড ব্র্যান্ড। ৬০ ডলারের কমে পাওয়া যায় পোশাক। অস্ট্রেলিয়ান ব্র্যান্ড ‘থট ক্লদিং’ ৮০ ডলারের কমে সাজিয়েছে পসরা। যুক্তরাজ্যের ব্র্যান্ড ‘প্ল্যানেট ওয়ারিয়র’-এর মূল্যতালিকাও ৮০ ডলারে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
সাসটেইনেবল ফ্যাশনের প্রোডাক্টের গুণাবলির দিকে মনোযোগ দিলে খুঁজে পাওয়া যায় অনেকগুলো ইতিবাচক বিষয়। যেমন এই পোশাকগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগী। কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে বহুদিন ব্যবহার করা সম্ভব। তাই কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এমন ক্লদিং আইটেম বেছে নেওয়া যেতে পারে, যেটি নানাভাবে গায়ে জড়ানো যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ব্লেজার, বেসিক টি-শার্ট, হোয়াইট বাটন ডাউন শার্ট, নিউট্রাল কালার ড্রেস, স্লিম ফিট জিনস। সেকেন্ডহ্যান্ড সাসটেইনেবল পোশাক কেনা যেতে পারে। তাতে প্রোডাক্ট লাইফ বাড়বে। একটু পরিবর্তন অথবা অলংকরণের মাধ্যমে নতুনত্ব নিয়ে আসাই যায় এমন পিসগুলোতে।
পৃথিবী সবার, তাই পরিবেশের প্রতি ইতিবাচক পোশাক সবার জন্য সহজলভ্য হলে বেঁচে থাকা আরও বেশি সুন্দর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মূল্যের অতিরঞ্জন কমিয়ে সার্টিফিকেশন সুলভ করা গেলে প্রকৃতি আরও সুন্দর হবে, আশা করা যায়।
ছবি: ইন্টারনেট