মনোযতন I লাভ ফোবিয়া!
‘ভালো বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো,’ লিখে গেছেন কবি ত্রিদিব দস্তিদার। ভালোবাসার এমন অবাধ আবেগ প্রকাশের উল্টো চিত্রও রয়েছে। কেউ কেউ তো ভালোবাসার কথা ভাবতেই ভয় পান ভীষণ। তাদের জন্য রইল উত্তরণের উপায়। লিখেছেন আশিক মুস্তাফা
প্রকৃতিতে যখন বসন্তের উঁকিঝুঁকি, মানুষের মন তখন আপনাআপনি হয়ে পড়ে উতলা! কোকিলের ডাকে মনের একান্ত গহিন গোপনের সব খেরোখাতা যেন ফিরে পায় নবপ্রাণ। অনেকে ব্যাকুল হয়ে ওঠে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য পেতে। আজকের তারুণ্য ভার্চুয়ালে মগ্ন বলে যে ধোঁয়াশা রয়েছে বড়দের মাঝে, সমাজে; সেই বড় মানুষ আর সমাজও এমন ক্ষণে মনের জানালার গ্রিলে হাত রেখে তারুণ্যের ভালোবাসাবাসি দেখে। একসময় তাদের মনেও জাগ্রত হয় ভালোবাসার বুদ্বুদ। এই ভালোবাসা ফেরি করে বেড়ানো বসন্ত তাই তো আমাদের ঋতুরাজ। এই ঋতুতে শাঁই শাঁই বেড়ে চলে সদ্য জন্ম নেওয়া প্রেমের পরিধিও। বাড়ে আবেগ, মমতা। এই বসন্ত প্রকৃতিতে ঢুকতেই নিয়ে আসে ভালোবাসার অমর বাণী। বিশ্ব তখন আমাদের ভালোবাসায় বুঁদ হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যায়। বসন্ত ভালোবাসা এনে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। তখন তা হয়ে যায় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস! হয়তো কাকতালেই।
১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইনস ডে। দিবসটি ঘিরে যেমন আনন্দের বান বয়ে যায় অনেকের মনে, তেমনি মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো কেউ কেউ ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘরকোণে আশ্রয় নেন। ভালোবাসায় কিংবা প্রেমে পড়ায় তাদের যত ভয়! এই ভয় যাদের মনে দিনের পর দিন আসন গেড়ে বসে, তারা কোনো সম্পর্কেই খুঁজে পান না ইতিবাচকতার ছায়া। তাই তাদের কাছে প্রেম বা ভালোবাসা হয়ে ওঠে পিশাচ কিংবা ডাইনির মতো। দেখলেই যেন আত্মারাম খাঁচা ছাড়া! প্রেমে পড়ে যাওয়ার প্রতি এই যে ভয়, তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ফিলোফোবিয়া।
এমন ভয়ের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে অবশ্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই; একসময় কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভীতির বিস্তার ব্যাপকতায় রূপ নিলে কিংবা দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটালে না ভেবে উপায় কী? কালবিলম্ব না করে হাজির হওয়া চাই মনোচিকিৎসকের সামনে।
সখী, ফিলোফোবিয়া কারে কয়!
উচ্চতাভীতি, পানিভীতি কিংবা আরশোলা-তেলাপোকা থোড়াই কেয়ার করা আপনার গন্ডগোল কেবল প্রেম-ভালোবাসায়? এখানেই যত ভয়? বলি, পৃথিবীতে আপনার মতো অসংখ্য মানুষ ভালোবাসতে ভয় পান। এই ভয় পাওয়াটা যে মানসিক রোগ, তা তো বুঝতেই পারছেন। শুধু তা-ই নয়; এই রোগ আপনাকে ভালোবাসার অভিজ্ঞতা থেকে যেমন দূরে সরিয়ে রাখবে, তেমনি অন্যের ভালোবাসাকে আদিখ্যেতা কিংবা ভাঁড়ামি হিসেবেই আপনার সামনে উপস্থাপন করবে।
ফিলোফোবিয়া শব্দটির গায়ে স্টেথিস্কোপ রাখলে জানা যায়, গ্রিক শব্দ ‘ফিলো’ থেকে এর আবির্ভাব। যার অর্থ ভালোবাসা। আর ‘ফোবিয়া’ মানে যে ভয় বা ভীতি, সে তো কমবেশি সবারই জানা। এককথায় ‘ফিয়ার অব ফলিং ইন লাভ’ বা প্রেমে পড়ার ভয়কেই ফিলোফোবিয়া নামে ডাকে চিকিৎসাবিজ্ঞান।
কেন বাসা বাঁধে মনে
ভালোবাসতে ভয় পাওয়ার পেছনে কলকাঠি নাড়তে পারে অনেক কারণ। কেউ হয়তো ভয় পান নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারার কারণে। কেউ ধর্মীয় বিধিনিষেধের ভুল ব্যাখ্যায়। কেউবা পরিবার কিংবা সমাজ মেনে না নেওয়ার শঙ্কায়। কিন্তু অনেকে হয়তো জানেন না, আরও একধরনের লোক রয়েছেন, যারা এই ভীতির কোনো কারণ খুঁজে পান না। তারাই আসলে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত। সেই ব্যক্তি না জানলেও চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য এর কিছু সম্ভাব্য কারণ হাজির করেছে। যেমন যাদের আগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে কিংবা পরিবারের কোনো সদস্যের রয়েছে প্রেমজনিত তিক্ত অতীত; অথবা নিজে বারবার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন—এমন মানুষদের অন্তরমহলে খুব সহজে হানা দিতে পারে এই মনোরোগ।
চেনার উপায়
ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে কিছু সাধারণ প্রবণতা বা পরিবর্তন ফুটে উঠতে দেখা যায়। যেমন—
ভালোবাসতে ভয় পান, অথচ এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পান না;
ভালোবাসার কথা ভাবতে গেলেই অকারণ অস্থিরতা, এমনকি প্যানিক অনুভব করেন;
কোনো এক অজানা ভয়ে হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত ওঠানামা করে;
শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়;
সব সময় এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়;
বিপরীত লিঙ্গের কারও মুখোমুখি হলে মাত্রাতিরিক্ত ঘামেন;
বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন;
প্রেমের কথা ভাবলেই নার্ভাসনেস ও বমি বমি ভাবে আক্রান্ত হন;
প্রেম ও রোমান্স-সংশ্লিষ্ট স্থান এড়িয়ে চলেন;
খাওয়ায় অরুচিবোধ করেন;
বিপরীত লিঙ্গের কারও সামনে কোনো কাজ করতে অস্বস্তিতে ভোগেন…ইত্যাদি।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি তার এসব শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনকে দমাতে পারেন না। ফলে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখেন। এ কারণে অবশ্য অনেকে এই মনোরোগকে সামাজিক উৎকণ্ঠা ব্যাধির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন; অথচ দুটি আলাদা বিষয়। আপাতদৃষ্টে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কারণ খুঁজে না পেলেও ফিলোফোবিয়ার সঙ্গে শৈশবের ট্রমা এবং অবহেলার নিবিড় সংযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্ষতির খেরোখাতা
ভালোবাসায় জড়াতে অকারণে ভয় পাওয়া নিঃসন্দেহে মানসিক ব্যাধি। গবেষণায় দেখা গেছে, এ রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, যা তাদের পারিবারিক জীবনে খুব খারাপ প্রভাব ফেলে। আর ব্যক্তিটি বিবাহিত হলে দাম্পত্য জীবন পরিণত হয় নরকবাসে! এ ধরনের লোক নিজেকে সোশ্যাল আইসোলেশনে বা সমাজ থেকে আলাদা করে রাখেন; অনেক বেশি ডিপ্রেশনে ভোগেন; মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়েন এবং সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়।
সমাধান সন্ধান
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হকের আহ্বান, ‘আমাদের নিরন্তর চেষ্টা থাকে কিছু ভালো কাজ করার। সুতরাং হতাশা থেকে যেহেতু ভালো কিছু হয় না, তো একে কেন বরণ করা? হতাশা বরং দূরেই থাকুক। নতুন করে ভাবতে শেখার মাঝেই জীবনের মানে লুকিয়ে থাকে। হতাশাকে হটিয়ে, আশা নিয়ে এগিয়ে চলুন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডের দিকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফিলোফোবিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি কোন পথে এগোবে, তা নির্ভর করে রোগের সিভিয়ারিটির ওপর। কগনেটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি এ রোগের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। সিভিয়ারিটির ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় লং টাইম মেডিকেশন বা ওষুধের প্রয়োজন পড়ে। এ ক্ষেত্রে সাইকোলজিস্টরা কম্বিনেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন; অর্থাৎ মেডিকেশন প্লাস থেরাপি। তাই যথাসময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়।’
‘এ রোগে বিবাহিতরাও ভুগতে পারেন। তাদের বলি, নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে উদারচিত্তে ভালোবাসতে শিখুন; এতে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। সর্বোপরি, ভালোবাসাকে ভয় নয়, জয় করুন,’ যোগ করেন তিনি।
বলি, ভয়ের কাঁটা নয়, বরং ফুল ফুটুক আপনার ভালোবাসার বাগানে। এই ফেব্রুয়ারিতেই। কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এই ভালোবাসা দিবসেই! তবে আবেগাপ্লুত হয়ে আবার ভালোবাসার অপব্যবহার করবেন না! মনে রাখা ভালো, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে শুধুই আপনার ভালোবাসার বিশেষ মানুষটির জন্য। গণহারে ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়ার জন্য নয়! চিয়ার্স সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে!
ছবি: ইন্টারনেট