পাতে পরিমিতি I ব্রেকফাস্ট ডায়েট
সকালের নাশতা একেকজনের পছন্দ একেক রকম। এতে আবার কারও কারও অরুচি। অথচ ব্রেকফাস্ট এড়ানো স্বাস্থ্যকর নয়। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
সারা দিন যেমনই কাটুক, দিনের শুরুর আহার অর্থাৎ ব্রেকফাস্ট নিয়ম ও পরিমাণ ঠিক রেখে গ্রহণ করা গেলে দিনভর শরীর চাঙা রাখা সম্ভব। চলতি একটি কথা আছে, সকালের খাবার খেতে হয় রাজার মতো। তার মানে ব্রেকফাস্ট আমাদের জন্য সেই পূর্বপুরুষ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য। বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তা করলেও বর্তমানে সে ধারা বজায় রয়েছে।
স্বাস্থ্যসচেতনতার কথা ভাবতে গিয়ে অনেকে প্রথমে বাদ দিয়ে দেন সকালের নাশতা। সারা দিনে আমরা যে পরিমাণ কাজ করি, তার ভিত্তিতে শরীরে যথেষ্ট ক্যালরি দরকার। ক্যালরি ঠিক রাখতে সারা দিনে অন্তত তিনবার ভারী খাবার এবং তিনবার হালকা নাশতা গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত। অনেকে যেকোনো একটি বেলায় প্রচুর পরিমাণে খাবার গ্রহণ করে ফেলেন, যা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়; বরং স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি।
ব্রেকফাস্ট হিসেবে বিভিন্ন দেশে নানা রকম খাবার গ্রহণের চল রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত শহুরে ব্রেকফাস্ট হয়ে থাকে হাতে বানানো রুটি দিয়ে, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের সকালের নাশতা মানেই গরম ভাত অথবা পিঠা। আজকাল আবার আমেরিকান ব্রেকফাস্ট, ওয়েস্টার্ন ব্রেকফাস্ট, ইন্ডিয়ান ইডলি ইত্যাদিও সকালের নাশতা হিসেবে এ দেশের অনেকে গ্রহণ করেন।
স্বাস্থ্যসম্মত ব্রেকফাস্ট মানেই কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস আর ফাইবারসমৃদ্ধ ডায়েট। এ রকম হেলদি ডায়েট বিভিন্নভাবে তৈরি করা সম্ভব। কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে ব্রেকফাস্ট কখনো কখনো বাড়তি সময় ও কাজের চাপ হয়ে ধরা দেয়। তাদের ঝটপট হেলদি ব্রেকফাস্ট মেনু হতে পারে এমন:
এগ-ওটস খিচুড়ি: টমেটো, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি ভালোভাবে রান্না করতে খুব একটা সময় লাগে না। তাই যারা ঝটপট একটু ডিফারেন্ট অথচ হেলদি ব্রেকফাস্ট গ্রহণ করতে চান, বেছে নিতে পারেন বিশেষ এগ-ওটস খিচুড়ি। গরম পানিতে দুই টেবিল চামচ ওটস নিয়ে এক কাপ পানিতে টমেটোকুচি, ক্যাপসিকামকুচি, সেদ্ধ ব্রকলি আর অলিভ অয়েল দিয়ে তিন থেকে চার মিনিটেই তৈরি সম্ভব এই রেসিপি। রান্নার পর পাত্রে ঢেলে একটি ডিমের সাদা অংশ, প্রয়োজনে ফুল বয়েলড এগ চপ করে নিলেই দারুণ সুস্বাদু ও নিউট্রিশনে ভরপুর ব্রেকফাস্ট হাজির।
সকালের নাশতায় অনেকে যে ভুল করে থাকেন, তা হলো হেলদি থাকার কথা ভেবে রুটি, ভাত, ওটস ইত্যাদি খাবার বাদ দিয়ে চা-বিস্কুট বা কুকিজ গ্রহণ। অথচ এর ফলে পরবর্তীকালে শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি অ্যাসিডিটিতে ভোগার শঙ্কা বাড়ে।
ডায়েট মেইনটেইন শুরু করলে অনেকে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। কারও কারও অভ্যাস থাকে ব্রেকফাস্টে চা কিংবা কফি গ্রহণের। অনেক সময় শুধু চা-কফি দিয়েই দিনের প্রথম আহার পর্ব সেরে নেওয়ার প্রবণতাও থাকে কারও কারও। অথচ ব্রেকফাস্টে বিকল্প হিসেবেই শুধু নয়, বরং ব্রেকফাস্টের সঙ্গেও চা-কফি কিংবা যেকোনো ক্যাফেইন গ্রহণ অস্বাস্থ্যকর। সকালে চা-কফি গ্রহণ না করলে সারা দিন যাদের শরীর ম্যাজম্যাজ করে, তাদের অবশ্যই ফুল ব্রেকফাস্টের ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট পর এ ধরনের পানীয় গ্রহণ করা শ্রেয়। কেননা সকালে নাশতার সঙ্গে গ্রহণ করা প্রোটিনের বদৌলতে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সঠিক থাকে; অথচ এই পানীয় সেটির ভারসাম্য নষ্ট করে আয়রনের ডেফিসিয়েন্সি ঘটাতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।
ব্রেকফাস্ট হিসেবে ব্রেড অনেকের পছন্দ। তবু যাদের ওজন বেশি, তারা অনেক সময় এই প্রিয় খাবার গ্রহণ বন্ধ করতে বাধ্য হন। সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বন্ধ না করে হোয়াইটের পরিবর্তে বেছে নিতে পারেন ব্রাউন অথবা ওটসের ব্রেড। তা অল্প পিনাট বাটার আর এগ স্ক্রামবেল ও টমেটো সøাইস দিয়ে সহজে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর করে তোলা সম্ভব। এটি লো ক্যালরির যথেষ্ট হেলদি একটি ব্রেকফাস্ট আইটেম।
পাশ্চাত্যে অনেকের ব্রেকফাস্টের সঙ্গে সঙ্গে অরেঞ্জ কিংবা যেকোনো জুসের কোনো আইটেম গ্রহণের অভ্যাস রয়েছে; যদিও এ ধরনের প্রচলন আমাদের দেশে বেশ কম। সে ক্ষেত্রে ব্রেকফাস্টের অন্যান্য আইটেম পরিবর্তনের পাশাপাশি জুসের একটি আইটেম যোগ করে নিতে পারেন। বেছে নিতে পারেন এ ধরনের লাইট ড্রিংস:
চিয়াসিড-মালটা স্লাইস, ইসবগুল-ওয়াটার মেলন, তোকমাদানা-যেকোনো বেরি, মিন্ট-লেমন জুস মিশ্রিত এক গ্লাস রিফ্রেশিং ড্রিংস নেওয়া যেতে পারে সকালের নাশতার সঙ্গে; যা প্রোটিন, ফাইবারসহ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের দারুণ উৎস। তা ছাড়া খেতে পারেন ডাবের শাঁস। সকালে কোকোনাট ওয়াটারও বেশ রিফ্রেশিং ড্রিংস।
ডায়েটে ব্রেকফাস্ট সঠিক হওয়া সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক অবস্থা যেমনই হোক, ব্রেকফাস্ট মিস করা ভালো কথা নয়। শারীরিক বিভিন্ন অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ব্রেকফাস্ট ডায়েট ঠিক রাখতে যা করা চাই:
আজকাল ডায়াবেটিস খুব পরিচিত শারীরিক জটিলতা। ওজন বাড়লে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। একজন ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ব্রেকফাস্ট ডায়েট কখনোই কম গ্রহণ করা ঠিক নয়। ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণের পাশাপাশি তার ডায়েটারি মডিফিকেশন যদি সঠিক না থাকে, তাহলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টসাধ্য। সে ক্ষেত্রে সকালের নাশতা সঠিক হওয়ার জন্য গ্রহণ করতে পারেন এ ধরনের লাইট ব্রেকফাস্ট: পাতলা রুটি দুটি, সবজি এক কাপ এবং সেদ্ধ ডিম একটি।
থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত যারা, অনেকাংশে স্থূলতা বা ওবেসিটিতে ভোগেন। তবে ওজন কমানোর জন্য কখনোই ব্রেকফাস্ট স্কিপ করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। তারা পাতে নিতে পারেন কমপ্লেক্স কার্বোহাইডেট। এ ক্ষেত্রে ওটস বা লাল আটার রুটি অন্তত একটি যেন ব্রেকফাস্টে থাকে, তা নিশ্চিত করা চাই।
আন্ডারওয়েট বা কম ওজন শুধু গ্ল্যামার নয়, স্ট্যামিনাও কমিয়ে দেয়। যারা ওজন বাড়াতে চান, অনেক সময় ব্রেকফাস্ট অবহেলা করেন তারাও। যেহেতু তাদের সাধারণত খাওয়ার রুচি বেশ কম থাকে, তাই অন্যান্য সময়ে কিছুটা খাবার গ্রহণ করার ইচ্ছা থাকলেও ব্রেকফাস্ট যেন বাদ দিতে পারলেই বাঁচেন! অথচ এই পরিস্থিতিতে সকালের নাশতা হওয়া চাই বাড়তি ক্যালরিসমৃদ্ধ। ব্রেকফাস্ট ডায়েটে ক্যালরি বাড়াতে তেল বা ঘিয়ের ব্যবহার রাখা আবশ্যক। এ ছাড়া পাতে রাখতে পারেন ডেজার্ট।
ওয়ার্ম ওয়াটার কমবেশি সবার জন্য ভালো এবং ডায়েট হিসেবে এর সঙ্গে লেমন বা ইসবগুল, এমনকি চিয়াসিড মিক্স করে নিলে দিনের শুরুটা হবে চমৎকার।
প্রত্যেক মানুষের ক্যালরি চাহিদা ভিন্ন। শারীরিক অবস্থা, ওজন, বয়স, লিঙ্গ, পেশা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিভেদে ডায়েট মডিফিকেশন করা হয়ে থাকে। আর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন পেতে হলে ডায়েট ও লাইফস্টাইল সঠিক রাখা জরুরি। তা ছাড়া শারীরিক কোনো রোগ বা কো-মরবিডিটিস থাকলে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অবশ্যই নিউট্রিশন ম্যানেজমেন্ট করে নেওয়া চাই।
মোটকথা, আমরা ডায়েট হিসেবে যতই প্ল্যান করি না কেন, সেটি সঠিক উপায়ে করা না গেলে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে, সকালটা যদি সুন্দরভাবে শুরু করা যায়, তাহলে সারা দিনের সুস্থতা রক্ষায় তা যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে আপনার ব্রেকফাস্ট ডায়েট কেমন হওয়া চাই, জানতে প্রয়োজনে কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট