skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I আক্রান্তে আলোকবর্তিকা!

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের অন্ধকার যখন জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, বাঘা বাঘা ব্র্যান্ড কি শুধু ফ্যাশন শো কেসিংয়েই ব্যস্ত? নাকি সংকটের সন্ধিক্ষণে দায় না এড়িয়ে দিচ্ছে দায়িত্বশীলতার পরিচয়। তারই সন্ধানে সারাহ্ দীনা

একটি দেশে যখন যুদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটে, তখন তা স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমস্যা এগিয়ে। যার দরুন বিশ্ববাজারেও দেশটির উপস্থিতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। অর্থনীতির সঙ্গে ফ্যাশনশিল্প গভীরভাবে জড়িত হওয়ায় প্রায়শই এ সেক্টর যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ইতিহাস সাক্ষী রেখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য অর্থসাহায্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যুদ্ধের ফলে সেখানকার ব্যাংক ব্যবস্থা, শেয়ারবাজার ধসে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। ফলাফল—অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। এমন সময়ে আর্থিক সাহায্য দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। নিকটবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ফ্যাশন ব্র্যান্ড এলভিএমএইচ ৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসকে, যাতে তারা যুদ্ধ-আক্রান্ত দেশের জনগণকে সাহায্য করতে পারে। রিলিফ অর্গানাইজেশন কেয়ার এবং ইউএন রিফিউজি এজেন্সিকে ব্র্যান্ড শ্যানেল ২ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডোনেট করে। ইউনিসেফকে লুই ভিতোঁ ১ দশমিক শূন্য ৯ মিলিয়ন ডলার দেয় যুদ্ধে আক্রান্ত শিশু এবং তাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য। এই তালিকায় আরও নাম আছে ইতালিয়ান লাক্সারি ব্র্যান্ড আরমানি, স্প্যানিশ ব্র্যান্ড ম্যাংগো-এর। লাক্সারি পাওয়ার হাউস লুই ভিতোঁ এ সময়ে আরও ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পৌঁছে দেয় ইউনিসেফের তহবিলে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি ব্র্যান্ড এরমেস, বারবারি ও অ্যাকুয়াসেক্টাম তাদের শ্রমিকদের কারখানা ব্যবহার করে মিলিটারি ইউনিফর্ম তৈরির কাজ করেছিল। ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়েছিল যুদ্ধের জন্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য থেকে। সে সময় আটলান্টিকের তীরজুড়ে উত্থান হয় হাইএন্ড ডিজাইনার লেবেল ইন্ডাস্ট্রির। এর মধ্যে শ্যানেল অন্যতম। তালিকায় আরও আছে ভিয়নেট এবং চার্লস ওরথ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যুক্তরাজ্যে কাপড়ের আমদানি কমে এলে প্রভাব পড়ে মূল্যমানে। দাম অসহনীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। বন্ধ হতে থাকে ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলো। অথচ তার আগপর্যন্ত জার্মানি ছিল বিশ্ব ফ্যাশনের অন্যতম জোগানদাতা। ফ্যাশন ক্রাইসিসের সে সময়ে তারা পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের চাপে ফেলে বাণিজ্য বন্ধে বাধ্য করে। যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির সব ডিজাইনার মিলে সেই কঠিন সময়ে গঠন করেন ‘ইনকরপোরেটেড সোসাইটি অব লন্ডন ফ্যাশন ডিজাইনারস’।
ইউরোপের ফ্যাশন ডিজাইনাররা আবারও সৈন্যদের জন্য পোশাক তৈরির কাজে লেগে পড়েন। বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল তার ফ্রান্সের বাড়িতে নিজ হাতে বানিয়ে দেন ফৌজিদের পুলওভার। ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার এলসা স্কিয়াপারেল্লি তৈরি করেছিলেন ‘সাইরেন স্যুট’। এটি ছিল নারীদের জন্য নকশা করা একধরনের জাম্প স্যুট, যার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল একটি গ্যাস মাস্ক, ফ্লাস্ক ও হুড। উদ্দেশ্য—বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা। কারণ, তখন যেকোনো সময়, এমনকি মধ্যরাতেও ‘এয়ার রেইড’ অর্থাৎ, আকাশপথে হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কিত থাকতেন সাধারণ মানুষ। ২০১১ সালে জার্মানির সবচেয়ে বড় ফ্যাশন কোম্পানি হুগো বস এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর জন্য পোশাক তৈরি করেছিল এই ব্র্যান্ড। আর তাতে তারা শ্রম দিতে বাধ্য করেছিল নাৎসি কারাবাসীদের।
আমেরিকা-আফগানিস্তানের সংঘাত চলেছে প্রায় দুই দশক ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। ব্রিটিশ লাক্সারি ব্র্যান্ড এ সময়কালে অক্সফাম এনজিওর সঙ্গে কাজ করেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের সাধারণ বসবাসকারীদের সাহায্য করার জন্য।
রাশিয়া-ইউক্রেন
এই দুটি দেশের সম্পর্ক দীর্ঘ সময় ধরে আক্রমণাত্মক ছিল। হঠাৎ করে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় সরাসরি সংঘাত। এর দুদিন আগে শুরু হওয়া মিলান ফ্যাশনউইক তখন চলমান। ওই সংঘাত থমকে দেয় ফ্যাশন বিশ্বকে। বিখ্যাত ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানি তাই তার আয়োজনের শুরুতে মডেলদের নীরব থাকার নির্দেশনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
লাক্সারি ফ্যাশন কংলোমোটর এলভিএমএইচ, প্রাডা, এরমেস, এইচ অ্যান্ড এম ঘোষণা দেয়, যুদ্ধ চলাকালে সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কিছু ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নিয়মিত বেতন পাবেন তাদের কর্মীরা। যেমন এলভিএমএইচ রাশিয়ায় তাদের ১২৪টি শোরুম বন্ধ করে দেয় সংঘাত চলাকালে। তবে সুখবর হচ্ছে, তাদের ৩ হাজার ৫০০ কর্মী এখনো নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন।
চলমান এই সংঘাতের কারণে রাশিয়ার ফ্যাশন-সচেতন নাগরিকেরা আন্তর্জাতিক লাক্সারি ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ফ্যাশন লেবেলগুলোর এমন সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে পিছিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে বিশ্ব ফ্যাশন বাজারের মূল্য ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। অর্থাৎ কলেবর বেড়েছে। এমন শিল্পক্ষেত্র থেকে দূরে সরে থাকতে হলে যেকোনো দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
অপরদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় ফ্যাশন সেক্টরের জায়ান্ট কোম্পানিগুলো পাশে দাঁড়িয়েছে। ভ্যালেন্তিনো, প্রাডা, শ্যানেল, লুই ভিতোঁ, ভারসাচি, ব্যালেন্সিয়াগা ও গুচি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। তৈরি করেছে যুদ্ধকালীন ফান্ড। উদ্দেশ্য, ইউক্রেনের রিফিউজিদের সাহায্য করা।
জার্মান ডেটা হাউস স্ট্যাটিস্টার মতে, ২০২৪ সালে ইউক্রেনের ফ্যাশন মার্কেট ২৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলারে পৌঁছে যাবে, যা গত বছর ছিল ২৩২ দশমিক ৬১ ডলার। আশা করা হচ্ছে, এই বাজারের বার্ষিক বৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছে গোটা বিশ্ব। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আতঙ্কিত করেছে সবাইকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে প্রতিবাদ। এই ইস্যুতে ফ্যাশন বিশ্বের কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যায়, বহুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড শ্যানেল দক্ষিণ ইসরায়েলকে ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে। যুদ্ধের বিষয়ে মানুষকে জানাতে আমেরিকান ব্র্যান্ড ঈগল ২০২৩ সালের অক্টোবরে আমেরিকার টাইমস স্কয়ারের বিলবোর্ডে ইসরায়েলের পতাকা প্রদর্শন করেছে।
ফ্যাশন আর যুদ্ধের ইতিহাসে জানা যায়, ইতালিয়ান ডিজাইনার এলসা স্কিয়াপারেল্লি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বলেছিলেন, ‘কঠিন সময়ে ফ্যাশন আপত্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।’ এত বছর পরে এখনো সময়োপযোগী এলসার এই কথা। কারণ, ফ্যাশন একটি শিল্প। এর মাধ্যমে বিবৃতি দেওয়া সম্ভব; যা রাজনৈতিক উক্তি, মতামত, প্রতিবাদের ভাষা কিংবা সাহায্য প্রার্থনার মতো শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধের সময় নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বর্জনের পাশাপাশি কোন কোন ব্র্যান্ডকে সাহায্য করলে আক্রান্ত দেশের জন্য উপকার হবে, সে বিষয়েও চিন্তা করা যেতে পারে। সশস্ত্র লড়াই কিংবা স্নায়বিক যুদ্ধ—উভয় ক্ষেত্রেই মানবতার নিদর্শন জরুরি। ফ্যাশন যদি সেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে এই সেক্টরে বিনিয়োগ গুরুত্ব পাবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top