রম্যরস I বউ
-সুমন্ত আসলাম
দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে অনেকক্ষণ। ঘড়ির দিকে তাকালাম—সকাল ৭টা ৪০ মিনিট। এত সকালে আবার কে এলো বাসায়! বউ কলেজে গেছে পড়াতে, মেয়ে স্কুলে গেছে পড়তে। অগত্যা বিছানা ছাড়তে হলো আমাকেই। দরজা খুলে দেখি—নিয়াজ দাঁড়িয়ে, ও আমার বন্ধু। রাগটা বেড়ে গেল দ্রুত। মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করেছি, অন্তত দশটা পর্যন্ত ঘুমানো দরকার। আর ও এত সকালে এসে উপস্থিত!
‘সমস্যা কী?’ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করি ওকে, ‘আজও বউ মেরেছে নাকি?’
‘মারে নাই, তবে মারার মতো।’
মনটা কাতর হয়ে গেল আমার। বউ কখনো ওকে মারেনি, তবে মারার পর্যায়ে গেছে অনেকবার। তারপর প্রতিবার ও আমার বাসায় এসে ধপাস করে বসে থেকেছে সোফায়। ঘণ্টাখানেক কথা বলে, দু কাপ ঘন দুধের চা খাইয়ে, মোটিভেশনাল আরও কিছু কথা বলে ঠান্ডা করেছি ওকে।
দরজা থেকে সরে দাঁড়াই আমি। ভেতরে ঢোকে ও। যথারীতি সোফায় বসে। পাশে আমি, ‘বল, আজকের ঘটনা কী?’
‘তারাপদ রায় পড়েছিস তো?’
‘পড়েছি।’ ভাবলেশহীন উত্তর দিই আমি।
‘তিনি একটা জায়গায় লিখেছেন—খুবই হিসেবি মানুষ ছিলেন আমার এক কাকা। শেভ করতেন, কিন্তু শেভিং ব্রাশটা ধুয়ে রাখতেন না, সাবানসুদ্ধ ওভাবেই রেখে দিতেন। খাওয়া-দাওয়া করার পর হাতের তেল ছাড়ানোর জন্য সেই শেভিং ব্রাশটা হাতে নিতেন, তারপর ইচ্ছেমতো কচলে নিতেন হাতটা।’
‘সাবানের যথাযথ ব্যবহারের একটা উপায় বের করে দিয়েছেন তারাপদ রায়।’
‘উনি জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, ওনার কাকাও জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আমাদের উচিত জ্ঞানী মানুষের পথ অনুসরণ করা।’ নিয়াজ দুহাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘একে তো রমজান মাস, তার উপর জিনিসপত্রের দাম বেশি। হঠাৎ করে খেয়াল করি—সাবানের খরচও বেড়ে গেছে বেশ। সকালে তাই শেভ করে শেভিং ব্রাশটা রেখে দিয়েছি, একটু পর ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি ব্রাশটা ধোয়া। মেজাজ ঠিক থাকে বল?’
‘ধুয়ে ফেলেছেন কে? ভাবি?’
‘সে ছাড়া আর কে?’ নিয়াজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘রোজায় চিনির খরচও বেড়ে গেছে। কিন্তু বউকে তো সরাসরি বলা যায় না, তাই তাকে গোপাল ভাঁড়ের একটা গল্প শোনালাম—রাজসভা থেকে একদিন বিরক্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন গোপাল ভাঁড়। মেজাজ খারাপ। বউ দৌড়ে এসে বলল, “জানো, বাড়িতে আজ পিসি এসেছিল।” কথা বলতে বলতে গোপাল এটাও জানতে পারলেন—ওই পিসিকে একটা মিষ্টিও খাইয়েছে তার বউ। গোপাল বেশ রেগে গিয়ে বললেন, “কী, মিষ্টি খাইয়েছো তুমি তাকে!” মিষ্টির কথা শুনে মিষ্টি একটা হাসি দিলেন গোপালের বউ, “পাগল! পিসিকে মিষ্টি খাওয়াবো আমি! আমি তো কেবল আঙুলগুলো মিষ্টির মতো গোল করে হাত দেখিয়েছি তাকে।” গোপাল আগের চেয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “হাত গোল করেছো ভালো কথা, কিন্তু অতো বড় মিষ্টির আকৃতি দেখিয়েছ কেন অ্যা, ছোট করে দেখাতে পারোনি! মিতব্যয়ী হও, রোজগার করতে আমার যে কত কষ্ট হয়, সেটা তো আর জানো না!”’
‘এটা শুনে তোর বউ কী বললেন?’
‘কিছুই না। পরের দিন ইফতারিতে দেখি ৭-৮ রকমের শরবত বানিয়েছে, সেসবের আবার ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়েছে। পুরো ২ কেজি চিনি শেষ; সঙ্গে কমলা, আনার, তরমুজ, আঙুরও হাওয়া।’ নিয়াজ কুঁই-কুঁই করে বলল, ‘মানুষ বাড়ি-গাড়ি করার জন্য লোন নেয়, আমার তো মনে হচ্ছে সংসারের বাজার সদাই করতেই লোন করতে হবে।’ নিয়াজ শব্দ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমি আমার বউকে মিতব্যয়িতা শেখাতে পারলাম না।’
‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সেলিব্রিটি মিতব্যয়ী বলেন কেউ কেউ। জানিস তো?’
‘কেন?’
‘তাদের যুক্তি হচ্ছে—সামান্য কালি খরচের ভয়ে তিনি ভ্রু আঁকেননি মোনালিসার! আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে এখন অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়। এদেরকেও বেশ মিতব্যয়ী বলেন অনেকে। কারণ, টাকা আর সময় বাঁচানোর জন্য পাঁচ দিনের ক্রিকেট ম্যাচ আড়াই দিনেই শেষ করে ফেলেন তারা নির্দ্বিধায়! তবে বেদনাদায়ক মিতব্যয়ী হচ্ছেন আমাদের দেশের কিছু মানুষ, যারা একটি ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখেন এবং সেখানে কাপড় শুকাতে দেন মহা আনন্দে।’ নিয়াজের মন হালকা করার জন্য কথাগুলো বলি আমি।
মন কিছুটা হালকা হলো কি না নিয়াজের, বোঝা গেল না। ধুম মেরে বসে আছে ও সোফায়। কিছুক্ষণ পর মেরুদণ্ড সোজা করে বলল, ‘যাযাবর ওরফে বিনয় মুখোপাধ্যয় তার ‘দৃষ্টিপাত’-এ অবশ্য অন্য একটা কথা লিখেছেন—এ জগতে নিঃসম্বল দরিদ্রের আছে মহত্ত্ব, অমিতব্যয়ী ধনীর আছে ঔদার্য, ব্যয়কুণ্ঠ বিত্তবানের নেই কোনোটাই।’
‘ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল?’ নিয়াজের দিকে ঘুরে বসি আমি।
‘যত কিছুই বলিস না কেন, যা সময় পড়েছে, আমাদের আসলে হিসেব করে চলার সময় এখন।’ সোফায় হেলান দেয় এবার নিয়াজ, ‘হিসেবের দিক দিয়ে বিখ্যাত রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী অবশ্য সবার আগে রেখেছেন অফিসের হারাধন বাবুকে।’
‘লেখাটা পড়িনি আমি।’
‘অফিসের বড় সাহেবের নাম নিখিল চন্দ্র, খরচ করতে ভালোবাসেন খুব। কয়দিন যেতে না যেতেই তাই টানাটানি শুরু হয়ে যায় তার। হাত পাতেন তারই অধীনস্থ অফিসের প্রধান সুপারভাইজার হারাধন বাবুর কাছে। অথচ এই বড় সাহেব প্রতি মাসে তিন গুণ বেশি বেতন পান তার চেয়ে। বড় সাহেব একদিন ভাবলেন—প্রতি মাসে আমি এত টাকা উপার্জন করি, আর হারাধন বাবু পান আমার চেয়ে অনেক কম, সারা মাস সংসার চালিয়ে তারপরও টাকা ধার দেওয়ার ক্ষমতা তিনি পান কোথায়? হাতের অবস্থা খুবই টানাটানি একদিন বড় সাহেবের। মাসের শেষ দিক। চলে গেলেন তিনি হারাধন বাবুর বাড়ি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তখন। বেশ অন্ধকার। কোথাও আলো-টালো জ্বলছে না বাড়ির। দরজায় কড়া নাড়লেন বড় সাহেব। দুবার নাড়ার পর টিমটিমে একটা আলো জ্বলে উঠল বাড়ির ভেতর। একটু পর হারাধন বাবু নিজেই দরজা খুললেন—খালি গা, পরনে গামছা তার। বড় সাহেব তার প্রয়োজনের কথা বলতেই বাড়ির ভেতর থেকে টাকাটা নিয়ে এলেন হারাধন বাবু। টাকা হাতে নিয়েই তৎক্ষণাৎ চলে আসতে সংকোচ হচ্ছিল বড় সাহেবের। তিনি তাই এটা-ওটা বলতে লাগলেন হারাধন বাবুর সঙ্গে। বড় সাহেবের অনাহূত অপেক্ষা করা দেখে হারাধন বাবু শরমিন্দা মুখে বললেন, “স্যার কি আরও কিছু বলবেন আমাকে?” বড় সাহেব বিব্রত বোধ করলেন, “না না, এই একটু খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আরকি। কোনো সমস্যা?” “না, সমস্যা-টমস্যা না। আপনি যদি আরও একটু থাকেনই, তাহলে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিতাম, আর পরনের গামছাটাও খুলে ফেলতাম। অযথা এই অপব্যয় করি কেন বলুন তো!” উত্তর দিলেন হারাধন বাবু।’
হাসতে হাসতে নিয়াজকে আমি বললাম, ‘আমি হলে গল্পটা এভাবে শেষ করতাম—ঘরের বাতি নিভিয়ে, পরনের গামছাটা খুলে ফেলে, হারাধন বাবু আরও একটু এগিয়ে গেলেন বড় সাহেবের দিকে। অন্ধকারেই আলতো করে তার একটা হাত ছুঁয়ে বললেন, “স্যার, দেশের চারদিকে কেবল অভাব আর অভাব চলছে এখন! অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো না। আমাদের সবাইকে এখন মিতব্যয়ী হতে হবে, সাশ্রয়ী হতে হবে। অযথা খরচ-টরচ করা যাবে না। ইয়ে—।” খুক করে একটু কেশে নিয়ে হারাধন বাবু বলবেন, “তাই এই অন্ধকারে আর গায়ে কাপড়-চোপড় রেখে কাপড়-চোপড়ের আয়ু কমিয়ে লাভ কী স্যার, আপনিও খুলে ফেলুন না!”’
২
দু সপ্তাহ পর নিয়াজ বাসায় এসে হাজির আবার। খুবই বিমর্ষ চেহারা ওর। যথারীতি সোফায় বসে ঝিমাতে লাগল একা একা। বুয়াকে চা দিতে বলি ওকে। হাতের কাজ সেরে ওর পাশে এসে দেখি, চা কাপেই রয়েছে, একটা মাছি ঘুরঘুর করছে কাপের আশপাশে।
‘চা খাসনি কেন?’ নিয়াজের পাশে বসি আমি।
‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আজ কী সমস্যা, বল।’
‘কয়দিন ধরে বউ ঘ্যানর ঘ্যানর করছিল।’
‘কী নিয়ে?’
‘কৃত্রিম বুদ্ধির একটা পুতুল কিনবে ও।’
‘ওটা দিয়ে কী করবেন ভাবি?’
‘বাসায় একটা কাজের মেয়ে আছে, তাকে নিয়ে নানান সমস্যা—আজ থাকে তো কাল থাকে না। কয়দিন পরপর বলে—“চলে যাব, ভালো লাগে না।” আমিও বিরক্ত। কৃত্রিম বুদ্ধির পুতুল দিয়ে তো আজকাল অনেকেই অনেক কিছু করছে, করাচ্ছে—অফিসের কাজ চালাচ্ছে, টিভিতে খবর পড়াচ্ছে, গবেষণার কাজেও নিয়োগ দিচ্ছে। একেকজন একেক কাজে ব্যবহার করছে।’
‘ভাবি কি ঘরের কাজের জন্য ওরকম একটা পুতুল কিনতে চাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, অলরেডি কিনেও দিয়েছিলাম।’
‘তো, সমস্যা কোথায়?’
‘একটা পুরুষ পুতুল কিনেছিলাম আমি।’
‘পুরুষ কেন!’
‘ঘরে-বাইরের সব কাজ যেন করানো যায়, সে জন্য। তা ছাড়া ঘরে একটা মেয়ে কাজের মানুষ আছে, একটা পুরুষ কাজের মানুষ থাকলে মিলেমিশে সবকিছু করতে পারবে বলে বউ ধারণা করেছিল।’ নিয়াজ একটু থেমে বলল, ‘মেয়ে পুতুল কিনতে না চাওয়ার আরও একটা কারণ অবশ্য ছিল; বউ অবশ্য কিছু বলেনি আমাকে, আমি বুঝে নিয়েছি। সংসার মানেই তো সন্দেহ, জানিস তো!’
‘তো ওই পুরুষ পুতুলটার অবস্থা এখন কেমন?’
‘গত রাতে ও পালিয়েছে।’
‘পালিয়েছে!’
‘ও একা পালায়নি, আমাদের কাজের মেয়েটাকে সাথে নিয়ে পালিয়েছে।’
‘বলিস কী?’
‘বলা এখনো শেষ হয়নি আমার।’ চেহারা আরও বিমর্ষ করে নিয়াজ বলল, ‘বউ আরেকটা পুতুল কিনতে চাচ্ছে।’
‘কিনে দে।’
‘পুরুষ পুতুল কিনতে চায় ও।’
‘ঘরে তো আর কোনো মেয়ে কাজের মানুষ নেই, পুরুষই কিনে দে।’
‘কিন্তু ভয় হচ্ছে।’
‘কিসের ভয়?’
‘বউ তো আছে!’
৩
তিন সপ্তাহ পর মাঝরাতে দরজায় নক করল নিয়াজ। দরজা খুলে দিয়ে দেখি—সারা মুখ কালো ওর। সমস্ত অবয়বে ভেঙে পড়ার ছাপ। আমি ওর একটা হাত চেপে ধরে বললাম, ‘এবার কি তোর বউকে নিয়ে পালিয়েছে?’
নিয়াজ সোফায় বসে খুব ক্লান্ত গলায় বলল, ‘দোস্ত, এক গ্লাস পানি দে। ঘরে বিষ থাকলে একটু বিষও দিস, প্লিজ।’
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু