স্বাদশেকড় I ইয়াম্মি চকলেট ব্রাউনি
ক্ল্যাসিক আমেরিকান ডেজার্ট। এর কোন ধরনেরটি আপনার বেশি পছন্দ? ফাজি, চিউই নাকি কেকি? প্রান্তের নাকি মাঝখানের স্বাদ বেশিক্ষণ জিভে লেগে থাকে? ডার্ক নাকি মিল্ক চকলেট ভালো লাগে বেশি? গরম নাকি ঠান্ডা প্রিয়? এসব নিয়ে তর্ক হতেই পারে। ব্রাউনি এতই জনপ্রিয়, ১৯৮৫ সালের বিজ্ঞাপন অনুসারে, কিছু মানুষ এর স্বাদ পেতে চরমভাবে অস্থির হয়ে থাকে। এই মিষ্টান্নের প্রতি আমেরিকানদের ভালোবাসা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
গল্পের শুরু চকলেট দিয়ে। ১৬৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরের কাছে আমজনতাকে ভোজন-বিনোদন জোগাতে কফি ও চুকালেটো (চকলেট) বিক্রির একটি ঘর রাখার আবেদন করেছিলেন ডরোথি জোনস ও জেন বার্নার্ড নামের দুই ব্যক্তি। সেই আবেদনের নথি ব্রিটিশ ও আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে চকলেটের উপস্থিতির পুরোনো নথিগুলোর একটি। ইউরোপের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও চকলেটের প্রতি শুরুতে ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। উপভোগ্য যেকোনো কিছু রক্ষণশীলদের কাছে পাপ হিসেবে গণ্য হতো। চকলেটের প্রতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াও ছিল তেমনই। তাতে অবশ্য অভিজাতদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। খাওয়া এবং উপহার দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে চকলেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে।
রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ এবং অষ্টাদশের শুরুর দিকে নিউ ইংল্যান্ডে ধনী পরিবারগুলো প্রায়শই প্রাতরাশের সঙ্গে এক কাপ চকলেট উপভোগ করত। এই সময়ের হট চকলেট পানীয়টি ইউরোপীয় ফ্যাশনে প্রস্তুত করা হতো। টিন, তামা, পাথর বা রুপার তৈরি বিশেষ পাত্র ব্যবহার করে ধনীরা এটি উপস্থাপন করতেন। চকলেটের পাত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চায়ের পাত্রের চেয়ে লম্বা ও বড় হতো এবং এর ঢাকনায় একটি ছিদ্র থাকত। পাত্রটি একটি তাপের উৎসের ওপরে স্থাপন করে পানি মিশ্রিত কোকো পাউডার ক্রমাগত নেড়ে এমনভাবে সেদ্ধ করা হতো, যেন এটি পুরোপুরি গলে গিয়ে ফেনাযুক্ত মিশ্রণে রূপ নেয়।
চকলেটের জনপ্রিয়তা ইউরোপ থেকে আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সেখানে চকলেট বিক্রির জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশের চল শুরু হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন [১৭০৬—১৭৯০] তার ফিলাডেলফিয়া প্রিন্ট শপে চকলেট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে চকলেট উপকারী বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। এমনকি গুটিবসন্তের চিকিৎসার জন্য চকলেট ব্যবহারের সুপারিশও করেছিলেন। সেকালে ফরাসি এবং ভারতীয় যুদ্ধে সংগ্রামরত সাবঅলটার্ন অফিসারদের সবার জন্য চকলেট খাওয়ার রীতি ছিল অবধারিত।
চাহিদা বাড়ায় নিউ ইংল্যান্ডবাসী উদ্যোক্তারা স্থানীয়ভাবে চকলেট তৈরি শুরু করেন। অন্যদিকে, প্রথম চকলেট কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৬৫ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে, নেপোনসেট নদীর তীরে গড়ে ওঠা ডরচেস্টার-মিলটন লোয়ার মিলস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়। কারখানাটির নাম ছিল ওয়াল্টার বেকার অ্যান্ড কোম্পানি। তারা কোকোকে চকলেটে প্রক্রিয়াজাত করত। সেই কোম্পানি এখনো বেকারস চকলেট ব্র্যান্ড হিসেবে সক্রিয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে বেকারস ও অন্য উৎপাদনকারীরা আমেরিকান বাজারে চকলেটের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। আনে নতুন নতুন সংস্করণ। ১৭৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসকে চকলেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সম্পর্কে লেখেন, ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিবেচনায় চকলেটের শ্রেষ্ঠত্ব শিগগির একে আমেরিকাতে চা ও কফির চেয়ে অগ্রাধিকার পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যা এখন স্পেনে বিদ্যমান।’
ঊনবিংশ শতাব্দীতে চকলেটের আবেদন আরও ছড়িয়ে পড়ে। চাহিদা মেটাতে লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এমনকি আফ্রিকায় বড় পরিসরে কোকো চাষ করা হতো। কোকোর বাগান ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোতে প্রচলিত দাস শ্রমের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করত; ফলে দাম সাশ্রয়ী হতো। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে উৎপাদনকারীরা কম খরচে আরও চকলেট উৎপাদন করতে থাকেন, যা আমেরিকান ভোক্তাদের কাছে একে সহজলভ্য করে তোলে। আমেরিকান চকলেট উৎপাদনকারীরা তাদের কাজের জন্য গর্ববোধ করতেই পারেন। তারা সারা বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক এক্সিবিশনে তাদের পণ্যের প্রবেশ ঘটাতে এবং মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও কর্ণধারদের অভিজাত কমিটি থেকে পুরস্কার জিততে থাকেন।
চকলেটের স্বাদ ও আকারে পরিবর্তন আনার জন্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সেই শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনে প্রথম চকলেট বার তৈরি করা হয়। কয়েক দশক পরে বাজারে আসে মিল্ক চকলেট বার। বোস্টনভিত্তিক চকলেটিয়ার ওয়াল্টার এম লোনি ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে প্রথম আমেরিকান চকলেট বার হাজির করেন।
কিছু উৎস থেকে জানা যায়, কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে নতুন চকলেট বেকড গুডসের প্রচলন ঘটেছিল। গল্পটি এমন, ধনী সমাজপতি মিসেস বার্থা পটার পামার শিকাগোর দ্য পামার হাউস হোটেলে তার শেফকে একটি ডেজার্ট তৈরি করতে বলেছিলেন, যা কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে অংশ নেওয়া নারীদের খাওয়ানোর জন্য একটি লাঞ্চ বক্সে থাকবে। এর ফলেই উদ্ভাবিত হয় ফাজি-চকলেট মিষ্টান্ন পামার হাউস ব্রাউনি। হোটেলের মেনুতে এই চকলেট ব্রাউনি এখনো রয়ে গেলেও সেই সৃজনশীল শেফের নাম ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে।
প্রথম তৈরি এই ব্রাউনিতে সম্ভবত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চকলেট, মাখন ও চিনি; সেই সঙ্গে কোকো পাউডার ও ডিম অন্তর্ভুক্ত ছিল। টপিংয়ে ছিল আখরোট ও অ্যাপ্রিকট গ্লেজ। শিকাগোর দ্য পামার হাউস হিলটন আজও তাদের এই বিখ্যাত খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছে। চাইলে অনলাইনে পামার হাউস ব্রাউনি রেসিপি খুঁজে পেতে পারেন যে কেউ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেকিংয়ে চকলেটের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বাড়ে। যেমন ধরুন, কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে ওয়াল্টার বেকার অ্যান্ড কোম্পানি তাদের উপাদান দিয়ে তৈরি চকলেট প্রদর্শন এবং দর্শকদের কাছে এর নমুনা বিনা মূল্যে পরিবেশন করে। রান্নায় চকলেট ব্যবহারকে উৎসাহিত করার প্রয়াসে তারা মারিয়া পার্লোয়ার ‘চয়েস রিসিপ্টস’-এর কপিও বিনা মূল্যে বিতরণ করে। এটি এমন রেসিপি ব্রুসিয়ার, যাতে বাড়ির রান্নাঘরে চকলেট ও কোকো কীভাবে ব্যবহার করা সম্ভব, সেই পরামর্শ ছিল। বলে রাখি, মারিয়া পার্লোয়াকে ক্ষেত্রবিশেষে প্রথম সেলিব্রিটি কুক গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন বোস্টনভিত্তিক একজন শিক্ষাবিদ, লেখক এবং দুটি রান্নার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। পার্লোয়া সে সময়ে নারীদের গৃহস্থালি-সম্পর্কিত দক্ষতা প্রশিক্ষণের জন্য নিবেদিত শিক্ষাবিদদের বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ ছিলেন। ১৯০৯ সালে ওয়াল্টার বেকার অ্যান্ড কোম্পানি এবং মিস পার্লোয়ার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত আরেকটি কুকবুক ‘চকলেট অ্যান্ড কোকো রেসিপি অ্যান্ড হোম মেড ক্যান্ডি রেসিপি’ ছিল একটি আইকনিক কাজ।
নথি বলছে, চকলেট দিয়ে তৈরি ব্রাউনির প্রথম প্রকাশিত রেসিপিটি সার্ভিস ক্লাব অব শিকাগোর ১৯০৪ সালের কুকবুক অনুসারে সৃষ্টি হতে পারে, যা ক্যান্ডি বিভাগের ক্লাব সদস্যদের একটি প্রকাশনা। ওই রেসিপি ‘ব্যাঙ্গর ব্রাউনি’ নামে পরিচিত। রেসিপিটি ছিল এমন, ‘দেড় কাপ মাখন, এক কাপ চিনি, এক-চতুর্থাংশ বেকারের চকলেট, দুটি ডিম, আধা কাপ পেস্ট্রি ময়দা, দেড় কাপ কাটা আখরোট—সবকিছু মিলিয়ে মাঝারি আকারের চুলায় পনেরো মিনিট বেক করুন।’
এই রেসিপি পরবর্তীকালে নানাভাবে সংযোজন, বিয়োজন ও ফিউশন করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। চকলেট ব্রাউনি প্রস্তুতকরণের উপাদান তৈরিতে মানুষের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে মেশিনের ব্যবহার শুরু হয়। বিপণনে সৃজনশীলতা একে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে দেয় দুনিয়াজুড়ে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট