skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I আহারে হাড়ের যতন

হাড় মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের গোলমালও বারোটা বাজাতে পারে হাড়ের। সঠিক ডায়েটের পরামর্শ রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির কাছ থেকে

মায়ের গর্ভকালীন থেকেই মানবদেহে পুষ্টির জোগান ও শারীরিক বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। এ সময় পুষ্টি তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে ইমিউনিটি; বাড়ে হাড়ের ক্ষয়। সাধারণত ৩০ বছরের পর থেকে মানুষের বোন ডেনসিটি কমতে থাকে। সময়ের আগেই যেন বুড়িয়ে যেতে না হয়, তাই নেওয়া চাই হাড়ের যতন। যেসব পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন, সেগুলো রাখা চাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায়।
ক্যালসিয়াম
হৃৎপিণ্ড ও হাড়ের যত্নে এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী পুষ্টি উপাদান। মানবদেহের মেরুদণ্ড, দাঁতসহ হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এই খনিজ উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাড়ের ক্ষয় কমাতে, হাড় মজবুত ও দৃঢ় রাখতে তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার রাখা প্রয়োজন। এই উপাদানের অভাবে উল্লেখযোগ্য বয়সের অনেক আগে আমাদের হাড়গুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যেতে থাকে, যা অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণত যে বয়সে, অর্থাৎ বয়স ১৬-১৭ বছর পেরোলেই যখন নিজেদের একটু বড় ভাবা শুরু করি, তখন থেকেই খাদ্যতালিকায় অনেকে সবার আগে দুধ বাদ দিয়ে দেন। আর তাতেই ক্যালসিয়ামের ঘাটতি শুরু হওয়ার ঝুঁকি মাথাচাড়া দেয়। অন্যদিকে, শিশুকালে হাড়ের যথাযথ বৃদ্ধি না হলে শিশুর যথাযথভাবে লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। সে জন্য প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় এক কাপ দুধ রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া দুধে তৈরি যেকোনো খাবারও ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস হিসেবে রাখতে পারেন ডায়েটে।
ফসফরাস
আমাদের হাড়, পেশি ও দাঁতের জন্য তো বটেই, এমনকি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিনারেল। ফসফরাসের অভাবে দেখা দিতে পারে শারীরিক বেশ কিছু সমস্যা; যেমন ঝিমঝিম ভাব, দুর্বলতাবোধ, হাড়ের দুর্বলতা, জয়েন্ট পেইন, ডিপ্রেশন, অ্যানোরেক্সিয়া প্রভৃতি। তাই নিত্যদিনের ডায়েটে ফসফরাসসমৃদ্ধ খাবার রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে খেতে পারেন সামুদ্রিক মাছ। কেননা সি ফুডগুলোতে যথেষ্ট ফসফরাস থাকে। তা ছাড়া আমড়া, মটরশুঁটি কিংবা ইয়োগার্টও খেতে পারেন রোজ।
ভিটামিন ডি
মানবদেহের প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টগুলোর মধ্যে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। হাইপোভিটামিনোসিস ডি-এর কারণে শিশুর হাড়ের বিকৃতি বা রিকেট রোগ হতে পারে—এ কথা অনেকের জানা। অন্যদিকে ভিটামিন ডি-এর অভাব হলে দেখা দিতে পারে ওবেসিটি, অত্যধিক হেয়ার ফল, ডিপ্রেশন, হাড়ের ক্ষয়, অত্যধিক ক্লান্তিবোধ, ব্যাক পেইন ইত্যাদি। আমাদের দেহে ভিটামিন ডি তৈরি করার জন্য প্রয়োজন সরাসরি সূর্যের আলো, যা আজকাল বিশেষত শহুরে এলাকায় সহজে মেলে না। সে ক্ষেত্রে নারীরা রয়েছেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ভিটামিন ডি-এর অভাবে যেহেতু হাড়, জয়েন্ট, পিঠ ও স্নায়ুতে ব্যথা হতে পারে, তাই ডায়েটে অবশ্যই রাখা চাই টুনা, স্যামন, সারডিনস, ম্যাকেরেলসহ বিভিন্ন; বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাছ। এ ছাড়া দুধ, দই, মাশরুম ও ডিমের কুসুমও ভিটামিন ডি-এর ভালো উৎস। রক্তে এই ভিটামিনের মাত্রা অনেক কম থাকলে গ্রহণ করা যাই ডি সাপ্লিমেন্ট, তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে।
সুস্থ, সবল আর মজবুত হাড়ের জন্য চাই পুষ্টিতে ভরপুর খাবার। তাই খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন—
টোফু
নিরামিষাশীদের জন্য তো বটেই, এমনকি যারা দুধ বা দুধজাতীয় খাবার হজম করতে পারেন না, অর্থাৎ যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে হাড়ের সুস্থতা রক্ষায় দুধে তৈরি খাবার গ্রহণ সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে সয়া দিয়ে তৈরি টোফু হতে পারে একটি আদর্শ বিকল্প খাবার। ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর টোফুতে রয়েছে প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। হাড়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসসমৃদ্ধ টোফু পোস্ট মেনোপজাল নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
আখরোট
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি, ফসফরাস এবং ফোলেট ও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ আখরোট হাড়ের সুস্থতায় বেশ কাজের। দেহে এ ধরনের পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত না থাকলে গায়ে-পায়ে ব্যথা, হাড়ের দুর্বলতা, সহজে দাঁত পড়ে যাওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন কিংবা নিয়মিত স্ন্যাকস হিসেবে আখরোট রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়।
সিডস
সানফ্লাওয়ার সিড, ফ্ল্যাক্স সিড ইত্যাদি আজকাল সুপারশপগুলোতে সহজলভ্য। এ ধরনের বীজে রয়েছে প্রোটিন ও উচ্চ আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিডসহ নানা ধরনের খনিজ উপাদান; যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও কপার। হাড়ের সংযোগকারী টিস্যুর জন্য এসব পুষ্টি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পালংশাক
ছোটবেলায় ‘পপাই দ্য সেইলর ম্যান’ কার্টুনটি নিশ্চয় অনেকের ভালো লাগত। এই কার্টুনে যেমন দেখা যায়, স্পিনাচ বা পালংশাক খেলে শক্তি অর্জিত হয়, তেমনি বাস্তব জীবনেও সুস্থ থাকতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মিনারেলে ভরপুর এ শাক রাখা চাই প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়। স্যুপ, স্যালাদ কিংবা ভাতের সঙ্গে খেতে দারুণ সুস্বাদু পালংশাকে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও প্রচুর আয়রন।
তবে হাড় মজবুত রাখতে এবং হাড়ের সুস্থতা রক্ষায় পুষ্টি উপাদান গ্রহণের পাশাপাশি কিছু খারাপ অভ্যাস বর্জন করা চাই। কোনগুলো? চলুন, জানি—
 ধূমপান ও মদ্যপান: এসব বদভ্যাস কখনোই হাড়ের সুস্থতায় ভালো প্রভাব ফেলতে পারে না। এসবে আসক্তি থাকলে হাড়ের ক্ষয়, সহজে ভঙ্গুরতা ইত্যাদি সমস্যা বার্ধক্যের আগেই দেখা দিতে পারে। তাই সুস্থ জীবনের জন্য এ ধরনের অভ্যাস লিস্ট থেকে দ্রুত ইরেজ করে দিন।
 সফট ড্রিংকস: আজকাল যেকোনো পার্টি, বিয়ে বা উৎসব মানেই মনোহর গ্লাসে নানা রকম সফট ড্রিংকস! অথচ এগুলো কার্বনেটেড বেভারেজ হওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ করলে হাড়ের বেশ ক্ষতি ডেকে আনে; পরবর্তীকালে হাড়ের ভঙ্গুরতা বা দুর্বলতা বাড়ে।
 লবণ: আমাদের খাদ্যতালিকায় আর যা-ই হোক, লবণ একেবারে বন্ধ রাখা অসম্ভব! যেকোনো রান্নায় স্বাদ ও টেক্সচার স্বাভাবিক রাখতে অল্প পরিমাণ হলেও লবণ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। লবণে রয়েছে সোডিয়াম, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কম গ্রহণ করলে যেমন শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলে, তেমনি অতিরিক্ত বেশি গ্রহণ করলে হাড়ের ক্ষয় ও শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই যাদের বাড়তি লবণ গ্রহণের প্রবণতা রয়েছে, তাদের সে অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া চাই!
সুস্থ জীবন পেতে মেরুদণ্ড শক্ত রাখতে হয়। তাই শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সে হাড়ের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তবে হাড়কে মজবুত করতে সব ডায়েটের পাশাপাশি অবশ্যই গায়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট রোদ লাগানো আবশ্যক। সেটি যদি প্রতিদিন না-ও হয়, সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ব্যস্ততার মধ্যেই সময় করে যাওয়া চাই রোদে। অন্যদিকে, শরীরে ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম বা অন্যান্য উপাদান স্বাভাবিক রয়েছে কি না, তা ছয় মাস থেকে এক বছর পরপর রুটিন চেকআপ করিয়ে নেওয়া ভালো। সমাধানের জন্য নেওয়া চাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top