টেকসহি I গ্রিনওয়াশ গাইড
সৌন্দর্যশিল্পের অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। অল ন্যাচারাল, ইকো-ফ্রেন্ডলি, আর্থ সেফের মতো মনভোলানো শব্দের আড়ালে। অসচেতনদের জন্য ফাঁদ পাতা প্রতি পদক্ষেপে
স্কিন কেয়ার ও মেকআপের সঠিক পণ্য খুঁজে পাওয়া যেমন বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনই বড় ঝুঁকি এই পণ্যগুলোর লেবেল, ভাষা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করা; যাকে বলা হয় গ্রিনওয়াশিং ও ক্লিনওয়াশিং। এবার জেনে নেওয়া যাক, এই প্রতারণামূলক কার্যক্রম কীভাবে কাজ করে এবং সচেতন ক্রেতা হিসেবে তা কীভাবে শনাক্ত করা সম্ভব।
গ্রিনওয়াশিং কী
একধরনের প্রচারণা, যেখানে কোনো কোম্পানি বা ব্র্যান্ড নিজেদের পণ্যকে পরিবেশবান্ধব, প্রাকৃতিক বা টেকসই বলে উপস্থাপন করে; অথচ বাস্তবে তারা সে রকম কিছুই করছে না। এখানে ‘গ্রিন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় পরিবেশবান্ধবতার প্রতীক হিসেবে; আর ‘হোয়াইটওয়াশিং’ মানে আসল সত্যকে আড়াল করা। এই দুই শব্দ একত্রে তৈরি করেছে ‘গ্রিনওয়াশিং’; মানে পরিবেশবান্ধবতার মুখোশে প্রতারণা। অনেক ব্র্যান্ড বিভিন্ন ধরনের শব্দ, ছবি বা রং ব্যবহার করে এমন এক ধারণা তৈরি করে যে তাদের পণ্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের প্রতি দায়িত্বশীল; অথচ বাস্তবতা অনেক সময় এর উল্টো। পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক ও প্লাস্টিক; কিংবা থাকে অস্বচ্ছ উৎপাদন প্রক্রিয়া।
সাধারণ উদাহরণ ও চেনার উপায়
অস্পষ্ট শব্দের ব্যবহার: অনেক সময় পণ্যের গায়ে ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’, ‘গ্রিন’, ‘ন্যাচারাল’, ‘আর্থ-সেফ’ ইত্যাদি শব্দ দেখা যায়, বেশ আশাব্যঞ্জক মনে হলেও যেগুলোর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড বা প্রমাণ থাকে না। আসলে এই শব্দগুলো আইনগতভাবে সেভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়, তাই কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে ক্রেতাদের বিশ্বাস করাতে চায়, পণ্যটি পরিবেশবান্ধব।
নকল বা দুর্বল সার্টিফিকেশন: কিছু ব্র্যান্ড নিজেদের তৈরি লোগো দিয়ে লিখে দেয় সার্টিফায়েড গ্রিন বা ইকো টেস্টেড; যেগুলো দেখতে অনেকটা আসল সার্টিফিকেশনের মতো হলেও আসলে সেগুলোর পেছনে কোনো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকে না। প্রকৃত সার্টিফিকেশন যেমন ইউএসডিএ অর্গানিক, ইকোসার্ট বা লিপিং বানির মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে আসা উচিত।
আংশিক তথ্য বা গোপনীয়তা: ব্র্যান্ডটি হয়তো বলছে, তাদের প্যাকেজিং পুরোপুরি রিসাইকেলযোগ্য; অথচ তারা পণ্যের মধ্যে এমন উপাদান ব্যবহার করছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কিংবা উৎপাদনের সময় পানি বা শক্তির প্রচুর অপচয় হচ্ছে। এ ধরনের ‘সত্য হলেও অসম্পূর্ণ’ তথ্য দিয়ে মূল সমস্যাটাই আড়ালের চেষ্টা করে অনেকে।
রং ও প্যাকেজিংয়ে বিভ্রান্তি: সবুজ রং, পাতা বা গাছের ছবি, এমনকি কাগজের টেক্সচারও ব্যবহার করা হয় মোড়কে, যেন পণ্যটি প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত মনে হয়। কিন্তু এসব শুধুই বাহ্যিক সাজসজ্জা, যেটা অনেক সময় প্রকৃত উপাদান বা উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য আড়ালে রাখে।
অস্বচ্ছতা ও তথ্য গোপন রাখা: যেসব ব্র্যান্ড সত্যিকারের টেকসই ও স্বাস্থ্যবান্ধব পণ্য তৈরি করে, তারা সাধারণত তাদের উপাদান, উৎস এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া খোলাখুলিভাবে জানায়। কিন্তু যারা গ্রিনওয়াশিং করে, তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে রাখতে চায়, যাতে গ্রাহক পুরো চিত্র জানতে না পারেন।
ক্লিনওয়াশিং কী
একটি প্রতারণামূলক মার্কেটিং কৌশল, যা মূলত স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার এবং মেকআপ পণ্যে ব্যবহৃত হয়। এই কৌশলের মাধ্যমে একটি পণ্যকে ‘ক্লিন’, ‘নন-টক্সিক’, ‘ন্যাচারাল’ ইত্যাদি বলা হয়; অথচ এই দাবির পেছনে সুনির্দিষ্ট উপাদান বা তথ্য দেওয়া হয় না। ক্লিন বিউটি বলতে বোঝানো হয় এমন পণ্য, যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ এবং টেকসই উপাদানে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে অনেক বড় কোম্পানি কেবল শব্দের খেলায় নিজেদের পণ্যকে ‘ক্লিন’ দাবি করলেও উপাদান বা উৎপাদনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলে থাকেন।
চেনার উপায়
অনেক সময় পণ্যের গায়ে বড় করে লেখা থাকে ‘প্যারাবেন-ফ্র্রি’, যা দেখে ক্রেতার মনে স্বস্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেই একই পণ্যে ‘ফ্র্যাগরেন্স’ বা ‘পারফিউম’ উল্লেখ করা হয়েছে। এই একটি শব্দের আড়ালেই লুকিয়ে থাকতে পারে শত শত কেমিক্যাল, যেগুলোর নাম জানাতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর মধ্যে অনেক উপাদান আবার হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটার কিংবা অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। আবার অনেক ব্র্যান্ড দাবি করে, তাদের মাসকারা বা অন্যান্য মেকআপ পণ্য ‘ন্যাচারাল’; কিন্তু আসলে সেগুলোতে রং বা ঝলমলে ভাব আনার জন্য ব্যবহৃত হয় মাইকা বা অন্যান্য খনিজ উপাদান, যা প্রাকৃতিক হলেও পরিবেশবান্ধব নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে শিশু শ্রমের মাধ্যমে আহরণ করা হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু পণ্যে লেখা থাকে ‘প্রোপ্রাইটারি ব্লেন্ড’ বা ‘বিশেষ মিশ্রণ’; যেটা আসলে উপাদান গোপন রাখার কৌশল। এতে ব্র্যান্ডটি বলে দেয়, তারা সব উপাদান দেখাতে পারবে না; কারণ, এটি তাদের নিজস্ব ফর্মুলা। অথচ এতে গ্রাহক বুঝতে পারেন না, তাদের ত্বক বা শরীর কিসের সংস্পর্শে আসছে। এই ধরনের অস্পষ্টতা ক্লিন বিউটির মূল আদর্শের পরিপন্থী।
কেন ক্ষতিকর
গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করা
গ্রিনওয়াশিংয়ের বড় প্রভাবগুলোর একটি হলো, এটি সাধারণ গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে। অনেকে মনে করেন, তারা যেসব পণ্য ব্যবহার করছেন, সেগুলো স্বাস্থ্যবান্ধব, প্রাকৃতিক বা পরিবেশবান্ধব। অথচ বাস্তবে তারা হয়তো প্রতিদিনই ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করছেন নিজেদের অজান্তে। সুন্দর মোড়ক, সবুজ রং কিংবা ‘ন্যাচারাল, ‘নন-টক্সিক’, ‘ক্লিন’ জাতীয় শব্দ দেখে তারা আশ্বস্ত হন; কিন্তু ভেতরের উপাদান বা প্রস্তুতের প্রক্রিয়া নিয়ে সচেতন না হলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব
এমন প্রতারণামূলক প্রচারণার কারণে যেসব কোম্পানি আসলেই টেকসইভাবে, ন্যায্য প্রক্রিয়ায় বা পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য তৈরি করে, তারা অনেক সময় বাজারে পিছিয়ে পড়ে। কারণ, গ্রিনওয়াশিং করা ব্র্যান্ডগুলো সহজে ভোক্তাদের মন জয় করে নেয় কম খরচে তৈরি এবং চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে। ফলে টেকসই উদ্যোগগুলো প্রাপ্য গুরুত্ব ও বিক্রয় পায় না, যা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি
অনেক তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘ক্লিন’ ব্র্যান্ডের পণ্যে এমন উপাদান থাকে, যেগুলো শরীরের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে। এগুলোর মধ্যে কিছু উপাদান হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনাশ, ত্বকে জ্বালাভাব, চুলকানি বা অ্যালার্জির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে; এমনকি কিছু উপাদান ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত বাড়াতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। অথচ গ্রাহক যখন এসব পণ্যকে নিরাপদ মনে করে নিয়মিত ব্যবহার করেন, তখন ক্ষতিটা আরও গভীরে পৌঁছায়।
প্রতারণা শনাক্তের উপায়
মার্কেটিংয়ে নয়, উপাদানে বিশ্বাস
পণ্যের মোড়কে ‘ন্যাচারাল,’ ‘বোটানিক্যাল’, ‘কেমিক্যাল-ফ্রি’, ‘নন-টক্সিক’—এই ধরনের শব্দ অনেক সময় চোখে পড়ে। আশ্বস্তবোধ হলেও আসলে এই শব্দগুলোর বেশির ভাগের কোনো নির্দিষ্ট আইনগত সংজ্ঞা নেই। অর্থাৎ, কোনো ব্র্যান্ড চাইলে নিজের ইচ্ছেমতো শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারে, কোনো যাচাই ছাড়াই। তাই শুধু লেবেলের মনভোলানো শব্দে ভরসা না রেখে, পণ্যের পেছনে বা গায়ে লেখা আসল উপাদানগুলোর তালিকা পড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পূর্ণ উপাদান তালিকা
যেকোনো পণ্য কেনার আগে পুরো উপাদান তালিকা খুঁটিয়ে দেখা জরুরি। অনেক কোম্পানি ‘ফ্র্যাগরেন্স’, ‘প্রোপ্রাইটারি ব্লেন্ড’ বা ‘বোটানিক্যাল কমপ্লেক্স’—এই ধরনের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করে স্বচ্ছতা পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। এগুলোর ভেতরে অসংখ্য কেমিক্যাল লুকিয়ে থাকতে পারে, যেগুলোর প্রভাব আমাদের শরীর বা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। তাই যদি কোনো ব্র্যান্ড উপাদান গোপন রাখে কিংবা খোলামেলা তথ্য না দেয়, তাহলে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
স্বতন্ত্র সার্টিফিকেশন
বাজারে অনেক পণ্য নিজেই নিজের মতো ‘সার্টিফায়েড’ দাবি করে। তবে আসল ভরসা পাওয়া যায় তখনই, যখন কোনো পণ্য আন্তর্জাতিক বা নির্ভরযোগ্য তৃতীয় পক্ষের স্বীকৃতি পায় কিংবা সংস্থাগুলো নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে দেখে পণ্যটি সত্যি টেকসই, নৈতিক বা কেমিক্যালমুক্ত কি না। এমন লোগো থাকলে সেটি বিশ্বাসযোগ্যতার বড় একটা চিহ্ন।
প্যাকেজিংয়ে নয়, স্বচ্ছতায় ফোকাস
সবুজ রং, পাতা কিংবা পাহাড়-নদীর ছবি দেখলেই আমরা ধরে নিই, পণ্যটি পরিবেশবান্ধব। কিন্তু শুধু প্যাকেজিং দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়; বরং কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে তারা আসলে কীভাবে পণ্য তৈরি করছে, কোন উপকরণ ব্যবহার করছে, কিংবা তাদের প্রোডাকশন পদ্ধতি কতটা টেকসই—এসব বিষয় দেখে বুঝতে হবে, সত্যিকার অর্থেই তারা ‘গ্রিন’ কি না।
বিশ্বস্ত অ্যাপ ব্যবহার
বাজারে এখন কিছু কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য মোবাইল অ্যাপ আছে, যা আপনাকে সহজে পণ্যের উপাদান যাচাইয়ে সাহায্য করতে পারে। যেমন ‘সুইচ ন্যাচারাল’ অ্যাপ—এটি দিয়ে আপনি যেকোনো কসমেটিক বা স্কিন কেয়ার পণ্যের বারকোড স্ক্যান করলেই জানতে পারবেন, তার ভেতরে ক্ষতিকর কেমিক্যাল আছে কি না, কিংবা সেটি আপনার ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ।
শিরীন অন্যা
ছবি:সংগ্রহ
