skip to Main Content

মনোজাল I পুরোনোতে পূজা

এ যেন পোশাকে মোড়ানো অতীত স্মৃতির ঝলক। মায়াময় মুহূর্তগুলোর আবার জীবন্ত হয়ে ওঠার উপাখ্যান। পুরাতন সুবাসে নিজেকে নতুন করে খোঁজের অমোঘ আকর্ষণ

পূজা মানে কী? বন্ধুদের সঙ্গে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আড্ডা, মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো, অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি, নাকি দশমীর বিসর্জনে ঢাকের তালে নাচ? যা-ই হোক না কেন, একটা ব্যাপার কিন্তু কমন। পূজার কয়েকটি দিন আলাদাভাবে নিজেকে সুন্দর দেখানোর প্রচেষ্টা বা অন্যের চোখে বিশেষ হয়ে ওঠা। সবারই প্রয়াস থাকে একটু বিশেষ কিছু পরার, যেন অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা লাগে। ম্যাচিং জুয়েলারি আর আকর্ষণীয় মেকআপে অনন্য হয়ে ওঠার জন্য নারীর সেই চেষ্টার প্রধান উপকরণ শাড়ি। মূলত ঐতিহ্যগত কারণে এ সময় বেশির ভাগ মেয়ে শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। সেটি যদি হয় আলমারির এক কোনায় যত্ন করে রাখা মা, দাদি বা নানির শাড়ি, তাহলে তো কথাই নেই!
পূজার সময় নানি-দাদির পুরোনো শাড়ি পরার চল কিন্তু নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং এখনো তা আউট অব ট্রেন্ড হয়ে যায়নি। মূলত ঐতিহ্য ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে এই ট্রেন্ডের উৎপত্তি। কারণ, এই শাড়িগুলোকে কেবল পরিধেয় পোশাক হিসেবে ভাবা হয় না; মূল্যায়িত হয় পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ। নতুন করে তা পরার উদ্দেশ্য মনে নস্টালজিয়া ও ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। পরার পর যার ছোঁয়া যেমন শরীরজুড়ে অনুভব করা যায়, তেমনি দেখতেও দারুণ লাগে, আউটডেটেড মনে হয় না। কারণ, পুরোনো এই শাড়িগুলো এখনো খুব চমৎকারভাবে ট্রেন্ডি।
ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা অকপটে স্বীকার করেন, নানি, দাদি ও মায়েরা এখনো আমাদের ফ্যাশনকে প্রভাবিত করেন। কেন এখনো তাদের পোশাক বা গয়না পরা হয়? এর পেছনে ভালোবাসার পাশাপাশি যুক্তিও আছে। তাদের মতে, এসব প্রাচীন শাড়ির প্রতিটি আবরণে, জুয়েলারির প্রতিটি লেয়ারে এক-একটি গল্প বেঁচে থাকে। নানি, দাদি ও মায়েরা কেবল পোশাকই পরতেন না; তারা ঐতিহ্য, সৌন্দর্য এবং নীরব বিদ্রোহের প্রতীক বহন করতেন। তাদের পোশাকগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরিচয় বহন করে। আর গয়নার বাক্সগুলোও কেবল সোনার অলংকার নয়; তার চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে ভরা থাকে। অনেকটা সেই প্যান্ডোরার বাক্সের মতো, যা খুললে একসঙ্গে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে। আজ যখন কেউ তাদের পোশাক বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গয়না পরতে পছন্দ করেন, তখন এটি কেবল একটি স্টাইল স্টেটমেন্টই হয় না; বরং তার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে। মনে হয় এটি যেন কাপড়ে বোনা স্মৃতি আর তাদের উপস্থিতি বাঁচিয়ে রাখার উপায়। হাতে বোনা শাড়ি, সূচিকর্ম করা দোপাট্টা আর মোটা রুপালি কানের দুল কালজয়ী নান্দনিকতা উপহার দেয়। একধরনের আবেগিক বন্ধন তৈরি করে। তাদের পোশাক হয়ে ওঠে অতীতের আলিঙ্গনের মতো। পাশাপাশি বহন করে সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই ব্যস্ত সময়ে তারা মনে করিয়ে দেন, আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি। এ ক্ষেত্রে নস্টালজিয়াই সবচেয়ে বেশি কাজ করে; যা মানব মনে অতীতকে কোমল ভালোবাসায় আবৃত করে, সেপিয়া টোনে রাঙিয়ে দেয়। তাই যখন এমন একটি শাড়ি পরা হয়, যা আগে মা, নানি বা দাদিকে শোভিত করেছিল, অথবা দাদির ঝুমকায় নিজেকে সাজানো হয়, ফ্যাশন তখন একটি পোর্টাল হয়ে ওঠে—এমন মুহূর্তগুলোর সঙ্গে একটি সংবেদনশীল সংযোগ ঘটায়, যা মানুষ হয়তো কখনো ভুলে যেতে চায় না।
তখন কেবল তাদের পোশাক পরা হয় না; বরং তাদের পুনর্ব্যাখ্যাও করা হয়। একজন নানির কাঁথা তাই এই সময়ে এসে আধুনিক একটি জ্যাকেট হয়ে ওঠে। মায়ের তোতাপাখির মতো সবুজ শাড়িটি চমৎকার একটি সালোয়ার-কামিজে পরিণত হয়। আবার চাকরির ইন্টারভিউতে দাদির আংটি হয়ে ওঠে সৌভাগ্যের মন্ত্র। এটি তখন আসলে কেবল ফ্যাশন নয়; তার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে। তাই কেবল পূজা নয়, যেকোনো উৎসবেই এই ঐতিহ্য বহমান প্রক্রিয়ায় চলতে পারে।
পুরো বিষয়টি থেকে মূলত উঠে আসে কিছু কারণ।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
পুরোনো শাড়িগুলো সাধারণত ঐতিহ্যবাহী নকশা ও ফ্যাব্রিকের হয়ে থাকে, যা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ। পূজার সময় এই শাড়িগুলো পরলে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানানো হয়। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের ফ্যাশনেও বেশ মানানসই ও আকর্ষণীয় লাগে।
স্মৃতি ও স্মৃতিকাতরতা
নানি-দাদির পুরোনো শাড়ি মানেই তাদের সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতি। এই শাড়িগুলো পরলে তাদের কথা মনে পড়ে, যা আমাদের মনে ফেলে আসা সময়ের রেশ জাগিয়ে তোলে। পরার পর মনে হয়, এই উৎসবে তারাও যেন সঙ্গে আছেন।
ভালোবাসা ও আবেগ
পুরোনো শাড়িগুলো আসলে ভালোবাসার প্রতীক; যা অতি যত্নে এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনে অতিবাহিত হয়। সেই প্রতীক নিজের মধ্যে ধারণ করার মানে হলো, পরিবারের সেসব সদস্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
আর্থিক সাশ্রয়
এ কারণও ফেলনা নয়। বর্তমানের এই বাজারে পুরোনো শাড়ি পুনরায় ব্যবহার করা একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এটি নতুন পোশাক কেনার খরচও কমিয়ে দেয়। এর জন্য বরাদ্দ করা অর্থ দিয়ে সহজে মনমতো অন্য কিছু কিনে ফেলা যায়।
আকর্ষণীয় ডিজাইন
বলাই বাহুল্য, আগেকার দিনের শাড়িগুলোতে যে নিখুঁত কাজ করার চল ছিল, ইদানীং তা আর দেখা যায় না বললেই চলে। সেখান থেকে প্রেরণা নিয়েই ছিটেফোঁটা কাজে আজকাল তৈরি হয় নতুন নতুন শাড়ি। তাই পুরোনো দিনের শাড়িগুলোতে ব্যবহৃত অলংকরণ, ডিজাইন বর্তমান ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে চমৎকারভাবে মানানসই মনে হয়। সেগুলোতে নজরকাড়াও যায় সহজে।
বিশেষ অনুভূতি
যারা পরেন, তাদের মতে পূজার সময় এই শাড়িগুলো পরলে একধরনের বিশেষ অনুভূতি হয়, যা অন্য পোশাক যত দামিই হোক না কেন, তা থেকে পাওয়া যায় না। তাই তাদের কাছে আসলে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী ও আবেগপূর্ণ প্রথা; যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।

 রত্না রহিমা
মডেল: প্রিয়ন্তী
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: ক্যানভাস বাই তন্বী কবির
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top