সালতামামি ২০২৫ I প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
এ বছর বাংলাদেশের লোকাল ফ্যাশন বাজার উৎসবমুখর সময় কাটিয়েছে। বেশ কয়েক বছর পরে পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা হয়েছে জমিয়ে। ঈদের বাজারও ছিল জমজমাট। আবার, ঋতুনির্ভর নতুন সংগ্রহ বাজারে এনেছে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড। বিয়ের কেনাকাটাতে প্রাধান্য পেয়েছে দেশি শাড়ি ও ডিজাইনার ওয়্যার। বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। সেখানে খানিকটা অসন্তোষ দেখা গেছে। তবু হাল ছাড়েননি দেশীয় ব্র্যান্ড উদ্যোক্তারা
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাজারের গুরুত্বপূর্ণ নাম। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ দেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহুগুণ। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যার আকার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে সাসটেইনেবিলিটি ভিশন ২০৩০; যা দেশের পোশাকশিল্পকে আরও পরিবেশবান্ধব ও দায়িত্বশীল পর্যায়ে পৌঁছানোর একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ। এই পরিকল্পনায় গুরুত্ব পাচ্ছে ক্লিনার প্রোডাকশন, কঠোর কমপ্লায়েন্স এবং ইন্ডাস্ট্রিজুড়ে একটি ইকো-ফ্রেন্ডলি ভ্যালু চেইন তৈরি করা। এ তো গেল বিশ্বদরবারের গল্প। অভ্যন্তরীণ বাজারও ছিল মুখরিত। ফ্যাশন নিয়ে বেশ কিছু আয়োজন দেখা গেছে। আগ্রহীদের সরব উপস্থিতিতে চাঙা ছিল বাজার। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকেরা দেশের হাই-ভ্যালু টেক্সটাইল সেক্টরের উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন। আলোচনায় জোর দেওয়া হয়েছে শুধু পরিমাণ নয়; হাই-ভ্যালু ও সাসটেইনেবল প্রোডাক্টের দিকেও ধাপে ধাপে এগোনোর গুরুত্বে, যা দেশের টেক্সটাইলকে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ দেখাচ্ছে।
ফ্যাশন উইক, শো আর মেলা
বছরের শুরু থেকে প্রায় শেষাবধি নানা রকম আয়োজন ছিল। ফ্যাশন উইক, শো, মেলা—সবই ছিল তালিকায়। বাংলাদেশ ফ্যাশন লিগেসি অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারিতে। এই জমজমাট মাল্টি-ব্র্যান্ড রানওয়ে শোর লিড স্পনসর ছিল এপেক্স। এখানে একসঙ্গে অংশ নেয় মেইনস্ট্রিম আর কতুর—দুই ধরনের লেবেলই। এই ইভেন্টের স্টাইল মিক্স, কমার্শিয়াল চার্ম আর ক্রিয়েটিভ এক্সপেরিমেন্ট একে বিশেষ করে তুলেছিল। আর্কা ফ্যাশন উইকও ধীরে ধীরে বিকল্প ফ্যাশন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের জায়গা শক্ত করছে। এখানে নতুন ডিজাইনার, ক্রিয়েটর আর ছোট লেবেলগুলো পাচ্ছে কাজ দেখানোর সুযোগ। ঢাকাজুড়ে এমন মার্কেটপ্লেস বা ক্রিয়েটর-ফোকাসড ইভেন্টের সংখ্যা বাড়ছে, যা প্রমাণ করছে দেশের ফ্যাশন সিনারিও এখন আরও বৈচিত্র্যময়, স্বাধীন আর এনার্জিতে ভরপুর। একাধিক রানওয়ে ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়েছেন নতুন প্রজন্মের ডিজাইনাররা। শোগুলোতে দেখা গেছে বোল্ড রেডি-টু-ওয়্যার কালেকশন, যা স্থানীয় ফ্যাশনের নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। ভিডিও আর মিডিয়া কাভারেজে উঠে এসেছে ক্রেতাদের বাড়তি আগ্রহ; যা প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের ফ্যাশন দৃশ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কমার্শিয়ালি পাওয়ারফুল হয়ে উঠছে।
ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন মেলাতেও অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। বেশ কিছু পাঁচ তারকা হোটেলের প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন এ বছর আরও বেশি নিয়মিত হয়েছে। আলোকি, শুটিং ক্লাব, মাইডাসের অঙ্গনেও ছিল প্রাণবন্ত মেলা; যা একই ছাদের নিচে এনেছে অনেক ব্র্যান্ডকে। উইমেন এন্ট্রাপ্রেনারশিপ নিয়ে কর্মরত কিছু গ্রুপও মেলার আয়োজন করেছে। কোরাল ক্লজেট, নিতু মোমেন, পাওয়ার অব শি এরই মধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর
ফ্যাশন ব্র্যান্ড আর মডেলের সম্পর্ক একই সুতোয় বাঁধা। তাই তো নামীদামি তারকাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে নেওয়ার ইচ্ছা অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। মে মাসে মাইক্লো বাংলাদেশ তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান রহমান খানকে যুক্ত করেছে; যা এই বছরের অন্যতম আলোচিত সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট। এই পার্টনারশিপের মাধ্যমে মাইক্লো দেখিয়েছে, তাদের ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি আরও শক্ত করার ইচ্ছা এবং তরুণ, ফ্যাশন-সচেতন ক্রেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়ার লক্ষ। এ ছাড়া জুতার নতুন ব্র্যান্ড ওয়াকারোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন অভিনেতা আফরান নিশো। অন্যদিকে, তানজিন তিশা ও তৌসিফ মাহবুব ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড স্টেপের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছেন।
গ্লোবাল ম্যাপে দেশি ফ্যাশন
বাংলাদেশের লাক্সারি ও ডিজাইনার লেবেলগুলো এই বছর আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মঞ্চে সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি তৈরি করেছে। ডিজাইনার লাক্সারি ব্র্যান্ড জুরহেম প্যারিস ফ্যাশন উইকে সোলারিশ নামের কালেকশন প্রদর্শন করেছে; যা দেশের হাই-এন্ড ফ্যাশনের প্রতিভাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। কালেকশনটি তৈরি হয়েছে সেলেস্টিয়াল মোটিফ, সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি আর লাক্সারি টেইলারিংয়ের মিশেলে, যা বাংলাদেশকে শুধু একটি প্রোডাকশন হাব নয়; বরং ফ্যাশন ডিজাইনের উৎস হিসেবে তুলে ধরেছে। সালতামামির দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নিঃসন্দেহে এর শক্তিশালী প্রমাণ, যেখানে প্রিমিয়াম ও ডিজাইনার লেবেলগুলো দেশীয় ফ্যাশনের গল্পকে মাস-মার্কেট রেডি-টু-ওয়্যারের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
উদ্ভাবনের উদ্ভাস
এপ্রিলে বাংলাদেশ নতুন একটি ফ্যাব্রিকের সঙ্গে পরিচিত হয়। লোটাস সিল্ক নামে। পদ্ম ফুলের ডাঁটার আঁশ থেকে তৈরি এই ফাইবার সাসটেইনেবল। ইকো-ফ্রেন্ডলি লাক্সারি টেক্সটাইল উৎপাদনের প্রকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
সংগ্রহ সংবাদ
এ বছর ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বেশ কিছু কালেকশন ক্রেতাপ্রিয়তা পেয়েছে বিশেষভাবে। এগুলোর মধ্যে আছে আড়ংয়ের ফাল্গুন কালেকশন যেখানে ট্র্যাডিশনাল এলিমেন্ট আর মডার্ন স্টাইলিংয়ের সন্ধি নজর কেড়েছে। বোল্ড কালার, স্টেটমেন্ট জুয়েলারি, পুরুষদের পাঞ্জাবি, ফ্লোই শাড়ি এবং কনটেম্পরারি অ্যাকসেসরিজ ছিল এর মূল আকর্ষণ। কনটেম্পরারি লেবেল আর স্ট্রিটওয়্যার ব্র্যান্ড ঘিরেও ছিল আগ্রহ। ক্লাবহাউস এবার বেশ কিছু কাজ করেছে মিলেনিয়াল এবং জেন-জিকে প্রাধান্য দিয়ে। পেয়েছে ক্রেতাপ্রিয়তা। টুয়েলভ, রাইজ আর সারাও হেঁটেছে একই পথে। বাংলাদেশের ফ্যাশন সিনে ট্রেন্ডি, অ্যাক্সেসিবল আর কালচারালি রিলেটেবল পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। লা রিভের কালেকশনে পাওয়া গেছে গভীর ভাবনা ও গবেষণার ছোঁয়া। বিশেষ করে ঈদের আয়োজন নজর কেড়েছে। এই কালেকশনের প্রাসঙ্গিকতা হলো বাংলাদেশের ফেস্টিভ্যাল-ড্রাইভেন মার্কেটে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা এবং মেইনস্ট্রিম ফ্যাশন হাউস পুরো কীভাবে পরিবারকে টার্গেট করে ও নতুন ফ্যাব্রিক ইনোভেশন আনে, তা দেখানো।
ডিজাইনার লাইন
ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ডিজাইনার ব্র্যান্ড খানুম তাদের ক্যাপসুল কালেকশন রুটস বাজারে এনেছে। যেখানে সাউথ-এশিয়ান ড্রেপিং ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া মিশেছে কনটেম্পরারি ইভনিং ওয়্যার স্টাইলিংয়ের সঙ্গে। পুরো ক্যাম্পেইনের শুট হয়েছে বাংলাদেশে, যেখানে গল্পের মূল ফোকাস ছিল আইডেন্টিটি ও ডুয়ালিটি, সেই নারীদের নিয়ে উদ্যাপন করে, যারা একাধিক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে, সাহস ও দৃঢ়তায় এগিয়ে যান। সাফিয়া সাথী তারকাদের পোশাক নকশা করে ছিলেন আলোচনায়। অভিনেত্রী মেহজাবীনের বিয়ের পোশাকে মুগ্ধ করেছেন। ডিজাইনার হাবীবা সুরভীর ফ্যাশন ব্র্যান্ড শরদিন্দুর লন্ডন শোরুম উদ্বোধন হয়েছে। ডিজাইনার জুয়েলারি লাইন ক্যানভাসের গয়না আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে পরতে দেখা গেছে মিস গ্লোবের বাংলাদেশি প্রতিযোগী জেসমিমা জেমিমকে।
ক্যাম্পেইন ক্রেজ
এ বছর নজরকাড়া বেশ কিছু ক্যাম্পেইনের দেখা মিলেছে। তার মধ্যে আড়ংয়ের ব্রিং ইওর অউন ব্যাগ অন্যতম; যা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা—দুই-ই দেখা গেছে। আবার সাফিয়া সাথীর ব্রাইডাল কালেকশনের শুটে মডেলকে দেখা গেছে ঘোড়সওয়ার হিসেবে; যা আগ্রহের জায়গায় বেশ গুরুত্ব পেয়েছে।
সন্ধির সুন্দরতা
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেনের সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তি সম্পন্ন করেছে ব্লুচিজ। যাতে অ্যাপারেল ও ফ্যাশন বিজনেস স্টুডেন্টদের জন্য শিক্ষা, রিসার্চ এবং ইন্ডাস্ট্রি ইমারশন/ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরি করা যায়।
ফ্যাশন ডেস্ক
ছবি: ক্যানভাস আর্কাইভ
