ফুড বেনিফিট I আম্রলিপি
সুস্বাদু এই ফলের গুণের শেষ নেই যেন। স্বাস্থ্যরক্ষায় তো বটেই, সৌন্দর্যচর্চায় এটি জাদুকরি ফল দেয়
ভারত উপমহাদেশে আমের চাষ হচ্ছে হাজার বছর আগে থেকেই। তবে পূর্ব এশিয়াতে আমের দেখা মিলেছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম, মতান্তরে চতুর্থ শতাব্দী থেকে। আর চাষাবাদ শুরু হয়েছিল দশম শতাব্দী থেকে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ৬৩২ থেকে ৬৪৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে। আমের গুণগান বইয়ের পাতায় প্রথম মলাটবদ্ধ হয় ১৪ শতকে। কাজটি করেছিলেন ইবনে বতুতা।
কিন্তু আম নিয়ে কেন বিখ্যাতদের এত প্রীতি? শুধুই কি স্বাদের জন্য? নাকি অন্য কিছু? এমনকি মোগল সম্রাট আকবর ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙায় এক লাখ আমের চারা রোপণ করেছিলেন তার শাসনামলে। কী আছে এ সুমিষ্ট ফলের মধ্যে? আগে আমের গুণ যথাযথভাবে না জানা গেলেও, পুষ্টিশাস্ত্রের উন্নতির ফলে হালের মানুষ এ সম্পর্কে জানতে পারে।
প্রতি ১০০ গ্রাম আমে আছে শক্তি ২৫০ কিলোজুল, শর্করা ১৫ গ্রাম চিনি ১৩.৭ গ্রাম, ফাইবার ১.৬ গ্রাম, স্নেহ ০.৩৮ গ্রাম, প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম, ভিটামিন এ সমতুল্য ৫৪ মাইক্রোগ্রাম, বেটা ক্যারোটিন ৬৪০ মাইক্রোগ্রাম, লুটিন জিজানথেন ২৩ মাইক্রোগ্রাম, থায়ামিন বি১ ০.০২৮ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন বি২ ০.০৩৮ মিলিগ্রাম, ন্যায়েসেন বি৪ ০.৬৬৯ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড বি৫ ০.১৯৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.১১৯ মিলিগ্রাম, ফোলেট বি৯ ৪৩ মাইক্রোগ্রাম, কোলিন ৭.৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৩৬.৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ৪.২ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১ মিলিগ্রাম, লোহা ০.১৬ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.০৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১.৬৮ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১ মিলিগ্রাম এবং দস্তা ০.০৯ মিলিগ্রাম।
এই উপাদানগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট উপকারে আসে। শুধু আম নয়, এর পাতা, ফুল, গাছের ছাল ও বড়া- সবই স্বাস্থ্যচর্চায় কাজে আসে। এককথায় বলতে গেলে, একেকটি আম গাছ যেন একেকটি পরিপূর্ণ ঔষধালয়।
আমের ক্যারোটিন ও ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। রাতকানা রোগ থেকেও মুক্তি দেয়। এর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স স্নায়ুতন্ত্রে অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি করে। আমে বেটা ক্যারোটিন, ভিটামিন ই এবং সেলেনিয়াম আছে যা হার্টের সমস্যা প্রতিরোধ করে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট স্তন ক্যানসার, লিউকেমিয়া, কোলন ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমে থাকা খনিজ লবণ দাঁত, নখ ও চুল মজবুত করতে বেশ সহায়ক। এর এনজাইম মানুষের শরীরের প্রোটিনের অণু ভেঙে ফেলে, ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। যদি নিয়মিত আম খাওয়া যায়, তাহলে শরীরের স্থূলতা কমবে। এতে থাকা ম্যালিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড ও টারটারিক অ্যাসিড শরীরে ক্ষার ধরে রাখে। আমের আয়রন রক্তস্বল্পতা সমস্যা দূর করার পাশাপাশি রক্তও পরিশোধন করে।
তেতো স্বাদের হলেও আমের খোসায় আছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্স, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। রোদে শুকিয়ে, তারপর ভেজে কিংবা সেঁকে এটি খেতে হয়। এতে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। আমের খোসায় মূলত উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া রক্তের সুগার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে আমের খোসা। সুরক্ষা দেয় কিডনির, চোখেরও। ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এটি। আর্থ্রাইটিস ও আলঝেইমার রোগের শঙ্কা কমিয়ে দেয়। এতে থাকে প্রদাহরোধী উপাদান।
যারা নিজের ত্বকের খেয়াল রাখেন, তাদের জন্যও আমের খোসা উপকারী। এটি বলিরেখা দূর করে। আমের খোসায় থাকা ভিটামিন সি ত্বকের জন্য ভালো।
এবার আরেকটু ভেতরে, মানে খোসা ও আম ভেদ করে সরাসরি বড়ায় ঢোকা যাক। বড়া হলো আমের আঁটি। এটিও ফেলনা নয়। খুশকি দূর করতে আমের আঁটি শুকিয়ে গুঁড়া করে মাথার তালুতে ব্যবহার করতে পারেন।
আমের বীজ খেলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে। অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগলে নির্যাস সেবন করতে পারেন। চর্বি কাটতে আমের বীজের জুড়ি নেই। ডায়রিয়া উপশমে এটি কাজে আসে। এ ক্ষেত্রে বীজ শুকিয়ে পানির সঙ্গে গুলে খেতে হয়। আমের মতোই এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
আমের পুরোটাই তো শরীরের উপকারে এলো। পাতা বাদ যাবে কেন! এর পাতায় আছে প্রচুর ভিটামিন, এনজাইম, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ফ্ল্যাভোনয়েড ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল। আম পাতা ফুটিয়ে বা গুঁড়া করে খেলে এর ঔষধি গুণ পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কচি আম পাতা রান্না করে খাওয়া হয়। তরকারি ছাড়াও আছে আম পাতার চা। প্রতিদিন এক কাপ আম পাতার চা পান করলে উচ্চ রক্তচাপ কমে। পাতায় ট্যানিন ও অ্যান্থোসায়ানিন থাকায় তা ডায়াবেটিস নিরাময়ে সহায়তা করে। এ ছাড়া শ্বসনতন্ত্র ব্যামো সারাতে কাজে আসে আম পাতার চা। অস্থিরতা দূর করতেও সহায়ক। এটি স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে। যারা ব্রঙ্কাইটিস বা অ্যাজমা এবং ঠান্ডায় ভুগছেন, তারা আম পাতা ফোটানো পানি পান করে উপকৃত হতে পারেন।
হালকা গরম করে আম পাতা কানের ছিদ্রের ওপর ধরলে কানের ব্যথা সেরে যায়। গেঁটে বাত নিয়ন্ত্রণেও এর ভূমিকা আছে। কচি আম পাতা পানিতে ফুটিয়ে সেই পানি প্রতিদিন পান করলে গেঁটে বাত সারে।
কিডনিতে পাথরজনিত সমস্যা দূর করতেও আমের পাতা খাওয়া হয়ে থাকে। পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে পানিতে মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে কিডনির পাথর অপসারণ হবে। এ ছাড়া গলা ব্যথা উপশমে আমের পাতা পুড়তে দিয়ে সেই ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিলে ব্যথা দূর হয়।
আমের পাতাযোগে পানি ফুটিয়ে তা নিয়মিত পান করলে মুখের দুর্গন্ধ, দাঁত ও মাড়ির সমস্যা ভালো হয়ে যায়। কচি আমের পাতায় ঘি ও চন্দন মেখে শুঁকলে বমি ভাব দূর হয়।
আমগাছের ছাল বেটে ৪৫০ গ্রাম পানিতে সেদ্ধ করে নিতে হয়। পানি শুকিয়ে যখন ১০০ গ্রাম হলে তা নামিয়ে পান করলে কৃমিজনিত সমস্যা থাকে না।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট