বিশেষ ফিচার I বিবাহবাণিজ্য
সারা বিশ্বেই মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট বিয়ে। দিনকে দিন এই আয়োজন বিস্তার করেছে নানা শাখা। হয়ে উঠেছে অযুত অর্থের ইন্ডাস্ট্রি। বিয়ে বাণিজ্যের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন সেলিব্রিটি শেফ শুভব্রত মৈত্র
বিশ্বের প্রায় সব সংস্কৃতিতেই বিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ লোকাচারও বটে। প্রায় সব সমাজেই বিয়েকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। তবে বিয়ের লোকাচার কোনো কোনো সংস্কৃতির মধ্যে বেশি, কোথাওবা কম। কিন্তু লোকাচার যাই হোক না কেন, বিবাহনুষ্ঠানের আড়ম্বর বিশ্বের সব প্রায় সমাজেই চোখে পড়ার মতো। আর এই বিয়েকে ঘিরেই আবর্তিত হয় নানা ধরণের ভোক্তা চাহিদা ও পণ্যের যোগান; বিয়েকে তাই একটি বহুমাত্রিক ইন্ডাস্ট্রি বললেও ভুল বলা হয় না। বিয়েকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠানের দিক থেকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ হল ভারতও বাংলাদেশ। পাকিস্তানেও অবশ্য বিবাহ অনুষ্ঠান ভারত-বাংলাদেশের মতোই ব্যয়বহুল। আর এই উপমহাদেশের পরেই বিবাহকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খরচের অঙ্ক চোখে পড়ার মতো। তবে উপমহাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছরের ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রির টার্নওভার অনেকটাই বেশি। এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর সংখ্যায় পুনর্বিবাহের অনুষ্ঠান হয়, যা উপমহাদেশে নগন্য বললেই চলে।
বিশ্বের নানা অঞ্চলের বিয়ে ও একে ঘিরে তৈরি হওয়া ইন্ডাস্ট্রির উপাদানের বিষয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করবো। বিশ্বের নানা অঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে বেশ কিছু সাধারণ উপাদান রয়েছে, আবার অঞ্চলভেদে নানারকম পার্থক্যও স্পষ্ট।উপমহাদেশে এই ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক টার্নওভার ১৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর এর বৃদ্ধির হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে উপমহাদেশে একটি বিয়ের জন্য খরচ হয় গড়ে ৬ লাখ টাকা থেকে ৬ কোটি টাকা। উপমহাদেশে এই ইন্ডাস্ট্রির বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। যার মূল্য আনুমানি ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এর বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ। আর উপমহাদেশের ম্যারেজ ইন্ডাস্ট্রির প্রতিপক্ষ আমেরিকার বিবাহ ইন্ডাস্ট্রির আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
যতদিন যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিয়ের বাজারের প্রগতির ছবিই স্পষ্ট হচ্ছে। এই অঞ্চলের বিয়ের বাজার পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে যে বিয়েকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিয়ের বাজারে ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা ক্রমবর্ধমান। ঐতিহ্য ও লোকাচার অনুসরণ করে বিয়ের থেকে বাংলাদেশ ও ভারতে বিবাহনুষ্ঠানের চেহারা দিনকে দিন কর্পোরেট রূপ নিচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার নিরিখে দুই রাষ্ট্রে মোট পরিবারের সংখ্যা সাড়ে তিনশো মিলিয়নের বেশি। এর থেকেই বোঝা যায় প্রতিনিয়ত বিয়ে কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান কী হারে বেড়ে চলেছে এই দুই রাষ্ট্রে। উভয় দেশের পরিবার প্রতি গড়ে ৩০-৪০ গ্রাম সোনা কেনা হয়ে থাকে। যদি ধরা হয় দুই রাষ্ট্রে প্রতিবছর ১ কোটি বিয়ে হয়, তাহলে দুই রাষ্ট্রের বিবাহ ইন্ডাস্ট্রিতে ভারতীয় মুদ্রার নিরিখে ১ লাখ কোটি রুপি থেকে ৫ লাখ কোটি রুপির টাকার বার্ষিক টার্নওভার ১ লাখ থেকে ৫ লাখ রুপি।
ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রির নানা শাখা
যতদিন যাচ্ছে, ততই বিয়েকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে বিনোদন, মনোরঞ্জনের নানা পরিসর। আর বিবাহানুষ্ঠানের তাক লাগানো আয়োজন তো আছেই। আর তাই বিয়ের আগে ও পরে এবং বিবাহনুষ্ঠান পর্বের নানা আয়োজনকে ঘিরে প্রসারিত হচ্ছে এই ইন্ডাস্ট্রি ও এর সহযোগী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের পসার জমছে। ওয়েডিং প্ল্যানার, ডেকোরেটরস, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, মধুচন্দ্রিমার জন্য ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি আর পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের জন্য ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট- এসব কিছুই এই ইন্ডাস্ট্রির নানা শাখার ব্যবসায়িক উদ্যোগই ব্যাপক আকার দিয়েছে ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রিকে। ট্র্যাডিশনাল বিয়ের ক্ষেত্রে ডেকরেটর বা মন্ডপশিল্পীদের আজও ব্যাপক গুরুত্ব। এখন ওয়েডিং প্ল্যানারদের অতিরিক্ত গুরুত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার সমাজের হোয়াইট কলারদের বিয়ের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল ওয়েডিং প্ল্যানাররাও এখন বেশ জনপ্রিয়।
এছাড়া, খাবার, পোশাক, খাদ্যসামগ্রী, ফুল, গয়না, লৌকিক উপকরণসহ বিয়ের অনুষ্ঠানের দশদিকের দশরকম বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রাসঙ্গিক। বিয়ের অনুষ্ঠানের জায়গা নির্বাচনকে ঘিরেও নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করা হচ্ছে আজকাল। বিয়ের অনুষ্ঠান ও অতিথিদের থাকার বন্দোবস্ত করার জন্য নির্বাচন করা হচ্ছে রাজকীয় জায়গা; এক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হচ্ছে বিশেষ বিশেষ থিম। এই থিম অনুযায়ী পার্টিতে অতিথিদের একইরকম পোশাক পরে আসার রীতি চালু হয়েছে।
খাবারের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে বিয়ের অতিথি আপ্যায়নের জন্য রসনাসম্ভার বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাধারণ বিয়েতে আঞ্চলিক ট্র্যাডিশনাল খাবারের বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন থাকলেও, অভিজাত শ্রেণীর বিয়েতে রাখা হচ্ছে লেবানিজ থেকে ইতালিয়ান নানা পদ। এছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ফোটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফির চর্চাও ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাভিত্তিক ব্যবসা।
মধ্যপ্রাচ্যে যারা বসবাস করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছেন বিয়েকে কেন্দ্র করে কী ধরণের রাজকীয় আয়োজন করা হয়। বিয়ের জায়গা, রিসেপশন, পার্টি, অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন- সব কিছুতেই থাকে অভিনবত্ব। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৪০০০ কোটি টাকার বিয়ে ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে।
ইন্ডাস্ট্রির পেশাদারিত্ব
ফুল, ডেকরেটর, ক্যাটারার, ওয়েডিং প্ল্যানার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যেসব বাণিজ্যিক উদ্যোগ সম্পর্কিত, সেগুলো পেশাদারিত্বের সঙ্গে এই ইন্ডাস্ট্রির প্রসার ঘটাচ্ছে। উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পেশাদারিত্ব নির্বাহ করছে ভেন্ডোরদের মাধ্যমে। ইন-হাউজগ্রুপগুলো গাড়ি ভাড়া করা থেকে শুরু করে ফুডিং-লজিং-এর বন্দোবস্ত করার মতো বড় পরিসরে কাজ করে চলেছে। আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলো পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে সমন্বয় চোখে পড়ার মতো।
ডেস্টিনেশন ওয়েডিং
বিয়ে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যারা করেন, তারা বিয়ের জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন স্থান নির্বাচন করছেন যেখানে একসঙ্গে বিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয় সহজলভ্য হয়। অতিরিক্ত বিনিয়োগ নয়, অথচ যতটা পারা যায় বিবাহনুষ্ঠানকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমার রন্ধনশিল্প ক্যারিয়ারে এমন অনেক ওয়েডিং প্ল্যানার দেখেছি, যারা বাজেট না বাড়িয়েই বিয়ের আয়োজনকে আকর্ষণীয় তোলায় গুরুত্ব দেন।
মোট কথা এই অতি আধুনিক পরিসরে উৎসব, লোকাচার ইত্যাদির আঙ্গিকে যেভাবে বদল আসছে, বিয়েবাণিজ্যেও এই পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বিয়ের আয়োজনেও আজকের উদার অর্থনীতির ছাপ স্পষ্ট। এই জটিল ও ব্যস্ত পৃথিবীতে বিয়ের যাবতীয় আয়োজনকে সীমিত সময়ে যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার নিয়ে ভাবনা হচ্ছে নানা ভাবে। যা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। মোদ্দা কথা এই সৃজনশীল ভাবনার পেছনে রয়েছে দুটি মানুষের যৌথযাপনের সূচনাকে বর্ণময় ও মাত্রাময় করে তোলা।
ছবি: সংগ্রহ