ফিচার I বিয়েখাবারের রেস্তোরাঁ
বাঙালির বিয়েবাড়ি স্থান করে নিয়েছে রেস্তোরাঁয়। বিবাহের অনুষ্ঠান হোক বা না হোক, মেনুতে থাকছে সেই ব্যবস্থা
ভোজনরসিক বাঙালি আর যা-ই করুক, বিয়ের দাওয়াত উপেক্ষা করে না। খাবারের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা প্রকাশ পায় বিয়েবাড়িতেই। যদিও বাংলাদেশের বিয়েবাড়ির খাবারে দীর্ঘদিন ধরেই কোনো বৈচিত্র্য নেই। ঘুরেফিরে একই- থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। হয় পোলাও-মাংস, রেজালা কিংবা বিরিয়ানি। সঙ্গে থাকে বোরহানি। শেষ পাতে মিষ্টান্ন, কখনো জর্দা, কখনো মিষ্টি বা দই। এটা বাংলাদেশি বিয়ের খাবারের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। একেই চার দেয়ালের মধ্যে সাজিয়ে রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে নগরীর জিগাতলায়। কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনের লিফটের আটে। ঢোকামাত্রই মনে হবে বিয়েবাড়িতে আগমন ঘটলো। মাথার উপর চেনা সেই শামিয়ানা, উল্টো করে ঝোলানো মেরুন ও সাদা কাপড়ের ছাতাগুলো অন্দরসজ্জায় চমক এনেছে। চোখ ঘোরাতেই বর-কনের স্টেজ, লাল হলুদ কাপড়ে কুঁচিতে নকশা করা। খাবার টেবিলের উপর সাদা কাপড় পাতা। আর চেয়ারগুলোর কাভারও একই রঙের। হেলনায় লাল কাপড় গিঁট দেওয়া। রিসেপশনের টেবিল ঝিলিমিলি পর্দায় আবৃত। চোখ ধাঁধায়। এমনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা এসেছে রেস্তোরাঁর মালিক আতিয়া রহমান পুষ্পের মাথায়। নকশা ও খাবারের প্রকরণে মিল রেখে রেস্তোরাঁর নামকরণ হয়েছে ‘বিয়ে বাড়ী’। এখানকার হেঁশেলে বাংলাদেশি বিয়ের খাবারের বাইরে আর কিছুই রান্না হয় না। রাঁধেন দুজন বাঙালি শেফ। মিষ্টান্ন তৈরি হয় তাদের হাতেই। গোমাংস থেকে ইলিশ, আমিষ কিংবা নিরামিষ- বিয়েতে রান্না হয় এমন সব পদের ব্যবস্থা করা সম্ভব এখানে। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান- সব ধর্মের বিয়ের আয়োজনের সুযোগ রয়েছে এ রেস্তোরাঁয়। এমনকি কেউ যদি এখানে বিয়ের কাবিন সারতে চায়, তা-ও সম্ভব। কাজির ব্যবস্থা করে দেবে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ।
বিয়ে বাড়ী রসনাবিলাস, কারি সমাহার, বিয়ে বাড়ীর থালা, সন্ধ্যাকালীন, শরবতে উৎসব, মিষ্টান্ন এবং ফ্রেশ জুস ও অন্যান্য- এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করা আছে এখানকার মেনু চার্ট। বিয়ে বাড়ীর রসনাবিলাসে পাবেন বাসমতী চালের বিয়ে বাড়ী স্পেশাল কাচ্চি বিরিয়ানি, বিফ তেহারি, মোরগ পোলাও ও প্লেইন পোলাও। বিয়ে বাড়ী স্পেশাল মাটন লেগরোস্ট, মাটন রেজালা, আচারী বিফ, বিফ কালাভুনা, বিয়ে বাড়ী স্পেশাল চিকেন রোস্ট, চিকেন ঝাল ফ্রাই, রুপচাঁদা ফ্রাই, ইলিশ ফ্রাই, রুই ফ্রাই, চিংড়ি মালাইকারি, ডিমের কোরমা, সবজি, জালি কাবাব মিলবে কারি সমাহার তালিকায়। বিয়ে বাড়ীর থালা বলতে তিন ধরনের থালা পাওয়া যাবে। চিকেন রোস্ট, স্যালাড, ফিরনি কিংবা জর্দা এবং বোরহানি অথবা কোমল পানীয় মিলে এক থালা। মোরগ পোলাও, কাবাব, বিফ রেজালা ও স্যালাডের সঙ্গে ফিরনি, জর্দা কিংবা মিষ্টি- এ তিনটির যেকোনোটি, বোরহানি অথবা কোমল পানীয় মিলে অন্য থালা এবং প্লেইন পোলাও, চিকেন রোস্ট, কাবাব, বিফ রেজালার সঙ্গে ফিরনি, জর্দা ও মিষ্টির মধ্যে একটি এবং বোরহানি ও কোমল পানীয় মিলে আরেক থালা। সন্ধ্যাকালীন খাবারে আছে ফুচকা, চটপটি, দই ফুচকা, বিয়ে বাড়ী স্পেশাল দই ফুচকা, নান, রেশমি কাবাব ও চিকেন তন্দুরি। এ ছাড়া ‘সন্ধ্যাকালীন থালা’ নামে একটি ডিশ আছে, সেখানে চিকেন তন্দুরি, লাঠি কাবাব, নানরুটি ও ডাল মাখনি থাকে। শরবত বলতে পাওয়া যাবে বোরহানি, পেস্তাবাদাম শরবত, লাবাং, মাঠা, আকবরি লাচ্ছি ও কেশর লাচ্ছি। মিষ্টান্নে পাবেন রসগোল্লা, গোলাপজাম, স্পঞ্জ স্পেশাল, বিয়ে বাড়ী ফিরনি, জর্দা, বিয়ে বাড়ী স্পেশাল জাফরানি মালাই কুলফি, ফালুদা ফ্রুট কাস্টার্ড ও পুডিং। মেনু চার্টের ফ্রেশ জুসসহ পাবেন কোমল পানীয়, জলজিরা, তেঁতুল শরবত, কাঁচা আমের শরবত, আনারস, তরমুজ ও পাকা আম, স্ট্রবেরি, জামরুল ও জামের শরবত, মাল্টা, আনার, লাইম সোডা, মাসালা লেমন মিন্ট, লেমন জুস, মিন্ট লেমন, মিল্কশেক, কফি ও কোল্ড কফি। তবে ফলের শরবতগুলো ঋতু বুঝে পাওয়া যাবে।
বিয়ে বাড়ী রেস্তোরাঁর যে পদের কথা না বললেই নয়, তা হচ্ছে পান। সাদা পান, মিষ্টি পান, শাহি মিষ্টি পান ও বিয়ে বাড়ী স্পেশাল পান নামে চার ধরনের পান পাওয়া যাবে। বাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, নারকেল ও মোরব্বার মিশেলে তৈরি হয় বিয়ে বাড়ী স্পেশাল পান। চুন ও জর্দা আলাদাভাবে দেওয়া হয়।
রেস্তোরাঁটির এসব খাবারের মধ্যে অতিথিদের চাহিদা থাকে স্পেশাল কাচ্চি ও মোরগ পোলাওয়ের প্রতি। আমরা এ দুটি ডিশই নিলাম। সঙ্গে নিলাম বোরহানি ও গোলাপজাম। এ দুই সহপদ নেওয়ার কারণ হচ্ছে, বোরহানি ও গোলাপজাম বিয়ে বাড়ী রেস্তোরাঁর শেফরাই তৈরি করেন। অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব পদ উপস্থিত হলো। কাচ্চি ও মোরগ পোলাওয়ের পরিমাণ খুব বেশি হলো। মনে হলো, একজনের পক্ষে এক থালা খেয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা দুজনেই দুই থালা শেষ করতে পারলাম। এর কারণ, বিয়ে বাড়ীর খাবারে তেলের আধিক্য নেই এবং মাটন ও মোরগে যে মসলা ব্যবহার করা হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ব্যবসার গোপনীয়তার স্বার্থে শেফের কাছ থেকে রেসিপি জানা গেল না। খেয়ে মনে হলো, সত্যিই কোনো বিয়েবাড়ির খাবার খেয়ে উঠলাম। বোরহানিও সুপেয়। অতি ঝাল কিংবা টকের বালাই নেই। আর গোলাপজামটা খুব তুলতুলে। মুখে দিতেই জিভে মিশে একাকার।
তখন দুপুরবেলা। ধীরে ধীরে দল বেঁধে অতিথি আসছে। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার জানালেন, লাঞ্চের সময়ই তাদের ভিড় বাড়ে। তাই প্রতিদিন দুপুর ১২টার পর থেকে খোলা হয় রেস্তোরাঁ। বোঝা গেল, এখানে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু লাঞ্চ ও ডিনার। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ চালু হয়েছিল রেস্তোরাঁটি। ১৫০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে এখানে। ১৯ জন কর্মী দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ছোট আয়োজনের গায়েহলুদ, বিয়ে, বউভাত কিংবা জন্মদিনের পার্টি করা যায়। খেয়াল করলে দেখা যাবে বিয়ে বাড়ীর মেনু চার্টে ‘জামাই থালা’ নেই। তার মানে এই নয় যে এখানে জামাই থালা হয় না। কনেপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী গরু, খাসি, মুরগি কিংবা মাছ দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয় জামাই থালা। আপাতত জিগাতলা ছাড়া তাদের আর কোনো শাখা নেই। তবে উত্তরায় একটি শাখা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন