ফিচার I শীতের ওয়েলিংটন স্কয়ার
শীত এলেই মেলা বসে কলকাতা ওয়েলিংটন স্কয়ারে। সেখানে শীতবস্ত্রের পসরা। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাবেশে উষ্ণ হয়ে ওঠে এলাকাটি
বঙ্গের ছয় ঋতুর মধ্যে নানা দিক থেকে শীতের আয়োজন একটু বেশিই। তা সে উৎসবের দিক থেকে হোক অথবা ভ্রমণের; কিংবা খাদ্যবৈচিত্র্যে বা শীতের পোশাকসম্ভারে। অন্য সব ঋতুর তুলনায় শীতের পোশাক স্বতন্ত্র। কারণ, হিমেল হাওয়া ও ঠান্ডা থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সেজে উঠতে হয় বিশেষভাবে। নানা রকম মোটা কাপড় আর উলের পোশাকে এই ঋতু হয়ে ওঠে রঙিন। কিন্তু বাঙালির শীত ঠেকানোর পরিধেয় সংগৃহীত হয় কোত্থেকে? একসময়কার অখন্ড বাংলার বাণিজ্যকেন্দ্র এবং আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় এর জবাব মিলবে একটি বিশেষ এলাকা থেকে। জায়গাটির নাম ওয়েলিংটন স্কয়ার। শীতের উষ্ণ পোশাকের পরিযায়ী-বাণিজ্যের জন্য এটি বিখ্যাত।
সারা বছর নয়, কেবল হেমন্তের শেষ থেকে বসন্তের শুরু অবধি টানা দু-তিন মাস শাল-সোয়েটারসহ উষ্ণ পোশাক কেনাবেচা এখানে চলে। যেভাবে কলকাতার অদূরে হাওড়ার সাঁতরাগাছি এলাকার ঝিলে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে পরিযায়ী পাখি, ঠিক তেমনই শীতবস্ত্রের পরিযায়ী বাণিজ্যের জন্য নানা জায়গা থেকে ওয়েলিংটনে হাজির হন খুচরা শীতবস্ত্র বিক্রেতারা। কেউ আসেন পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় পার্বত্য এলাকা দার্জিলিং থেকে, কেউ আবার প্রতিবেশী রাজ্য বিহার ও সিকিম থেকে, এমনকি ভারতের প্রতিবেশী নেপাল আর ভুটান থেকেও তাদের আগমন ঘটে। শীতের মিঠে রোদে অস্থায়ী দোকানে উল কিংবা পশম অথবা চামড়ার পোশাকের পসরা সাজিয়ে তোলেন তারা। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মানুষের ভিড় জমে যায় এই এলাকায়। উদ্দেশ্য, শাল-সোয়েটার-জ্যাকেট-কার্ডিগান-মাফলার-টুপি-হাতমোজা ইত্যাদি কেনা।
ওয়েলিংটন স্কয়ার মধ্য কলকাতার অত্যন্ত ব্যস্ত এলাকা। ঐতিহাসিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। এর অবস্থান ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড-সংলগ্ন চাঁদনী চকের পেছনে। পাশেই তালতলা, রফিক আহমেদ কিদওয়াই রোড, মৌলানা আজাদ কলেজ (একসময়ের ইসলামিয়া কলেজ। এখানে পড়াশোনা করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান), আলিয়া মাদ্রাসা, মুসলিম ইনস্টিটিউট, নিউমার্কেট, মৌলালী। অন্যদিকে বউবাজার, কলেজস্ট্রিট। এই এলাকায় বিখ্যাত ব্যারিস্টার গণেশ চন্দ্র চন্দ্রের বাড়ি, তাঁর নামানুসারেই ওয়েলিংটন-সংলগ্ন রাস্তার নাম গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ। এই বাড়ির দুর্গাপূজা বিখ্যাত। চন্দ্রবাড়ির কৃতী সন্তান শিক্ষাবিদ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র। এই বাড়িতে আসতেন সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ বরেণ্য নেতা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিলের প্রধান একটি কেন্দ্র ছিল ওয়েলিংটন স্কয়ার। এই এলাকায় থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের একসময়কার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। বাংলা ভাগের আগে ১৯৪৬-এ এখানে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা; যা গোটা বেঙ্গল প্রভিন্সে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের পর নানা সময় উত্তপ্ত হয়েছে এলাকা। কখনো কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাস-ট্রামভাড়া বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, কখনোবা খাদ্য আন্দোলনে। আবার সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়ও এই এলাকা রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত ছিল। এখানে রয়েছে বাংলা মদের বিখ্যাত শুঁড়িখানা, নাম খালাসিটোলা। যেখানে পানপাত্রসহ আড্ডা দিতেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দিকপালেরা—কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, তারাপদ রায়, দীপক মজুমদার প্রমুখ।
শীত আসার আগে ওয়েলিংটনের শীতবস্ত্রের দোকানগুলোর ঝাঁপ খুলে যায় দিনের শুরুতেই। সারি বেঁধে সেজে ওঠা দোকানগুলো দেখে মনে হয় শীতের মেলা বসেছে। ব্যস্ত এই এলাকাকে শীতবস্ত্রের দোকানগুলো মেলাপ্রাঙ্গণের আকার দিয়ে ফেলে। সকালে শুরু হয়ে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত এটি চলে। হাসিমুখে দোকানদারেরা ক্রেতার সামনে মেলে ধরতে থাকেন নানা দামের ও ডিজাইনের শীতবস্ত্র। কোনোটা পুরোপুরি উলের বুনটে ঠাসা, কোনোটা ক্যাশমিলান দিয়ে তৈরি। কোনো কোনো শীতবস্ত্রে চোখে পড়ে সুতার কাজের বাহারি বুনন। দাম সাধ্যের মধ্যেই। ভারতীয় ২০০-৩০০ টাকায় মোটামুটি টেকসই ও ফ্যাশনেবল শীতের পোশাক যেমন সেখানে অনায়াসে মেলে, তেমনি বেশি দামের শীতবস্ত্রের সংগ্রহও রয়েছে দোকানিদের কাছে। এই এলাকায় ভারতীয় ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় নেপালি শাল। তবে ভুটানি পোশাকে খরচ আরেকটু বেশি। একেকটি দোকান ঘুরে যা বোঝা যায়, তা হলো ভুটানি শীতের পোশাকের দাম শুরু হয় ভারতীয় ৫০০ টাকা থেকে। এই মেলায় মিলবে ভারতীয় ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে সুদৃশ্য ও টেকসই সব ব্ল্যাঙ্কেট। পুরুষ ও মহিলাদের সোয়েটার, কার্ডিগান, জ্যাকেট, শাল, মাফলার ও টুপির বিরাট সম্ভার নিয়েই প্রতিবছর পরিযায়ী এই বাণিজ্য চলে। সব রকম আর্থিক সামর্থ্যরে মানুষের জন্য শীতবস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে এখানে। একইভাবে প্রবীণ থেকে নবীন—সব বয়সের মানুষের জন্যই বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে আনা হয় হরেক রকম গরম পোশাকের সম্ভার। বিক্রি ও চাহিদার নিরিখে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই মহিলাদের শ্রাগ, পশমের টপ, কলকা আঁকা বা চেক প্রিন্টের চাদর, স্টোল, লং স্যুট। বাচ্চাদের মন জয় করতে এখানে রয়েছে জ্যাকেট স্যুট, উলের পোশাক। শীতের পোশাকে পুরুষদের সপ্রতিভ লুক দিতে হরেক রকমের জ্যাকেট স্যুট, কোট, হাফহাতা সোয়েটার মিলবে। অন্যদিকে, যারা আজও উলের কাঁটা আর পশম উল দিয়ে নিজ হাতে সোয়েটার বানাতে চান, তাদের জন্যও এখানে সাজানো থাকে রঙবেরঙের উলের সম্ভার।
ওয়েলিংটন স্কয়ারে যারা শীতবস্ত্র বিক্রির জন্য জমায়েত হন, শীত ফুরিয়ে গেলেই অস্থায়ী এই ব্যবসা গুটিয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়। বছরের বাকি সময়ে বিভিন্ন পেশা বা কাজে নিয়োজিত থাকলেও তারা শীতের অপেক্ষায় থাকেন। কারণ, মৌসুমটি তাদের বাড়তি উপার্জনের উৎস। ভেন্যু কল্লোলিনী কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়ার।
অতনু সিংহ
ছবি: ইন্টারনেট