skip to Main Content

ফিচার I জিরো ডেনিম

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এখন ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও সক্রিয়। বিশেষত ডেনিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবন করছে এমন সব পদ্ধতি ও প্রযুক্তির; যেগুলো পৃথিবীকে প্রাণবান্ধব করে তুলবে

জিনস ও ডেনিম এমন একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড, যা কখনোই পুরোনো হবে না। বিশ্বে খুব কম মানুষই আছেন, যাদের ওয়্যারড্রোবে অন্তত একটি জিনস অথবা ডেনিম খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর জন্য খুব যে ফ্যাশন-সচেতন হতে হবে, তা কিন্তু নয়। ক্যাজুয়াল ওয়্যার হিসেবে জিনসের জনপ্রিয়তা সবার ওপরে। এক দশক আগে থেকেই অনেকে অফিসেও জিনস বা ডেনিমের প্যান্ট পরছেন। ডেনিমের শার্ট, স্কার্ট, ব্যাগের চাহিদাও বিপুল। তবে অনেক ডেনিমপ্রেমীই হয়তো জানেন না, তাদের প্রিয় এই প্যান্টগুলো বানাতে পরিবেশকে কী মূল্যটাই দিতে হয়!
পরিবেশদূষণের জন্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির রয়েছে অনেক বদনাম। আর সেই বদনামে ঘি ঢালার মতো তথ্য হলো, একটা ডেনিম প্যান্ট বানাতে খরচ হয় অন্তত ৭ হাজার লিটার স্বচ্ছ পানি! মানে একজন মানুষ ৬ বছরে যে পরিমাণ পানি পান করে, একই পরিমাণ দিয়ে তৈরি হয় পরিধেয় প্রতিটি ডেনিম। আর প্যান্টে রঙ করার জন্য যে কেমিক্যাল ডাই ব্যবহার করা হয়, তা খুবই ক্ষতিকর। ডেনিমে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কেমিক্যাল ইন্ডিগো। এগুলো বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকর রাসায়নিক তেল এবং ইঁদুরের বিষ থেকে তৈরি। ডেনিমে কেমিক্যাল শুধু রঙের জন্য নয়, কাপড় নরম করার কাজেও লাগে। এটি যেখানে উৎপাদন করা হয়, বিশেষ করে ধোয়া হয়, তার আশপাশের জমির উর্বরতা কমে যায়। পাশাপাশি এর তরল বর্জ্য জলাশয় ও পানির অন্যান্য উৎসকে দূষিত করে। এখন কারোরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ডেনিম পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে।
তবে সুখের বিষয়, কয়েক বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় সাসটেইনেবল ফ্যাশনের চর্চা শুরু হয়েছে। আর সেই সুবাতাসে ভেসে ফ্যাশন বিশ্বে এসেছে ‘জিরো ওয়েস্ট ডেনিম’। এটি হলো ডেনিমের একধরনের সাসটেইনেবল কালেকশন, যা তৈরিতে খুব কম পানি ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমের অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ড এখন এ ধরনের পোশাক বাজারে এনেছে। উদ্দেশ্য একটাই—কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে ডেনিম তৈরি করা যায়। এ জন্য একেক কোম্পানি একেক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বাদ যাচ্ছে না লেজার টেকনোলজি, পিছিয়ে নেই রিসাইকেল পদ্ধতি। সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ডেনিম।
ফেব্রিক: জিরো ওয়েস্ট বা সাসটেইনেবল ডেনিম প্রস্তুতে অবশ্যই সাসটেইনেবল ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রিসাইকেল কটন, অর্গানিক কটন, বিসিআই কটন, লাইওসেল (একধরনের রেয়ন) ফেব্রিক ইত্যাদি। এ ছাড়া পলিয়েস্টার ফেব্রিকও ব্যবহার করা হয়।
ন্যানো বাবল টেকনোলজি: এই পদ্ধতিতে খুব কম পানি ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে ডেনিম পরিষ্কার করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতির মতো এতে কোনো ধরনের স্টোন ওয়াশের প্রয়োজন হয় না। এখানে পানি ও কেমিক্যাল একসঙ্গে মিশিয়ে যে মাইক্রোবাবল তৈরি করা হয়, তাতে একধরনের ফিশিং ইফেক্ট দেয়, ফলে শুধু বিশাল পরিমাণ পানিই নয়, সাশ্রয় হয় কেমিক্যাল এবং শক্তিও।
লেজার টেকনোলজি: ড্রাই প্রসেস যেমন হুইস্কার, স্যান্ডলিং, ডিস্ট্রাকশন—সবই লেজার মেশিনে করা সম্ভব। এতে কম শক্তি খরচ হয়। কোনো ক্ষতিকর পিপি স্প্রে, পানি ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
ওজোন মেশিন: প্রচলিত পদ্ধতিতে ডেনিম ব্লিচ করার জন্য সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা হয়। ওজোন মেশিনে এসব রাসায়নিক ছাড়াই অল্প পানি দিয়ে ব্লিচ করা যায়।
সাসটেইনেবল গার্মেন্ট ডাইয়িং টেকনোলজি: খুব সহজে পরিবেশবান্ধব রঙ দিয়ে কাপড় রাঙানোর পদ্ধতি হচ্ছে সাসটেইনেবল গার্মেন্ট ডাই টেকনোলজি। ডেনিম রঙ করতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এভাবে ডেনিম প্রস্তুত করে ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির চেয়ে ৮০% পানি, ৬০% শক্তি বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে। আর কেমিক্যালের ব্যবহার ৫০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কম। যেসব ব্র্যান্ড সাসটেইনেবল ডেনিম বানাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে জিনোলোজিয়া, মাড জিনস, লিভাইস, এভারলিন ইত্যাদি।
জিনোলোজিয়া এবং মাড জিনস যে ওজোন টেকনোলজি ব্যবহার করছে, তাতে একই সঙ্গে ডেনিম উৎপাদনে পানি, এনার্জি এবং কেমিক্যালের ব্যবহার অনেকাংশে কমে আসছে। এভারলিন ডেনিমের জিনস বানানো হয় সাইটেক্সে, যা বিশ্বের সবচেয়ে স্বচ্ছ ডেনিম ফ্যাক্টরি। এখানে পানি রিসাইকেলের সুব্যবস্থা আছে। একটি এভারলিন ডেনিম বানাতে মাত্র ০.৪ লিটার পানি খরচ হয়। ওয়ারপ প্লাস ওয়েফট পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ডেনিম। এবং সাশ্রয় করেছে ৫৭২.৪ মিলিয়ন গ্যালন পানি। ওয়ারপ প্লাস ওয়েফট ডেনিম প্রস্তুতে ব্যবহার করে অর্গানিক কটন, পরিবেশবান্ধব রঙ, পানিসাশ্রয়ী টেকনিক এবং সোলার পাওয়ার। আউটারনোনের সিএআই ১০০ ভাগ অর্গানিক কটন দিয়ে জিনস প্রস্তুত করছে, লাইফটাইম গ্যারান্টির সঙ্গে। যদি কোনো জিনসের প্যান্ট বা অন্য প্রডাক্ট ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ঠিক করার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
বিশেষ করে বলতে হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেনিম ব্র্যান্ড লিভাইসের কথা। ২০১০ সালে তারা প্রথমে বাজারে এনেছিল বেটার ইনিশিয়েটিভ কটন (বিসিআই) ফেব্রিকের জিনস। এই তুলা উৎপাদনে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এখন ২০ ভাগ বিসিআই ব্যবহার করে ডেনিম ছাড়াও আরও অনেক প্রডাক্ট বানানো হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে এর ব্যবহার ১০০ ভাগ করা হবে। এ ছাড়া ডেনিম প্রস্তুতে লিভাইসের ‘ওয়াটার<লেস’ টেকনিক ব্যবহার করে সাশ্রয় করা হয়েছে ৩ বিলিয়ন লিটার পানি এবং রিসাইকেল করা হয়েছে ২ বিলিয়ন লিটার পানি। ৬৭% লিভাইস প্রডাক্ট এই ‘ওয়াটার<লেস’ পদ্ধতিতে বানানো হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য, ২০২০ সালের মধ্যে তা ৮০% এ নিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া এই ব্র্যান্ড সম্প্রতি লঞ্চ করেছে তাদের কটনস ব্লু জিনস গো গ্রিন প্রোগ্রাম, যেখানে ময়লার ভাগাড় থেকে সংগৃহীত জিনস ঘরবাড়ি বানানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার্থে সাসটেইনেবল ফ্যাশনচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় ডেনিম প্রস্তুতে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পরিবেশবান্ধব যেসব পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে, সেগুলোর প্রতিটি প্রশংসনীয়। আর হয়তো বেশি দিন নেই, যখন সব ডেনিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান একই পন্থা অবলম্বন করবে।

 ফাহমিদা শিকদার
মডেল: স্বরলিপি
ওয়্যারড্রোব: ইফাত ইরা হীরা,
তত্ত্বাবধানে তুষার কান্তি দাস,
শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top