ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ফ্যাশন ল্যাকমে ফ্যাশন উইক
এবারের ফ্যাশন উইকগুলোয় ছিল তরুণ ডিজাইনারদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। অতিমারির প্রেক্ষাপটে তারা জোর দিয়েছেন সাসটেইনেবল ও পরিবেশবান্ধব কালেকশনের ওপর। মিনিমালিজমের কদরও বেড়েছে। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
এ বছরও আয়োজিত হলো সব ফ্যাশন উইক। তবে প্রদর্শনীতে এসেছে পরিবর্তন। রানওয়ের জায়গা দখল করেছে ভার্চ্যুয়াল শো। ফ্যাশনের দুনিয়ায় ‘শো মাস্ট গো অন’! তাই অনিশ্চয়তার মধ্যেও অনুষ্ঠিত হলো উপমহাদেশের বিখ্যাত ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের প্রথম ডিজিটাল আসর।
এবারও নবীন-প্রবীণ ফ্যাশন ডিজাইনাররা তাদের সংগ্রহ নিয়ে হাজির। ২০ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই আসরে ডিজাইনাররা ভিন্ন আঙ্গিকে ফ্যাশন ফিল্মের মাধ্যমে নিজেদের সংগ্রহ পরিবেশন করেন। এই আয়োজনে পাওয়া গেছে নতুন স্টাইল ও ট্রেন্ডের আগমনী বার্তা।
এখনকার পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এবারের ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, ভার্চ্যুয়াল শোরুমের মাধ্যমে ডিজাইনার আর কারিগরদের সহায়তা করা এবং ক্রেতা ও গ্রাহকদের বিউটি ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযুক্ত করা। অন্যদিকে পাঁচ দিনের এই উৎসবে সর্বত্রই ছিল সাসটেইনেবল ফ্যাশনের জয়জয়কার।
প্রথম দিনের ইভেন্টে সবারই একটু বিশেষ নজর থাকে। কারণ, এদিন ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে অভিষেক হয় নবীন ডিজাইনারদের। মহামারির সময়ও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। আইএনআইডিএফ আয়োজিত ‘জেন নেক্সট’ শীর্ষক উৎসবের মাধ্যমে সারা দেশের প্রায় ৪০০ ডিজাইনারের ভেতর থেকে সেরা ডিজাইনাররাই পোশাক প্রদর্শন করেন। এবারের ডিজিটাল আয়োজনে আনমোল শর্মা, ভূমিকা, মীনাক্ষী, আরুষী- এই চারজন নিজেদের মেধাবিচ্ছুরিত ফ্যাশনসৃজন দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
‘মিশে’ লেবেলের স্বত্বাধিকারী ভূমিকা ও মীনাক্ষী সম্পর্কে মা-মেয়ে। মুম্বাইভিত্তিক এই জুটির সিগনেচার কালেকশনের নাম ছিল ‘শুওয়া’। বানানা এবং অরেঞ্জ পিল ফ্যাব্রিকের তৈরি পোশাকে ছিল বেইজ, হলুদ, গোলাপি শেড, নীল আর বেগুনি রঙের বাহার। জাপানি ইশারা-ভাষাপ্রাণিত সংগ্রহের প্রধান আকর্ষণ ছিল কাটওয়ার্ক এমবেলিশমেন্ট।
৩৪ বছর বয়সী আনমোল শর্মা সংগ্রহটি সাজিয়েছেন পুরুষের জন্য আকর্ষণীয় সব ইভনিং ওয়্যার দিয়ে। তার মতে, পোশাকগুলো স্ট্রিটওয়্যার হিসেবে যেমন পরা যাবে, তেমনি যেকোনো উৎসবেও মানাবে। ‘ড্রেস টু রিফর্ম’ নামের সংগ্রহটিতে ছিল ভাগলপুরের তাঁতিদের হাতে বোনা আহিম্সা সিল্ক, প্রাকৃতিক উপায়ে ইন্ডিগো ডাই করা ডেনিম, খাঁটি পাশমিনা, হাতে বোনা মঙ্গলগিরি সুতি কাপড়ের শার্ট, কুর্তা, প্যান্ট, জাম্প স্যুট।
জয়পুরভিত্তিক ডিজাইনার আরুষী ‘বিটুইন দ্য লাইন’ শীর্ষক কালেকশনের পোশাকগুলো তৈরিতে ব্যবহার করেছেন ‘আরাশি শিবরি’ নামের একটি ডায়িং টেকনিক। বেনারস আর মুর্শিদাবাদ থেকে সংগ্রহ করা চান্দেরি ও মটকা সিল্কের কাপড়ে বানানো বক্সি জ্যাকেট, ডাবল লেয়ার ড্রেস, ওভারসাইজ শার্টের মতো সময়োপযোগী পোশাকগুলো।
ল্যাকমে ফ্যাশন উইক মানেই ভারতীয় হস্তবুনন শিল্পের উদ্যাপন। যেমন অ্যানাভিলা মিশ্র। এই পোশাকশিল্পী তার কালেকশন সাজিয়েছেন লিনেন কাপড়ের উপর সূক্ষ্ম জরি এবং ঝাড়খন্ডের ‘খাতওয়া’ বুননের কাজ দিয়ে। কালেকশনের নাম ‘ধনক’, যার অর্থ রামধনু। সাত রঙে সাজানো সংগ্রহটিতে ছিল উৎসবের শাড়ি, কুর্তা, সালোয়ারসহ অনেক কিছু।
কালার ব্লকের জন্য পরিচিত পায়েল খান্ডওয়ালা এবারও এসেছেন সিগনেচার ‘টাচ’ নিয়ে। তবে একটু অন্য রূপে। পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ার তাঁতিদের হাতে বোনা জামদানি বুনন দিয়ে কালার ব্লক শাড়িতে এনেছেন ভিন্নমাত্রা।
তেলেঙ্গানা রাজ্যের ‘পুট্টাপাক্কা ইক্কত’ প্রিন্টকে নতুনত্ব দিয়েছেন ডিজাইনার রাজেশ প্রতাপ সিং। সত্য পল লেবেলের জন্য করা কালেকশনে, পোলকা ডটের ব্লাউজ শার্টের সঙ্গে মনোক্রোম ধাঁচের শাড়িতে ফুটে উঠেছে ডাবল ইক্কতের সৌন্দর্য।
অন্যদিকে আব্রাহাম অ্যান্ড ঠাকরের সংগ্রহ ভরা ছিল বেইজ আর গোল্ড টোনের উত্তর প্রদেশীয় ব্লক প্রিন্টে। সঙ্গে জোড় বেঁধে ছিল পোলকা ডট।
বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড র ম্যাংগোর স্বত্বাধিকারী সঞ্জয় গর্গ রাজস্থানের ছেলে। তার পোশাকের সংগ্রহ ‘মুমাল’-এর অনুপ্রেরণা রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, স্থাপত্য ও কারুশিল্প। এই অঞ্চলের বাঁধনি আর গোটা পাট্টি কাজের লেহেঙ্গা, শাড়ি, চোলি, ঘাঘড়া, চুড়িদার- সবারই বেশ নজর কাড়ে।
সুকেত ধীর প্রাচ্য-পাশ্চাত্যকে একই সুতায় গেঁথেছেন নিজের কালেকশনের মাধ্যমে। দেশীয় কাপড় আর বুননে তৈরি পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাকগুলো ছিল অসাধারণ। তার এথনিক সম্ভারে ছিল হাতে বোনা বেনারসি কাপড়ের হট প্যান্ট, স্ট্রাকচার স্যুট, কোট, প্যান্ট, মিডি জ্যাকেট, ফ্লেয়ারড ড্রেস, গ্যাদারড স্কার্ট।
দ্বিতীয় দিন উদযাপিত হয় ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে’ হিসেবে। নামজাদা ফ্যাশন ডিজাইনাররা তাদের টেকসই সংগ্রহ মেলে ধরেন সবার সামনে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হাজার হাজার প্লাস্টিকের বোতল থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি উচ্চমানের সুতি, সুতি-সিল্ক, শিফনের কাপড়ে বানানো আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল ট্রেন্ডি পোশাক নিয়ে হাজির পঙ্কজ-নিধি। এই দম্পতি তাদের সম্ভারের নাম দিয়েছেন ‘গ্রিন গোল্ড’।
বেনারসে জন্মানো ডিজাইনার হেমাঙ্গ আগারওয়াল। তার ‘তাওভা’ কালেকশনে বেনারসের শিল্পকলা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি জাপানের উচ্চমানের তন্তু বেমবারগের উপর বেনারসীয় ঘরানার জরির কাজ দিয়ে জল, বায়ু, অগ্নি, ভূমি, চন্দ্র, সূর্যের মতো প্রকৃতির ১২টি উপাদান তুলে ধরেন পোশাকগুলোতে।
ডিজাইনার জুটি অমিত-কাভেরি চোখ ধাঁধিয়েছেন ‘কুকুন’ সংগ্রহের দেশি খাদির পোশাক দিয়ে। সোনালি-রুপালি জরির সূক্ষ্ম কাজ আর হাতে বোনা সুতার কাজ দিয়ে সাদামাটা খাদির পরিধেয় উৎসবের পোশাকে রূপ দিয়েছেন তারা।
এবারের আয়োজনে প্রবীণ ডিজাইনার অমিত আগারওয়াল ভারতের সাবেকি শিল্পকলাকে আধুনিক রঙে সাজিয়েছেন। তিনি সিগনেচার রিসাইকেল পলিমার কাপড়ের সঙ্গে হাতে বোনা চান্দেরি ও মটকা সিল্কের মিশেলে নিয়ে এসেছেন ‘ফার্স্ট লাইট’ সংগ্রহটি। এতে ছিল শাড়ি, লেহেঙ্গা, ব্লাউজ আর দোপাট্টা। পোশাকগুলোতে ভেনাস ভায়োলেট, গামা গ্রিন, আর্থি প্লাম রঙের সঙ্গে গ্লিটারি গোল্ডের মিশেল আর জ্যামিতিক প্যাটার্ন বেশ চোখে পড়েছে।
হালের নামকরা ডিজাইনার মাসাবা গুপ্ত কোয়ার্কি প্রিন্টের জন্য বেশ বিখ্যাত। তিনি এবারের কালেকশন সাজিয়েছেন সত্তর দশকের ডিসকোপ্রাণিত পোশাক দিয়ে। তার সংগ্রহের বিশেষত্ব ছিল কোয়ার্কি অ্যাজটেক প্যাটার্ন।
নারীর পাশাপাশি পুরুষের পোশাক দেখা গেছে ফারহা সাঞ্জানার ‘রিসেট রিস্টার্ট’ কালেকশনে। এই সম্ভারে ক্যামোফ্লাজ ট্রাউজার, মিডি স্কার্ট, ডাবল ব্রেস্টেড ক্রপড জ্যাকেট, জগিং প্যান্ট, বাইকার জ্যাকেটের পাশাপাশি ছিল বাহারি মাস্ক।
পাঞ্জাবের নয়নাভিরাম ‘ফুলকারি’ নকশার উপস্থিতি দেখা গেছে সুকৃতি-আকৃতির উৎসবের পোশাকের সম্ভারে। লেহেঙ্গা, শাড়ি, লং স্কার্ট, কুর্তা, জ্যাকেট, কোটের সাদা জমিনের উপর রঙবেরঙের ফুলকারি নকশা সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
অন্যদিকে দিশা পাতিলের প্রথাছুট বিয়ের পোশাকের কালেকশনে ছিল আইভরি রঙের লেহেঙ্গা চোলির সমারোহ।
সংগত কারণেই এবারের ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে বলিউড তারকাদের উপস্থিতি ছিল একটু কম। তবে বিভিন্ন ফ্যাশন ফিল্ম আলোকিত করেছেন কার্তিক আরিয়ান, সোনাক্ষী সিনহা, ঈষান খট্টর, ম্রুনাল ঠাকুরের মতো নতুন প্রজন্মের তারকারা। এবারের আসরে ফ্যাশন ফিল্মের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় ফ্যাশন-সম্পর্কিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা এবং ল্যাকমের মেকআপ মাস্টারক্লাস।
এই উৎসব থেকে বেশ কিছু ট্রেন্ডের আভাস পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে প্রথমেই আসে ভারতীয় বুননশিল্পকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার প্রয়াস। বেশির ভাগ ডিজাইনার বিভিন্ন রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া বিখ্যাত সব হস্তশিল্প নিজেদের পোশাকের মাধ্যমে তুলে এনেছেন। দিয়েছেন নতুন রূপ। ধারণা করা যায়, আসছে বছরগুলোতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব কাপড়ের ব্যবহারও অনেক বাড়বে।
পাশাপাশি ট্রেন্ডে থাকবে মনোক্রোমাটিক উৎসবের পোশাক আর মিনিমালিস্টিক ব্রাইডাল ওয়্যার।
ছবি: ইন্টারনেট