ফিচার I প্রকৃতিবান্ধব সুগন্ধি
সাসটেইনেবল শব্দটি এখন পারফিউমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে। যেন তা বর্জ্য না হয় আর পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো যায়
ফ্যাশন, ফুড, ফিটনেস থেকে বিউটি—সব শিল্পেই এখন সাসটেইনেবিলিটির জোয়ার। তাতে ভর দিয়ে এলো আপসাইকেলড ফ্র্যাগরেন্স। এতে বাতিল জিনিসকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়। ফ্যাশন এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রি অনেক আগে থেকে এ পন্থা অনুসরণ করলেও সুগন্ধিশিল্পে ব্যাপারটি খুব একটা পুরোনো নয়।
আপসাইকেলড পারফিউম মূলত এমন সুগন্ধি, যার এসেন্স এবং ঘ্রাণযুক্ত উপাদানগুলো ফরমুলেটেড হয় বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য বাইপ্রডাক্ট থেকে। এ ধরনের ফ্র্যাগরেন্স ঘরেই বানানো যায়—কিছু ক্যারিয়ার অয়েল, লেফটওভার হার্ব বা মসলা এবং ফলের খোসা (বিশেষ করে সিট্রাস ফল) দিয়ে।
বেশির ভাগ পারফিউম বা ফ্র্যাগরেন্স তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক সুগন্ধি উপাদান ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। যেমন ফুল, বিভিন্ন রকমের গুল্ম বা ঘাস, মসলা, ফল, সুগন্ধি কাঠ, রজন ইত্যাদি। সুগন্ধিশিল্পের ব্যাপক চাহিদার জন্য চন্দন ও আগরগাছ এখন বিলুপ্তির পথে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন দামি পারফিউম বানাতে প্রাণীদের হত্যা করা হতো। এসবের মধ্যে রয়েছে কস্তুরী হরিণ, সিভেট বিড়াল, তিমি, বিভার, রক হাইরাক্স ইত্যাদি। তবে এখন এসবের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন সিনথেটিক উপাদান। বাজারে যেসব পারফিউম পাওয়া যাচ্ছে, সস্তা বা দামি, তাতে এর উপস্থিতি অনেক বেশি। যদিও সব রকমের সিনথেটিক খারাপ নয়। কিছু রয়েছে অস্থায়ী জৈব যৌগ বা ভিওসি (ভলেটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড)। এ ধরনের উপাদান বায়ু এবং সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এসে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। আমেরিকার ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের করা ২০১৮ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে, গাড়ি থেকে নিঃসৃত পেট্রোলিয়ামের মতোই পারফিউম এবং এই জাতীয় ভোক্তাপণ্য যেমন এয়ার ফ্রেশনার, গ্লু, পেইন্ট ইত্যাদি থেকে নির্গত ভিওসি বা অস্থায়ী জৈব যৌগ পরিবেশের সমান ক্ষতি করে। অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের আধিক্যের পেছনে এদের অবদান খুব একটা কম নয়।
এ জন্য এখন পারফিউমের ক্ষেত্রে আপসাইকেলড প্রাকৃতিক উপাদানের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কারণ, পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে মানুষ আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন হচ্ছে। আপসাইক্লিং ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসের ফলে শুধু ময়লা-আবর্জনার মজুতই কমাচ্ছে না, এর মাধ্যমে এগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ও সহজলভ্য হচ্ছে। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি তৈরির জন্য যেসব উপাদান নতুন করে চাষ বা উৎপাদনের দরকার হতো, সেসবের চাহিদা কমে আসছে, যা কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
এখন অনেক ব্র্যান্ড আপসাইকেলড ফ্র্যাগরেন্স বাজারে আনছে। বিশেষভাবে বলতে হয় ফরাসি লাক্সারি পারফিউম ব্র্যান্ড এটা লিবা ডু’হজেঁ-এর কথা। তারা আপসাইকেলড ফ্র্যাগরেন্সকে নিয়ে গিয়েছে অন্য মাত্রায়। তিন বছর আগে এই ব্র্যান্ড ওগিলভি প্যারিসের সঙ্গে এক হয়ে বাজারে এনেছে এমন একটি পারফিউম, যা তৈরি হয়েছে পোকামাকড়, পচা ফল এবং অন্যান্য বর্জ্য আবর্জনা দিয়ে। তারা এর নাম দিয়েছে আই অ্যাম ট্র্যাশ : লে ফ্লুর দ্যু দিশে বা দ্য ফ্লাওয়ার অব ওয়েস্ট। এ টাইটেল বিখ্যাত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেরের কাব্যগ্রন্থ লে ফ্লর দ্যু মাল বা দ্য ফ্লাওয়ার অব ইভিল থেকে অনুপ্রাণিত।
এ নিয়ে লেবেলটির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হুয়ানা ও’গোরম্যান এবং বিয়েট্রিশ ল্যাসেইলি বলেন, ‘এই উদ্যোগের শুরু থেকে আমরা সৃজনশীল কিছু করতে চেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে প্রমাণ করতে চেয়েছি, সৌন্দর্য আবর্জনা থেকেও আসতে পারে। আই অ্যাম ট্র্যাশ নামের বিপরীতে পারফিউমটির কম্পোজিশন খুব সূক্ষ্ম রুচিশীল এবং পরিশোধিত ফলাফল দিয়েছে।’
এর আগে কেউ কোনো দিন কল্পনাও করেনি, দুর্গন্ধময় ময়লা-আবর্জনা থেকে এমন সুন্দর সুগন্ধি তৈরি হতে পারে। এটি প্রস্তুত করেছেন এ সময়ের অন্যতম বিখ্যাত পারফিউমার ড্যানিয়েলা অ্যান্ড্রিয়ার। তিনি প্রাদা, কেনজো, গেরলেইন এবং আরও অনেক নামি ব্র্যান্ডের পারফিউম প্রস্তুতে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এর ঘ্রাণ কল্পনা করেছি একটি উর্বর জমির সঙ্গে। সেই জন্য আমার প্রশ্ন ছিল, এই উর্বর জমিতে কিসের পুনর্জন্ম হতে পারে। সেই চিন্তার প্রতিবিম্ব থেকে স্ট্রবেরি নোটের সঙ্গে আপসাইক্লিং উপকরণগুলো একত্র করার ধারণা এসেছে।’
আবর্জনা থেকে একটি সুগন্ধি বানানো কোনো সহজ কাজ নয়। এর উৎপাদন প্রক্রিয়া ছিল খুব কঠিন। এ পারফিউম চলবে কি না, তা নিয়ে ছিল অনেক সংশয়। কারণ, এর উপাদান এবং নামটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য এটা লিবা ডু’হজেঁ খুব এক্সোটিক ঘ্রাণ করতে চায়নি। কিন্তু উৎপাদনের শেষে দেখা গেল, আবর্জনার দুর্গন্ধ থেকে বেরিয়ে এসেছে অসাধারণ মিষ্টি ফুলেল সুবাস। বাজারে আসার কিছুদিনের ভেতরে এই ইউনিসেক্স পারফিউম বেশ নাম করে।
এটি ছিল সুগন্ধিশিল্পে আপসাইক্লিংয়ের চরম পর্যায়, যা জিরো ওয়েস্ট নীতি মেনে চলে। পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার জন্য এটা লিবা ডু’হজেঁ-এর উদ্যোগ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এই লাক্সারি লেবেল ছাড়া আরও কিছু ব্র্যান্ড আপসাইকেলড ফ্র্যাগরেন্স বাজারে এনেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেন্ট রোজ, এলিস ব্রুকলিন, আফটেলিয়ের পারফিউমস, দ্য নুই কো, বয় স্মেল।
সেন্ট রোজের ভিজিলেন্ট এয়ু দ্যু পারফিউম বানাতে ব্যবহৃত হয় মরোক্কান সিডার কাঠ ও গোলাপ ফুল। আসবাবের দোকানে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট কাঠ আর পারফিউম বানানোর সময় পাতন প্রক্রিয়ার পর যে গোলাপ ফুলগুলো রয়ে যায়, সেগুলো আবার নতুনভাবে প্রক্রিয়াজাত করে এই সুগন্ধি প্রস্তুত হয়।
এলিস ব্রুকলিনের সল্ট এয়ু দ্যু পারফিউম সমুদ্রপ্রাণিত ফ্র্যাগরেন্স, যাতে পাওয়া যায় লবণাক্ত চামড়া এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফুলের সুবাস। এটি বানাতে, প্যাকেটজাত মসলা তৈরির সময় পর্যন্ত বাড়তি এলাচি শুঁটি পড়ে থাকে, তার সঙ্গে যোগ হয় সিডার কাঠের উচ্ছিষ্ট গুঁড়া আর ভারতের মন্দিরগুলোতে রয়ে যাওয়া বেলি ফুল।
আর দ্য নুই কো-এর ফরেস্ট লাংস একটি স্ট্রেস রিলিফিং ইউনিসেক্স পারফিউম, যার ঘ্রাণ সকালের বনের শিশিরের মতো এবং এটি ডিজাইন করা হয়েছে ফাইটোনসাইড অনুকরণের জন্য। এটি এমন একটি উপাদান, যা প্রাকৃতিকভাবে গাছে উৎপাদিত হয়। যেটি প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম এবং ইমিউন ফাংশন সমর্থন করে স্ট্রেস ও উদ্বেগ কমাতে পারে। এই বিশেষ ধরনের পারফিউম বানাতেও ব্যবহার করা হচ্ছে সিডার কাঠের গুঁড়া, যেগুলো আসবাবশিল্পের উপজাত।
পারফিউম বিউটি ইন্ডাস্ট্রির একটি অংশ। ভবিষ্যতে ক্লিন বা সাসটেইনেবল বিউটি স্পেসের সবচেয়ে বড় ট্রেন্ড হতে যাচ্ছে এই আপসাইকেলড ফ্র্যাগরেন্স। এরপরও সৌন্দর্য ও ফ্যাশনের অন্যান্য সাসটেইনেবল ট্রেন্ডের মতো এরও যে নিজস্ব নানা জটিলতা নেই, তা নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আপসাইকেলড সুগন্ধি টিকে যাবে। তবে অনেকের ধারণা, এটি সাসটেইনেবিলিটি গ্রিন ওয়াশিংয়ের শিকার হবে। কারণ, ফর্মুলায় একটি আপসাইকেলড উপকরণ ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো ব্র্যান্ড শুদ্ধ বা টেকসই হয়ে যাচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে অনেক কিছুর মতো এটিও একটি বর্জ্যে পরিণত হবে।
ফাহমিদা শিকদার
ছবি: সংগ্রহ