ফিচার I ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম
ফেসবুক দলবদ্ধ ভাবনার স্থান হয়ে উঠেছে। যাতে তৈরি হচ্ছে বিপণন ও অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজের সুযোগ। কর্মসংস্থান এবং রোজগারের নতুন ও বিকল্প উপায়
ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল ই-কমার্সের ব্যাপ্তি সাত হাজার কোটি টাকার, এর মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা এফ-কমার্সের। কয়েক বছর ধরে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে কমিউনিটি তৈরির কালচার চলছে। এতে একটি পোস্টের সাহায্যে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। মতামত জানা যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিজনেস কালচার তৈরি হয়েছে। কিছু গ্রুপ কাজ করে যাচ্ছে তাদের সদস্যদের জন্য। ক্রেতা-বিক্রেতা-পরামর্শক এক প্ল্যাটফর্মে থাকার কারণে সবাই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে উপকৃত হচ্ছেন। ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের জন্য ইতিবাচক এই পরিবেশ। ফেসবুকে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বেশ কিছু গ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে তিনটি গ্রুপের কর্ণধার কথা বলেছেন।
গো দেশি
সাবেরা আনোয়ার
করোনাবাস্তবতা একটি বড় প্রভাব রেখেছে। অতিমারিতে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ছোট-বড় বহু প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে ব্যবসার সিজন প্রধানত দুটি। পয়লা বৈশাখ এবং ঈদ। দুটি উৎসবের একটিতেও পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। প্রফিট তো দূরের কথা, উঠে আসেনি রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট। ভাবছিলাম কী করা যায়। কীভাবে ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ সম্ভব, ভাবতে গিয়ে ফেসবুক গ্রুপ ‘গো দেশি’র যাত্রা শুরু। একই প্ল্যাটফর্মে পটেনশিয়াল ক্রেতা এবং যোগ্য বিক্রেতার সহায়তায় এটি গড়ে তোলা হয়।
আমাদের দেশে এখনো বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন। দেশে তৈরি পণ্য এখানকার বাজারে বিক্রি করে নিজেদের অর্থনীতিতে অংশ নেওয়া গো দেশির একটি উদ্দেশ্য। এই কারণে এখানে যেসব বিক্রেতা যুক্ত হয়েছেন, তারা সবাই দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করেন। ক্রেতারাও আগ্রহী দেশি উপাদানে নিজ দেশের পণ্য ব্যবহারে।
এখন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে আছেন তেষট্টি হাজার মেম্বার। সব সদস্য এখানে যুক্ত হয়েছেন অরগানিকভাবে। একজন অন্যজনকে দেশি পণ্যের কাছে নিয়ে এসেছেন। এর মাঝে চার হাজার উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাদের ৮৭ শতাংশ নারী। মেয়েদের এগিয়ে আসা আমাদের জন্য বিজয়ের চিহ্নস্বরূপ। প্রতিদিন অন্তত আট শ বিক্রেতা পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পোস্ট করেন। সেগুলো দেখে তবেই দুই শ বিক্রেতার পণ্য নিয়ে আসা হয় ক্রেতার সামনে।
আমরা সব শ্রেণির ক্রেতার কাছে আরও পণ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে গো দেশিকে কোম্পানি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। বিভিন্ন পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিতে আমাদের সঙ্গে আছেন ডিজাইনার এমদাদ হক এবং বিশিষ্টজন আরিফ আর হোসাইন।
ক্রেতা ও বিক্রেতাকে শুধু পণ্যের খোঁজ দিয়ে নয়, প্রশিক্ষিত করতে চাই নানাভাবে। তাই স্বপ্ন দেখি একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করার। যেখানে সব বিষয়ে প্রশিক্ষকের তথ্যে উপকৃত হবেন বিক্রেতারা।
দেশের ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য নেই তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। প্রণোদনার পরিমাণও যথেষ্ট নয়। পিছিয়ে পড়া শিল্পের উন্নয়নে এসব বিষয়ে পরিকল্পনা এবং নিয়মিত উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিন দিন মূলধন হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তাই সঠিক দিকনির্দেশনা জরুরি। একটি ব্যবসা একাধিক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে। দেশি পণ্য উৎপাদনকারীদের জয়যাত্রায় পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে গো দেশি।
সাপোর্টিং জাহারাস
ইশরাত আমিন
আমার কাছে মনে হয়, বাগানের সব ফুল যেমন যত্ন পেয়ে প্রস্ফুটিত হয়, প্রকৃতিকে সুন্দর করে তোলে, ঠিক তেমনভাবে প্রত্যেক মেয়েই সঠিক নির্দেশনা আর উৎসাহ পেলে এগিয়ে যেতে পারে। এই চিন্তা থেকেই আমার ফেসবুক গ্রুপের নামে জাহারা। এর অর্থ ফুল।
করোনাকালে আমরা বুঝেছি ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কথাটার গুরুত্ব। একজন পারে অন্যজনকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাতে, স্বপ্ন সফলে পাশে থেকে এগিয়ে নিতে। এখানে ব্যবসায়ীরা নিজেদের পণ্য নিয়ে আসেন ক্রেতার সামনে, আর ক্রেতাও নিশ্চিন্তে কিনে নিতে পারেন পছন্দের জিনিস। এই গ্রুপের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে তৈরি হয়েছে বিশ্বস্ততার বন্ধন। আঠারো হাজার সদস্য রয়েছে জাহারার। একজন অন্যজনের পাশে আছে জীবনের স্বপ্ন-ব্যর্থতা-সফলতার গল্প নিয়ে।
মানুষ বিভিন্ন রুচির হয়ে থাকে। পণ্য কেনাবেচায় তাই কোনো আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা নেই এখানে। যেকোনো দেশের পণ্যই ক্রেতার জন্য নিয়ে আসা যেতে পারে। একই সঙ্গে অগ্রগামীদের পরামর্শ, ব্যবসার গতিপথের নির্দেশনাসহ ব্যক্তিজীবনের সুন্দর স্মৃতি ও অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া হয় এখানে। আমরা একটি কমিউনিটিতে পরিণত হয়েছি। যেখানে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন এগিয়ে আসার মাধ্যমে একের পর এক সাফল্যগাথা তৈরি হচ্ছে। পাশে থাকার চর্চায় বিকশিত হচ্ছে নতুন উদ্যোগ।
ওমেন্স এরা
তাসনিয়া আতিক
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে আমার কোনো গাইডলাইন ছিল না। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নতুনদের জন্য কিছু করার। ক্যারিয়ার ভাবনায় দিকনির্দেশনা আর উৎসাহ—দুই-ই জরুরি। আমার ফেসবুক গ্রুপ একটি কমিউনিটি গড়ে তুলেছে, যেখানে একজন অন্যজনকে সঠিক নির্দেশনা যেমন দিচ্ছে, তেমনই ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে ক্রেতা। এই গ্রুপে সপ্তাহে দুদিন ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাসংক্রান্ত পোস্ট করতে পারেন। এ জন্য কোনো প্রকার চার্জ নেওয়া হয় না। পোস্টের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ ঘটছে। তাতে দুজনই উপকৃত হচ্ছেন। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে আমরা সবার জন্য পোস্ট করার সুযোগ রেখেছি। যাতে ব্যবসাসংক্রান্ত প্রশাসনিক তথ্য থেকে শুরু করে কোনো অনাকাক্সিক্ষত সমস্যাও সদস্যরা নিশ্চিন্তে জানাতে পারেন। ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যেতে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উনত্রিশ হাজার সদস্য রয়েছে ওমেন্স এরার ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে। এই গ্রুপ থেকে উৎসাহিত হয়ে পাঁচ শ নারী নাম লিখিয়েছে ব্যবসায়ীর খাতায়। উপার্জনক্ষম এই মানুষগুলো এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। এদের হাত ধরে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। বেকারত্বের হার আমাদের দেশে অনেক। তাই নতুন কর্মসংস্থান দেশের জন্য জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি, নারীর সাফল্য যুগে যুগে আরও গতিশীল হবে। ওমেন এরা নামকরণ এ কারণেই।
হট স্যুট ডটকমের মাধ্যমে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী ফেসবুক বিজনেস গ্রুপ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর কারণ:
গ্রুপের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয়।
ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি হয়। একজন ক্রেতা পরবর্তীকালে পুনরায় ক্রয় করেন।
ফেসবুকে অর্গানিক এবং পেইড রিচ রয়েছে। গ্রুপের মাধ্যমে অর্গানিক রিচ বাড়ে।
আমাদের দেশের গ্রুপের আহ্বায়কদের সঙ্গে কথা বলেও ধারণা করা যায়, বর্তমানে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের গ্রুপ কালচারে আগ্রহের প্রধান কারণ এই তিনটি।
বিজনেস টু কমিউনিটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যায়, ফেসবুক গ্রুপকে জনপ্রিয় করে তুলতে হলে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। প্রথমেই কেন এটি তৈরি করা হচ্ছে, তা ঠিক করে নেওয়া জরুরি। অর্থাৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার থাকতে হবে। নিয়মকানুন ঠিক করে সেগুলো সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি নাম দেওয়া আবশ্যক। নিয়মিত গ্রুপে পোস্ট করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব পোস্টে কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়া প্রয়োজন, এতে কমেন্টকারী নিজেকে কানেক্টেড মনে করবেন। সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য কিছু কমন প্রশ্ন সেট করতে হবে, যেগুলোর উত্তর দিলেই শুধু মেম্বার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করা যাবে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্ট, কমেন্ট এবং একজনের প্রতি অন্যজনের ব্যক্তিগত আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। গ্রুপের ইনসাইট দেখাও জরুরি। কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়মিত গিভ অ্যাওয়ে এবং লাইভের আয়োজন করা যেতে পারে। ফেসবুক গ্রুপের জন্য ফেসবুক বেশ কিছু ফিচার তৈরি করেছে। সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রুপ মেম্বারদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ে পোল ক্রিয়েট করে সদস্যদের মতামত নেওয়াও যায়।
ফেসবুক কমিউনিটির ক্ষেত্রে নিয়মিত যোগাযোগ এবং এনগেজমেন্ট তৈরি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে গ্রুপ কর্তৃপক্ষের সব সময় সচেতন থাকতে হবে। সব সদস্যের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এভাবে ফেসবুক গ্রুপ হয়ে উঠতে পারে নতুন দিনের উপযুক্ত মার্কেটপ্লেস।
সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ