skip to Main Content

ফিচার I এক টুকরো জীবন

অতিমারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবী। বদলে গেছে জীবন। ফ্যাশন, খাদ্যাভ্যাস- সবই। লিখেছেন এমদাদ হক

অদ্ভুত এক জীবনের মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমশ পার হচ্ছি। পৃথিবী চলছে ঘড়ির কাঁটায়। আমরা হয়ে যাচ্ছি বিচ্ছিন্ন। সময় ও পরিস্থিতি আমাদের পরস্পর পৃথক করে তুলেছে। খাচ্ছি, ঘুরছি কিন্তু এক অজানা ভয় ভর করে- কী জানি কী হয়? এরই মধ্যে হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনদের।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে এক বৃদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ২০১৯ সালে পৃথিবীতে এমন এক মহামারি আসবে, যা গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দেবে। তিনি জন্মেছিলেন বুলগেরিয়ায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে যান ব্যাপক বজ্রপাতে। সেই থেকে তার ভেতরে এক অলৌকিক শক্তি ভর করে। বাকি সময় কাটিয়ে দেন সে দেশেরই এক পাহাড়ি অঞ্চলে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতেন অকপটে, যা এখনো ঘটে চলেছে। আজকের এই বিশ্ব মহামারি সম্পর্কেও তিনি আগাম জানিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

এমদাদ হক

পৃথিবীর রূপ পরিবর্তিত হয়ে গড়ে উঠবে রোবটিক ডিজিটাল যুগ। বিপুল-অধিকাংশ মানুষের তখন কোনো কাজই থাকবে না।
আমরা কাছে থেকেও দূরে। অন্তত তিন হাত ব্যবধানে। কখনোবা গৃহবন্দি, তবে সে তো আর নির্বাসন নয়। কোথায় হারিয়ে গেল টিএসসির আড্ডা, মামুর শিঙাড়া, চটপটি, হাত ধরে হাঁটা এপাশ থেকে ওপাশ। জীবনটা যেন সীমাবদ্ধ হয়ে গেল নিমেষেই। এক বাসায় তিনজন, তিন কামরায়। কথা হয় মুঠোফোনের হোয়াটসঅ্যাপে। এটাও এখন ভাবতে হয়, বিল যেন সীমিত থাকে। পোশাকে-আশাকে হয়ে গেলাম একেবারে ভিন্নতর।
জুম মিটিং আর প্রতিদিনের করোনা পরিসংখ্যান- সব আজ একাকার। জুম মিটিংয়ে কেবল ওপরের অংশটাই দৃশ্যমান। নিচে ঢোলা পায়জামা, শর্টস কিংবা একেবারে খাঁটি বাঙালি হলে লুঙ্গি। এ ছাড়া টাইটস, ঘরে পরার জিনস বা সালোয়ার পায়জামা, সেটাও আবার আরামদায়ক। এটুকুর সঙ্গে পরিবেশনির্ভর ওপরের পোশাক। এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম আনা যায়।
ইকোফ্রেন্ডলি সাসটেইনেবল, রিসাইকেলড- এসবই এখনকার পরিধেয়। আমরা হয়তো ফিরে যাচ্ছি প্রকৃতির মাঝে।
পোশাক হয়ে গেল সিঙ্গেল পিস। কখনো কুর্তি বা টপস, কামিজ বা শার্ট, টি-শার্ট। ছেলেদের বেলায় একই দৃশ্য। নিচে পায়জামা, ওপরে ফরমাল স্যুট-টাই, কখনো ক্যাজুয়াল হলে পোলো টি-শার্ট, এশিয়ান হলে হাওয়াই শার্ট বা পিনট শার্ট, কখনো টি-শার্ট।
এসবই এখনকার ট্রেন্ড। স্কার্ফ হচ্ছে টপ ফ্যাশন। বাইক বা গাড়ি, নিরবচ্ছিন্ন হাঁটা, চলাফেরায় একটি স্কার্ফ হলে আর কী লাগে। মাথা, মুখ ঢেকে দিব্যি চলা যায়।
আমাদের গামছার ব্র্যান্ডিং হচ্ছে নর্থ আমেরিকাসহ কানাডিয়ান বাজারে। এটি হয়ে গেছে ফ্যাশন আইটেম। মজিলো পরিচিতি পাচ্ছে ওপারে। আধখানা মুখ, মাস্ক এখন জীবনসঙ্গী। এ নিয়েও চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গামছায় মাস্ক বানিয়েছেন বিবি রাসেল। অরণ্য, যাত্রা, আরও অনেক হাউস বাজারজাত করছে ভেজিটেবল ডাই মাস্ক। হচ্ছে কারচুপি, এমব্রয়ডারি, চুনট মাস্ক। সবার একটাই উদ্দেশ্য- সতর্কীকরণ। সত্যি জীবন এখন কেবলই নিজের নিরাপত্তার ভাবনায় আচ্ছন্ন।
আলমারির ভাঁজে ভাঁজে রয়ে যাচ্ছে সব দামি পোশাক। শাড়ি, স্যুট, শেরওয়ানি হয়ে গেছে অ্যান্টিক পিস। ঘরে চলছে আরামদায়ক পোশাকের সন্ধান। বিশ্ব জরিপে দেখা যাচ্ছে, কেবল ক্যাজুয়াল শার্ট, টি-শার্ট, পায়জামা আর স্কার্ফের অর্ডার নিয়ে বেশি ব্যস্ত গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। পাশ্চাত্য স্টোরগুলো সীমিত করেছে তাদের সংখ্যা। পোশাকের বাজার ভিন্ন এক কৌশল গ্রহণ করেছে।
আমরা প্রতিদিন যে পোশাক পরছি, তার উৎস কোথায়, কেমন পরিবেশে তৈরি হচ্ছে। কারিগর মজুরি পাচ্ছে কি না- এসবও ভাববার বিষয়।
ভারতীয় বিশিষ্ট ডিজাইনার অর্ণব সেনগুপ্ত বলেন-
আজকে আমরা যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমাদের সবকিছু রেসট্রিকটেড করে দেওয়া হয়েছে। আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না। আমি নিজেও ডিজাইন করি, একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসরও। তো সেখানে বহু বাচ্চা আছে, তারা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসই দেখেনি গত দেড় বছর। যারা নতুন স্টুডেন্ট, তারা ক্যাম্পাস দেখেনি, তারা অনলাইনে পড়াশোনা করছে, জীবন এখন সেভাবেই চলছে। আগে ৮০ জনের মতো কারিগর বা লেবার কাজ করত আমার ফ্যাক্টরিতে। তারা আজ প্রায় এক বছরের ওপরে হয়ে গেছে কাজে আসতে পারছে না। কারণ, ট্রেন বন্ধ, বাস বন্ধ…। এই সময়ে আমি দেখলাম, কী ধরনের কাজ করলে নিজস্ব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। তো আমি তখন বেনারসির ওপর কাজ করতে শুরু করলাম। বেনারসে অসংখ্য তাঁতি আছে, তারা আমার জন্য কাজ করে, নানান রকম শাড়ি তৈরি করে। তাদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে শুরু করলাম এবং ধীরে ধীরে বেনারসির ওপর নানান রকম ডিজাইন ক্রিয়েট করতে পারলাম। সেটাই কিন্তু নানান রকম তৃপ্তি দিয়েছে মনে। ডিজাইনিংয়ের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ। সবার সঙ্গে টাচে থাকা। ইভেন্ট ম্যানেজার, আমার নিজস্ব ক্লায়েন্ট, মডেল, মেকআপ আর্টিস্ট, ম্যাগাজিনের পিপল। কত রকমের লোকজনের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা করতে হয় ডিজাইনিং করতে গেলে। খালি ডিজাইন করলেই কিন্তু তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। সেটা করতাম কীভাবে, আমরা মাঝেসাজেই কোনো ডিনার, পার্টিতে বা কোনো ইভেন্টে মিট করতাম। সেটা কিন্তু দেড় বছর আগ থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। তো মানুষের কাছে কীভাবে পৌঁছাব। একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, সেটার মাধ্যমে আমি চেষ্টা করেছি বন্ধু ও স্থানীয় গ্রাহকদের মাঝে পৌঁছাতে। আমাদের জীবনে যে নতুন পরিবর্তন এসেছে, সেটা আমরা কেউ নিজে থেকে চাইনি। কিন্তু সেটা নিয়ে হাত কামড়ে বসে থাকলে চলবে না। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে এবং সেখানেই জীবনের সার্থকতা। যাতে আমি অনেক তাঁতি পরিবারকে সাপোর্ট করতে পারি এবং সেই সঙ্গে যাতে আমার সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে যেতে পারি। আমি আশাবাদী যে প্যানডেমিকটা এই বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে ১০০% না হলেও ৮০% চলে যাবে। কারণ, আমরা যেভাবে ভ্যাকসিন নিচ্ছি প্রতিটা দেশে- ভারতবর্ষে, বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। আশা করি, এটার ম্যাচিভ অ্যাটাকটা কমে যাবে। তখন আবার আমরা আমাদের নিজস্ব জীবনযাত্রা যেটা ছিল, সেটাতে ফেরত আসব এবং সে সময় আমরা নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করব। বর্তমানে প্রায় ২০০ জন তাঁতি পরিবারকে সাপোর্ট করছি। তাদের কাছ থেকে কাজ নিচ্ছি এবং খালি বেনারস নয়, পোচামকলি নামে একটি গ্রাম আছে তেলেঙ্গানা স্টেট, ভারতবর্ষে। সেখানেও ইক্কাতের কাজ হচ্ছে, যেটাকে আমরা কটকি বলে থাকি বাংলা ভাষায়। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে যখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আরও অনেক তাঁতি ও কারিগরকে ইনভলভ করতে পারব। বিশ্বদরবারে আমার কাজ প্রেজেন্ট করতে পারব, আবারও নতুন করে এবং সবার যাতে কর্মসংস্থান হয়, সেটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য।
অর্ণব বলেন, অনেক মানুষের ভিড়ে থেকেই আমরা এক ও অভিন্ন। কাছে থেকেও দূরে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জীবনযাত্রার ভেতর শুধু ফ্যাশন নয়, আমাদের খাবার-দাবার, যাতায়াত, পরিবহন- সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু এ সময়টা একটা ভিন্নতর স্থান করে নিয়েছে। আমরা খাবার টেবিলে যখন বসতাম, অনেক ধরনের পদ- ডাল, ভাজি, ভর্তা, মুরগি- অনেক কিছু দিয়ে খেতে পছন্দ করতাম। কিন্তু করোনায় আমাদের মানসিক অবস্থা এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে আসলেই খাবারের প্রতি অন্য রকম একটা রুচি তৈরি হয়েছে। এক পদের তরকারি ও ভাত হলেই হয়ে যায়। ডাল বা ভর্তা সেটাই যথেষ্ট। একটি বাড়িতে যদি চারজন মেম্বার থাকে, তাদের প্রত্যেকেরই খাবার ধরন বদলে গেছে এবং যে যার ঘরে বসে খাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে হয়তো কদাচিৎ খাওয়া হচ্ছে। এখন এক অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে পার করছি। অতিথি আপ্যায়ন ভুলেই গেছি।
এ প্রসঙ্গে রন্ধনশিল্পী লবি রহমান বলেন, সময়টাই ঠিক প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার। আমরা এখন অর্গানিক খাবারের দিকে মনোনিবেশ করছি। সবজি, শাক, মাছ বিশেষ করে ভিটামিন সি- এসব দিকে আমাদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সবুজ শাকসবজি খেতে হবে এই সময়টায়। কাঁচা আম, বড়ই, পেয়ারা, আমলকী- সব কটিতেই ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, দেশজ যে ফল আছে, তাতেই আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো ভিটামিন ডি। ঘরে বসে থেকে করোনার সময় আমরা সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমাদের এখন অ্যাপার্টমেন্ট জীবন। ফ্ল্যাটে রোদ পাওয়াটা দুরূহ। অনেক সময় রোদের জন্য বের হতে হয়, বের হওয়া যাবে কি না, মাস্ক ব্যবহার করা যাবে কি না, মাস্ক ডাবল হবে কি না সিঙ্গেল হবে, নাক-মুখ ঢাকতে হবে- অনেক ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় নিজের কাছে। তারপরও আমাদের সূর্যের আলো দেখতে হয়, ভিটামিন ডির জন্য রোদে বের হতে হয়। যাদের দক্ষিণ দিকে বাতাস বা রোদ আছে, সেখানেও রোদ পোহানো যায়। ভিটামিন ডি আমাদের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। করোনার সময় পার হবে কি না জানি না, বিষয়টা একেবারেই অনিশ্চিত। কিন্তু জীবনপ্রবাহ চলবে অন্য ধারায়। আমরা হয়তো সব সময় মাস্ক পরে চলব, তিন হাত দূরত্ব বজায় রাখব। দূরত্ব যেন শরীরের হয়, মনের যেন না হয়।
বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে বড় একটা সম্পদ। মানুষের পারিবারিক সম্বন্ধ বড় একটা সম্পর্ক। ছেলে-মেয়ে, দাদা-দাদি, নানা-নানি এই যে পারিবারিক একটা বন্ধন, সেটা কখনো ফেলে আসা যাবে না। বন্ধনকে অটুট রাখতে হবে, তাহলেই আমরা আগামী সুন্দর জীবন দেখতে পারি। মনে রাখতে হবে, করোনার সময়ে যে নিয়মগুলো মানছি, সেগুলো অভ্যাসে পরিণত হবে। চলুন, আমরা সেই অভ্যাসগুলো পালন করি।

মডেল: জুই, এফা, বৃষ্টি ও অর্পিতা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: এমদাদ হক
ছবি: ইভান সরদার ও তানভীর খান

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top