ফিচার I ঐতিহ্য ও নকশার পরম্পরা
পোশাকে বাঙালিয়ানা। পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে প্রধান উপাদান হিসেবে এটাই এখন বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এই ধারণা ছিল ভিন্ন রকম। বৈশাখী মেলা, হালখাতা আর তাঁতের শাড়ি-পাঞ্জাবিতেই উদ্যাপন করা হতো পয়লা বৈশাখ। নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাঙালির পোশাক ভাবনায় যোগ হয় দেশীয় ফ্যাশনের পোশাক। আর নব্বই দশকের শেষের দিকে বৈশাখসহ অন্যান্য উৎসবে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। অর্থাৎ প্রচলিত ধারার পোশাকে যোগ হয় ডিজাইনারদের ভাবনা। বহুকাল ধরে যেসব পোশাক দেশের মানুষের পরিধেয় ছিল, দেশীয় ফ্যাশন হাউজ সেই পোশাকের উপস্থাপনায় আনে ভিন্নতা। কাপড়ের বুনন ও নকশায় তৈরি হয় বৈচিত্র্য। রঙের ব্যবহারে দেখা যায় নতুনত্ব। সুতরাং বহুল প্রচলিত পোশাকগুলো মানুষ আবিষ্কার করে নতুন আঙ্গিকে।
চৈত্রের বিদায়ে শুরু হয় বাংলা নতুন বছর। আর সময়ের চাহিদায় পয়লা বৈশাখ মানেই ঐতিহ্যের পোশাক। শত শত বছর ধরে শাড়িতে মিশে রয়েছে বাঙালিয়ানার ছাপ। বৈশাখের শাড়ি বলতে প্রথমেই চলে আসে তাঁতের শাড়ি। রকমারি বুনন ডিজাইন ছাড়াও বৈশাখী বাজারে দেখা যায় তাঁতের শাড়ির উপর ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, হ্যান্ডপেইন্ট আর মেশিন ও হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারি। গরমকে প্রাধান্য দিয়েই উৎসবের আমেজ ফুটিয়ে তোলা হয় এসব ডিজাইনে। বৈশাখের রঙ সাদা-লালের পাশাপাশি অন্য রঙের মিশ্রণ পাওয়া যাবে বেশ। এম্ব্রয়ডারিতে শীতলপাটি, কাঁথা, হাতপাখা, জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার দেখা যায়। সারা বছরের মতো এই সময়ে হ্যান্ডলুম এবং পাওয়ার লুমে সুতি, সিল্ক, হাফসিল্ক শাড়ি পাওয়া যায়। তবে এই সময়ে সুতিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে বাঙালি। এসব শাড়িতে যেমন থাকে বুনন নকশা, তেমনি ডিজাইনাররা যোগ করে থাকেন মাত্রা। রঙ বাংলাদেশ সব সময়ই বিভিন্ন থিম নিয়ে বৈশাখ এবং বিভিন্ন উৎসব সংগ্রহ সাজিয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বরং এবার শীতলপাটি, সাঁওতালদের দেয়ালচিত্র আর মঙ্গল শোভাযাত্রা রঙ বাংলাদেশের বৈশাখ কালেকশনের থিম হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সৌমিক দাশ।
বাংলাদেশের পোশাক সংস্কৃতিকে সচেতনভাবে বিবেচনায় রেখেই সংগ্রহটি সাজানো হয়েছে। সময়, প্রকৃতির অবস্থা, পরিপার্শ্ব, আবহাওয়া- এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কালেকশনটির রঙ ও কাপড় নির্বাচন করা হয়েছে। এ বছর রঙ হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে লাল, মেরুন, অফ হোয়াইট ও সাদা। পোশাকগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে সুতি, লিনেন, তাঁত, মসলিন, বলাকা সিল্ক, এন্ডি ও ভয়েল।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজ মেয়েদের অতি আরামের পরিধেয়তে রূপ নিয়েছে। বৈশাখী ফ্যাশনে কামিজের উজ্জ্বলতায় লাল সাদার বাইরে ধরা পড়েছে নানা রঙ। ফ্যাশন হাউজগুলোর এবারের বৈশাখী কালেকশনের ভিন্নতা নিয়ে কে ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী খালিদ মাহমুদ খান জানান, ‘সময়ের পরিবর্তনে আজ বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন এ দেশের অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ঘরে তাই বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রস্ততি চলছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এ বছর পটচিত্র, মধুবনী, নকশিকাঁথা, জ্যামিতিক, ফ্লোরাল, ঐতিহ্যবাহী ফোক ইত্যাদি মোটিফে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো তৈরি করেছে এবারের কালেকশন। যেখানে মিডিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে স্ক্রিন প্রিন্ট, এম্ব্রয়ডারি ও টাই-ডাই। এবারের কালেকশনে রং হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে লাল, মেরুন, ম্যাজেন্টা, অফ হোয়াইট, সাদা, নীল, কমলা, বাসন্তী, ক্রিম ইত্যাদি। কটন, লিনেন, জর্জেট কাপড়ে মোটিফ ও রঙের সমন্বয়ে প্রকাশ পাবে বৈশাখী ফ্যাশন।’
পয়লা বৈশাখের মোটিফে দেশীয় ঐতিহ্য প্রকাশ পেলেও কাটের বৈচিত্র্য বর্তমানের পোশাককে দিয়ে থাকে বিশেষ নান্দনিকতা। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী শাড়ি-পাঞ্জাবি আর সালোয়ার-কামিজের পাশাপাশি পশ্চিমা পোশাকও স্থান করে নিয়েছে বৈশাখ কালেকশনে। দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখেই বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছে ওয়েস্টার্ন প্যাটার্ন ও কাট। এ নিয়ে অঞ্জন’স-এর শীর্ষ নির্বাহী শাহীন আহম্মেদের অভিমত, ‘ বাঙালির বৈশাখই হোক বা যেকোনো উৎসব- নতুন পোশাক আর খাবার ছাড়া বর্ণহীন। বরাবরের মতো এবারও বৈশাখ কালেকশনে গুরুত্ব পাচ্ছে ঐতিহ্য। যেখানে মোটিফ হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে নকশিকাঁথার নকশা, শীতলপাটি, হাতপাখা, জামদানি ও ঐতিহ্যবাহী লোকজ মোটিফ। তবে সময়ের চাহিদায় অনেকেই তাদের কালেকশন তৈরি করেছেন পশ্চিমের আঙ্গিকে। কারণ, উঠতি প্রজন্মের চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়ে তো উপায় থাকে না। তা ছাড়া তাদের নিজস্ব একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্টও থাকে।
বাঙালির বৈশাখ কি অসন আর কি বসন- পুব-পশ্চিমের মিলনের সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। ঐতিহ্যের পাশাপাশি ফিউশন কিংবা পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন পোশাকও এখন বৈশাখে জায়গা করে নিয়েছে অনায়াসে। ফলে বাঙালির বৈশাখ ক্রমেই হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক।
জাহিদুল হক পাভেল
ছবি: ফ্যাশন হাউজের সৌজন্যে