skip to Main Content

মনোজাল I পোশাকে প্রতিশোধ!

সে-ও সম্ভব। প্রিন্সেস ডায়ানা থেকে হালের হার্টথ্রব টেইলর সুইফট সে পথই দেখিয়েছেন। ফলে মনস্তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাক পরিধানের অন্যতর এ উপায় স্বস্তি জোগাবে শোকাতুর মনেও

১৯৯৪, গ্রীষ্মকাল। গাড়ি থেকে নামলেন ব্রিটিশ রাজবধূ প্রিন্সেস ডায়ানা। পরনে কাঁধখোলা সিল্কের ককটেল মিনি ড্রেস। একটু আঁটোসাঁটো, স্টাইলিশ এবং সচরাচর তার পরিহিত পোশাক থেকে আলাদা। শোক ছাড়া রাজপরিবারের মেয়েদের কালো পরার নিয়ম নেই, অথচ পোশাকটির রংও কালো। সব মিলিয়ে সেদিন যেন ডায়ানার সৌন্দর্যে আগুন ঝরছিল, চোখে খেলা করছিল অন্য এক আলো। পাপারাজ্জিরা থমকে গিয়েছিলেন তার সেই রূপ দেখে। একের পর এক ক্যামেরার শাটার থামছিল না কিছুতেই। এই এক পোশাকেই ডায়ানা তোলপাড় করে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ মিডিয়াসহ বিশ্ব ফ্যাশনের স্তম্ভ। ফ্যাশনবোদ্ধারা এর নাম দিলেন রিভেঞ্জ ড্রেস। প্রতিশোধের পোশাক। পরবর্তী বেশ কিছুদিন রাজপরিবারের নানা বিষয়-আশয় ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সেই কালো পোশাক।
উত্তেজক এই পোশাকের সঙ্গে প্রতিশোধ ব্যাপারটি কীভাবে যুক্ত হলো, তা জানতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সে সময় কিছুদিন ধরেই প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে ডায়ানার সম্পর্কে ভাঙনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। মিডিয়াজুড়ে চার্লস-ক্যামিলার অ্যাফেয়ার তখন ওপেন সিক্রেট। এ সময় কী হওয়ার কথা? বিষাদে মুষড়ে পড়া ডায়ানার অবয়বে, আউটফিটে থাকার কথা ডিপ্রেশনের লক্ষণ। যেন ডায়ানাকে দেখে মনে হয়, কতই না কষ্টে কাটছে তার দিনরাত। অথচ ব্যাপারটা ঘটল উল্টো। ডায়ানাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন প্রিন্স চার্লসকে বোঝাতে চাচ্ছিলেন, তিনি কী হারিয়েছেন। এবং চার্লসের এই অনৈতিক কার্যকলাপে তার মাথার মুকুট যে সরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তাতেও তার কিছু যায় আসে না। প্রতিশোধের ধারণাটি এখান থেকেই যুক্ত হয় বিশেষ সেই পোশাকের সঙ্গে। ডিজাইনার ক্রিস্টিনা স্ট্যাম্বোলিয়ানের করা এ পোশাক আসলে সে সময় ডায়ানার প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কারণ, রাজপরিবারের কোনো নারী সদস্যের এ রকম পোশাক পরে জনসমক্ষে আসার অনুমতি ছিল না। তাদের কাঁধখোলা পোশাক পরার নিয়ম নেই; এমন পোশাক পরতে হবে, যাতে কোনোভাবে ক্লিভেজ দেখা না যায়। হাঁটুর ওপরে দৈর্ঘ্য, এমন ছোট পোশাকও পরা ছিল বারণ। রাজকীয় নিয়মকানুনের সমস্ত বেড়াজাল ডিঙিয়ে ডায়ানা নিজেকে এমন পোশাকে সাজিয়েছিলেন, তা দেখে আসলেই মনে হচ্ছিল, তিনি যেন তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন। রাজতকমা আর নিয়মকানুনের কারাগার থেকে বের হয়ে উড়তে চাচ্ছেন মুক্ত আকাশে। বলা যায়, ফ্যাশনবিশ্বকে নতুন একটি কনসেপ্ট রিভেঞ্জ ড্রেসিং সেদিন উপহার দিয়েছিলেন ডায়ানা। ক্রমেই যা হয়ে উঠেছে হট ফ্যাশন ট্রেন্ডের অংশ।
ডায়ানার পর অসংখ্য সেলিব্রিটি রিভেঞ্জ ড্রেস পরে মিডিয়ার সামনে এসেছেন, পোস্ট দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে রিভেঞ্জ ড্রেস মানেই যে পোশাক কালো কাঁধখোলা বা শর্ট হতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে প্রতিশোধের ড্রেসিং জাস্ট একটা মনস্তাত্ত্বিক ফ্যাশন কনসেপ্ট। সহজ করে বললে, যেখানে পোশাক প্রদর্শনের চেয়ে ভিন্ন এক মনস্তত্ত্ব প্রাধান্য পায়। পোশাকের লুক সেখানে গৌণ। মুখ্য হয়ে ওঠে জীবনের উল্লেখযোগ্য বিশেষ মানুষটিকে ছাড়াই ভালো থাকার ব্যাপারটি। তাই আফটার ব্রেকআপ বা ডিভোর্সের পর ছাড়া এই পোশাক পরার প্রচলন নেই। পোশাক পরিধানকারীকে দেখে তার সাবেক ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠবে, মূল্য আরেকবার ভালো করে বুঝতে পারবে—এই না হলে আর রিভেঞ্জ ড্রেসিং কেন? গবেষকদের মতে, এটি আসলে শক্তির অনুভূতি দেয়, পাশাপাশি পুরোনো সময়কে ভুলে জীবনের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দৃশ্যমান করে তোলে। যেমন ছিল ডায়ানার পোশাকটি। ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা যাকে বর্ণনা করেছেন অতিরিক্ত সাহসী হিসেবে। এটি বিশ্বকে এবং সাবেককে জানান দিয়েছিল তার প্রবল আত্মমর্যাদার কথা, যেটিকে বিসর্জন দিয়ে গতানুগতিকতায় গা ভাসানোর কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না।
ড্রেস ইওর বেস্ট লাইফ-এর লেখক এবং ফ্যাশন সাইকোলজিস্ট ডন ক্যারেন বলেছেন, ‘প্রতিশোধের ড্রেসিং অত্যন্ত থেরাপিউটিক হতে পারে।’ প্রিন্সেস ডায়ানা তার পোশাক দিয়ে নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে ফেলেছিলেন। রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন এবং এ ব্যাপারটি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ছিল। তিনি সম্ভবত অসম্ভব নিয়ন্ত্রিত বোধ করেছিলেন, যেন ছিলেন একটি রূপক কারাগারে। তার পরিহিত পোশাক এটি থেকে বেরিয়ে আসারই একটি উপায় ছিল হয়তো।
তাই বলা হয়, এ পোশাকে প্রতিশোধই প্রকট হয়ে উঠবে, তবে সেটা যেন আবার খুব বেশি দৃষ্টিকটু না হয়। ডায়ানার প্রতিশোধ ছিল ব্যঙ্গাত্মক, যেটা অনেক বেশি বিধ্বংসী। রিভেঞ্জ ড্রেসিং কনসেপ্টে প্রতিশোধের ইতিবাচকতা এই ধারণা থেকে আসে যে পরিধানকারী বিশ্বে ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধার করতে এবং বিশেষ কারও কাছে একটি বার্তা পাঠাতে চান। স্পষ্টতই, ডায়ানা প্রতিশোধের ড্রেসিং আবিষ্কার করেননি; তবে তার সেই পোশাক ও চেহারা একটি পপ সংস্কৃতির প্রবণতা তৈরি করেছে, যা প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। এ কনসেপ্ট জনপ্রিয় করেছে আসলে সোশ্যাল মিডিয়া। আজকাল ব্রেকআপের পর হাসিমুখে সেজেগুজে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন না—এমন তরুণী কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে সাবেককে বোঝানোর চেষ্টা যে, তিনি ভালো আছেন। এটিও কিন্তু রিভেঞ্জ ড্রেস কনসেপ্টের অংশ।
ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিশোধের ড্রেসিং, আত্মসম্মান ও মেজাজ বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং নিজ চোখে নিজের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা রাখে। সম্পর্কের ইতি টানার পর প্রচণ্ড কষ্টকর সে সময়ে, নিজেকে কোনোভাবে ছোট কিংবা অবহেলিত মনে না করার দারুণ কৌশল এটি। তখন রিভেঞ্জ ড্রেস আত্মবিশ্বাস অনেকটা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। তাই এটিকে কেউ কেউ ‘ডোপামিন ড্রেসিং’ বলেও অভিহিত করেন। উদাহরণ হিসেবে গায়িকা টেইলর সুইফটের কথা ধরা যেতে পারে। গত বছর সুইফটের নতুন অ্যালবাম মিডনাইটসের ‘ভিজিলান্তে শিট’ গানে তিনি গেয়েছিলেন, ‘আমি নারীদের জন্য পোশাক পরি না।/ আমি পুরুষদের জন্য পোশাক পরি না।/ ইদানীং আমি প্রতিশোধের জন্য পোশাক পরছি।’ এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরাসরি এ কনসেপ্টে বিশ্বাস করার কথাও বলেছেন। ‘ব্রেকআপের পরে আমি প্রতিশোধের পোশাক পরেছি অনেক; তবে সম্পর্ক মেরামত করার লক্ষ্য নিয়ে নয়। উদ্দেশ্য ছিল সর্বদা শত্রুকে কষ্ট দেওয়া। আমি একটি ব্যাকলেস লাল মিনি পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম—যা দেখে তারা কাঁদে, করুণা ভিক্ষা করে কিংবা নিদেনপক্ষে তাদের জীবনের পছন্দ নিয়ে নিজের কাছে প্রশ্ন তোলে।’
আসলে সম্পর্কে ভাঙন বা ব্রেকআপের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা কারও পক্ষে সহজ হয় না। পরিসংখ্যান বলে, বেশির ভাগ শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের নারী এমন পরিস্থিতি সাধারণত হাসিমুখে সামলানোর চেষ্টা করেন। রিভেঞ্জ ড্রেস কনসেপ্টটিও আসলে তাদের জন্য। সময় খারাপ যাচ্ছে, এই সময়টাকে ভালো করে তুলতে নিজেই নিজেকে একধরনের ট্রিট দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বাড়ির বাইরে বেড়াতে যেতে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যাতে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হওয়া যায়। পাশাপাশি, সদ্য সাবেককে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, ইসমে তেরা ঘাঁটা, মেরা কুছ নেহি যাতা…! অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পুরোটাই তোমার লস; আমার তাতে কিছুই যাচ্ছে আসছে না।

i রায়া ফাতিমা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top