ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মেট গালার ময়দান
জগতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও গ্লামারাস ফ্যাশন ইভেন্ট হিসেবে এর খ্যাতি। এবার ছড়িয়েছিল ভিন্ন দ্যুতি
মেট গালার আনন্দ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ফ্যাশন দুনিয়ার সারা বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে লালগালিচায়। স্টাইলের কী দারুণ বিচ্ছুরণ! এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বিস্মিত দর্শকেরা মুগ্ধতা নিয়ে আয়োজনে চোখ রেখেছেন। এ বছর মেট গালার থিম ছিল ‘কার্ল লাগারফেল্ড: আ লাইন অব বিউটি’। বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কার্ল লাগারফেল্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। রেড কার্পেটে এবার ছিল সাদা ও কালোর উজ্জ্বল উপস্থিতি। দুই রঙে কার্লের মেমোরিলেন। ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ইতিহাসের শুরুর পাতায় শ্যানেলের নাম জ্বলজ্বলে। ফ্রেঞ্চ এই লেবেলের সঙ্গে ১৯৮৩ সাল থেকে ছিলেন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কার্ল। শ্যানেল, ক্লোয়ি আর ফেন্ডি লেবেলের সঙ্গে কর্মজীবন কাটিয়েছেন তিনি। সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে সৃজনে সাজিয়েছেন রাগ ট্রেডকে। পুরো আয়োজনে এই ফ্যাশনপুরোধা জড়িয়ে ছিলেন। মনোক্রোমে মনের মণিকোঠায় মিশে ছিলেন তিনি।
মেট গালাতে তারকাদের উপস্থিতি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলে আলোচনা। তারা কী পরলেন, কীভাবে সাজলেন, তাদের অলংকারের মহিমা। এবারের আয়োজনও ফ্যাশনবোদ্ধাদের কাছে অন্যতম সেরা হিসেবে বাহবা পেয়েছে। মেট গালা ২০২৩ তত্ত্বাবধায়ক ভোগ ইউএসএর এডিটর-ইন-চিফ আনা উইন্টার ভাসছেন অভিনন্দনে। ওটিটি দুনিয়ার জনপ্রিয় কন্টেন্ট ওয়েনসডের জেনা ওর্তেগা করসেট ড্রেস পরে হাজির হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল জ্যাকেট আর অক্সফোর্ড হিল সুজ। সাদা-কালোর মাঝে কিম কার্দাশিয়ান এসেছিলেন শ্যাম্পেন কালারের শিয়াপারেলি গাউনে। ড্রিপিং পার্ল নামে পরিচিতি পেয়েছে এই পোশাক। ১৬ হাজার ক্রিস্টালে তৈরি। ১২ জনের এক হাজার ঘণ্টা সময় লেগেছিল তৈরিতে।
ডুয়া লিপার পরনে ছিল ১৯৯২ সালের এক পোশাক। কার্ল লাগারফেল্ডের নকশা করা এই পোশাক শ্যানেল ব্র্যান্ডের কালেকশনের অংশ। কেন্ডেল জেনার কালো বডি স্যুটে দাপিয়েছেন লালগালিচা। লং ট্রেইনে স্যুটটির মাধুর্যে মাতোয়ারা হয়েছে দর্শক। বডি স্যুটের ক্যানভাসে চুমকির কাজ যেন উৎসবের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল।
সাদা ও কালো—এই দুই রঙের প্রাধান্যের সঙ্গে ক্যামেলিয়া ফুলের বহুল ব্যবহার দেখা গেছে এবার। ব্র্যান্ড শ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা কোকো শ্যানেলের সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল ক্যামেলিয়া। কার্ল বহুবার এর ব্যবহার করেছেন। রেড কার্পেটে যা স্নিগ্ধতার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। একাধিক তারকার পোশাকে এই ফুলের মোটিফ দৃষ্টি কেড়েছে। ক্যামেলিয়া তাই আলোচনার কেন্দ্রে।
রিয়ানা পরেছিলেন ভ্যালেন্টিনো লেবেলের গাউন। সুন টু বি মম এই গালার রেড কার্পেটে বেবি বাম্প রিভেল করেন। ৩০ ঘণ্টা ধরে পোশাকটিতে ক্যামেলিয়া ফুলের মোটিফের অলংকরণ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেই পোশাকের পর্দা সরিয়ে রিয়ানা নিজের নতুন পরিচয় উন্মুক্ত করেছিলেন, যেন ক্যামেলিয়া বাগানে দেবশিশুর অপেক্ষা। বিশেষ এই গাউনের সঙ্গে ছিল ১৬ ফুট লম্বা ট্রেইন। রিয়ানা লালগালিচায় ধবধবে সাদা ফুল হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন।
টম ব্রাউনের নকশার পোশাক পরে এসেছিলেন অলিভিয়া রড্রিগো। তার পোশাকে ক্যামেলিয়ার মিনিমাল উপস্থিতি ছিল সাদাকালোজুড়ে। অ্যান হ্যাথওয়েরের পোশাকেও ক্যামেলিয়ার কী দৃপ্ত উপস্থিতি! ক্রিম আর সোনালির সন্ধির পোশাকে এই ফুলের অবস্থান স্লিট গাউনকে কোমল করে তুলেছে। শ্যানেলের সোনালি সেফটি পিন বন্ধনে চল্লিশ বছরের অ্যান যেন চিরযৌবনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন। ভারসাচি তৈরি করেছিল এই গাউন। জেনি কিমের পোশাকেও ছিল ক্যামেলিয়ার কারুকাজ। মিল্ক হোয়াইট অফ শোল্ডার ফ্রকে ফুলটি প্রস্ফুটিত হয়েছে নিজ মহিমায়।
নিকোল কিডম্যান হাজির হয়েছিলেন ভিনটেজ শ্যানেলের পোশাকে। বো মোটিফ স্থান পেয়েছে তার পোশাকে। নাওমি ক্যাম্পবেলও বেছে নিয়েছিলেন একই ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাক। তালিকা এখানেই শেষ নয়, আরও বহু সেলিব্রিটি কার্লের জন্য হাজির হয়েছিলেন ক্যামেলিয়ার ভালোবাসা নিয়ে। সেরেনা উইলিয়ামস এসেছিলেন গুচির মারমেইড কাট গাউনে। সাদা-কালো মৎস্যকন্যা হয়ে এসেছিলেন এই টেনিস কিংবদন্তি। তার গয়নায় টিফানি অ্যান্ড কোং-এর ছিল সরব উপস্থিতি।
এমিলি ইন প্যারিস সিরিজে মন মজেছিল দর্শকদের। তারকা লিলি কলিনসের প্রতি আগ্রহের পারদ তখন থেকেই বাড়ছে। ডিজাইনার ভেরা ওয়াংয়ের নকশা করা গাউনে এসেছিলেন তিনি। কালো আর সাদার পাশাপাশি অবস্থান এই পোশাকে। আর এর ট্রেইন হয়ে উঠেছে সবিশেষ। সেখানে কালোর ওপরে সিলভারের উপস্থিতি ছিল কার্লের নামের মাঝে। এমব্রয়ডারির সুই-সুতা আর চুমকিতে জ্বলজ্বল করছিল প্রিয় ডিজাইনারের প্রতি ভালোবাসা।
এবারের মেট গালায় নিয়ম ভাঙার গান গেয়েছেন পেদ্র পেসকাল। নি লেন্থেরও ওপরে বটমের সীমারেখা টেনেছেন তিনি। ব্লেজার আর ওভারকোটের সঙ্গে পেয়ার আপ করেছেন কালো হাফপ্যান্ট। আর পায়ে ঝাঁ-চকচকে কালো বুট! অন্যদিকে, মার্কিন র্যাপার কার্ডি বি-এর পোশাকে এবার বিস্মিত দর্শক। তিনি একটি নয়, দুটি পোশাকে প্রস্তুত হয়েছিলেন। গোলাপি একটি পোশাকে হোটেল থেকে যাত্রা শুরু করেন। রেড কার্পেটে দেখা মেলে কালো-সাদায়। করসেট বল গাউনে আসেন তিনি। কালো রঙের এই জমকালো গাউনে গোলাপের মোটিফের ছিল সরব উপস্থিতি। সঙ্গে নেকলাইন থেকে সাদার সমাদর। পোশাকটি চেনপেং স্টুডিওর একটি ক্রিয়েশন। তার হেয়ার ডুও নজর কেড়েছে। সিলভার উইগ আর কালো হেড ব্যান্ডে দারুণ উদ্ভাসিত হয়েছিলেন এই মার্কিন র্যাপার।
জিজি হাদিদ কালো সি থ্রু পোশাকে এসেছিলেন রেড কার্পেটে। এটি জিভাঁশির পোশাক। অলংকারের আতিশয্য ছিল না, বরং তিন লেয়ারের মুক্তার মালায় স্নিগ্ধতার সরল রূপ। অন্যদিকে, জেনিফার লোপেজের মোহ থেকে দর্শকের নজর সরানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। কালো আর গোলাপি—এই দুই রঙের গাউন ছিল তার পরনে। ট্রেইনের দৈর্ঘ্য বেশ। কার্লের প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি মৌর্নিং ভেইল বা শোকাতুর নেকাবে চোখ ঢেকেছিলেন। রালফ লরেন লেবেলের পোশাক এটি।
ফ্যাশনিস্তাদের অনেকেরই জানা, কার্ল লাগারফেল্ডের পোষা বিড়াল শুপেটও ছিল নিজ মনিবের মতোই বিখ্যাত। অস্কার দে লা রেন্টা গাউনে শুপেট প্রাণিত লুকে হাজির হয়েছিলেন র্যাপার দোজা ক্যাট। অভিনেতা জারেড লোটো চমকে দিয়েছেন ফ্যাশন বিশ্বকে, নিজেই শুপেট সেজে হাজির হয়ে! বলিউড অভিনেত্রী আলিয়া ভাটের এটি ছিল মেট গালায় প্রথম উপস্থিতি। নেপালি ডিজাইনার প্রবাল গুরুংয়ের ডিজাইনকৃত পোশাক ছিল তার পরনে। এটিও শুপেট প্রেরণায় তৈরি। টুইনিংয়ে দেখা গেছে বলিউড তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এবং তার জীবনসঙ্গী নিক জোনাসকে। ব্ল্যাক মাইসন ভ্যালেন্টিনো গাউনে হাজির হয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা। থাই লসিট এই ড্রেসের সঙ্গে হোয়াইট গ্লাভস পরেছিলেন তিনি। নিকও পরেছিলেন ভ্যালেন্টিনোর ব্ল্যাক স্যুট। অনুষঙ্গ ছিল টাই আর চাংকি সুজ।
বিজনেস উওম্যান ইশা আম্বানি এসেছিলেন ব্ল্যাক শাড়ি গাউনে। প্রবাল গুরুংয়ের ফ্লোর লেন্থ সিল্ক শিফনে ট্রেইন ছিল। তাতে ক্রিস্টাল ও মুক্তোর কারুকাজ। নাতাশা পুনেওয়ালা এসেছিলেন সাদা-কালোর মিশেলে। স্কাল্পটেড মিরর ড্রেসে শোল্ডার স্পাইক তাকে আনকোরা করেছে। এন্টারটেইনমেন্ট দুনিয়ার পাশাপাশি বিজনেস ওয়ার্ল্ডের অংশগ্রহণে এবারের মেট গালা সব মিলিয়ে ছিল দারুণ জমকালো। সামনের বছরের অপেক্ষা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দেখা যাক এবারের মতো নতুনের জোয়ার মেট গালাকে কতটা মাতাতে পারে!
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট