কভারস্টোরি I ঠাকুরবাড়ি : রূপ হতে রূপান্তরে
এ যেন আশ্চর্য রূপকথার কোনো বাড়ি। যার প্রতিটি কোণ সাহিত্যে প্রাণ সঞ্চারণ করেছে উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে। গেয়েছে বাঙালি নারীকে আধুনিক করে তোলার জয়গান। অন্দরমহলের ঘেরাটোপ থেকে বহির্জগতের আলোয় নিয়ে আসার পথ দেখিয়েছে। শুধু কি তাই! স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক পরিষেবা থেকে কৃষিকাজ- বাঙালির সার্বিক সমাজজীবন আর জীবনধারায় ছোট রাস্তা থেকে কী করে বড় রাস্তায় পৌঁছে যাওয়া যায়, তার আঁতুড়ঘর ছিল এই বাড়ির অন্দরমহল। যেন সাধারণকেও অসাধারণ করে তোলার জাদুমন্ত্রের হদিস ছিল ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে। এমন বাড়ির বাসিন্দাদের নিয়ে কৌতূহল জাগাই তো স্বাভাবিক। পোশাকে প্রথাভাঙার পথিকৃৎ তো তারা প্রথম থেকেই। তাতে আলোকপাত হয়েছে বহুবার, বহুভাবে। সেই আলোচনা আজও সরগরম। কিন্তু ভাববার বিষয়, তারা যা-ই পরতেন, তাতেই তাদের এত চমৎকার দেখাত কী করে! শুধু কি পোশাকে নকশার কারিগরি? নাকি তাতেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তাদের প্রতিদিনকার শাণিয়ে নেওয়া রূপ? কী পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তারা বাঙালির রোজকার রুটিনে? সেই রহস্যের খোঁজ করেছেন জাহেরা শিরীন
কান পেতে রই
কলকাতার বাতাসে তখন কান পাতলে শোনা যেত ঠাকুরবাড়ির নারীদের রূপের কথা। তাদের নাকি মোমের মতো পলিশ করা দুধের সরের মতো নরম ত্বক, একঢাল কালো চুল, টিকালো নাক আর হরিণের মতো মায়াময় কাজল-কালো চোখ। শোনা যায়, অতি সাধারণ ঘরের, সাধারণ রূপের গ্রাম্য বালিকারা বউ হয়ে ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে অন্তঃপুরে পা রাখলেই হয়ে উঠতেন অপরূপা নারী। সবার কাছে সে ছিল এক বিরাট রহস্য। রবীন্দ্রনাথের মাতামহী দিগম্বরী দেবী বিখ্যাত ছিলেন তার জগদ্ধাত্রীর মতো রূপের জন্য। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং, পিঠে একঢাল কোঁকড়া কালো চুল, চাঁপাকলির মতো হাতের আঙুল আর দেবী প্রতিমার মতো দুখানি পা। দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা দেবীও ছিলেন গৌরাঙ্গী, তার হাতের আঙুলও ছিল চাঁপাকলির মতো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, চাঁপা ফুল দেখলেই তার মায়ের চাঁপাকলির মতো আঙুলের কথা মনে পড়ে যেত। রবীন্দ্রনাথের মেজ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীও তার শাশুড়ির চাঁপাকলির মতো হাতের কথা উল্লেখ করেছিলেন লেখায়। গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া দেবীও ছিলেন অপরূপা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’তে তার বড় পিসিমা কাদম্বিনী দেবীর কথা উদ্ধৃত করে জানিয়েছিলেন, ‘বড় পিসিমা বলতেন, আমার মার মতো অমন রূপসী সচরাচর আর দেখা যায় না। কী রং, যাকে বলে সোনার বর্ণ। মা জল খেতেন, গলা দিয়ে জল নামত স্পষ্ট যেন দেখা যেত; পাশ দিয়ে চলে গেলে গা দিয়ে যেন পদ্মগন্ধ ছড়াত।’ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন প্রফুল্লময়ী দেবীর রূপের কথা। স্বর্ণচাঁপার পাপড়ির মতো গায়ের রং ছিল তার। রূপকথার রাজকন্যাদের মতো গায়ের রং আর রূপ ছিল বলেই হয়তো পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে মহর্ষিকন্যা সৌদামিনী দেবী ও তার খুড়তুতো বোন কুমুদিনী যখন পেশোয়াজ পরে বাড়ির পালকি চেপে বেথুন স্কুলে পড়তে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের ধবধবে ফরসা শ্বেতপাথরের মতো গায়ের রং দেখে পুলিশ ভেবে বসেছিল, তারা ইংরেজ মেয়ে। তাদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শোনা যায়, এ নিয়ে দারুণ হুলুস্থুল কা- বেধে বসেছিল তখন। কলকাতার শিক্ষিত যুবকদের কানে পৌঁছেছিল ইন্দিরা দেবীর রূপের কথাও। কাটা কাটা ধারালো মুখশ্রী, সুন্দর গায়ের রং, বড় বড় দুটি উজ্জ্বল চোখ, রজনীগন্ধার মতো সতেজ সুন্দর দেহলতার অধিকারিণী ছিলেন যিনি।
ঠাকুরবাড়ির নারীরা যেমন সুন্দরী ছিলেন, তেমনি পুরুষেরাও ছিলেন সুন্দরের প্রতিমূর্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই তার দাদারা প্রত্যেকেই ছিলেন দীর্ঘ, সুঠাম দেহাকৃতির। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, টিকালো নাক, মসৃণ চিকন ত্বক আর চকচকে চিকন চুলের অধিকারী। দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রূপের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন তারা। প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি এর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের মতো সুপুরুষ কখনো দেখিনি।’ কবির অন্যতম ব্যক্তিগত চিকিৎসক পশুপতি ভট্টাচার্য ‘অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘কে না জানে তার তুলাবিহীন দেহ-সৌন্দর্যের কথা, তবে তিনি তো সাজসজ্জার বাহার কিছু করতেন না বিশেষ, দেহের প্রায় সবটাই ঢাকা থাকত আপাদলম্বিত আলখাল্লা দিয়ে। দেখা যেত কেবল পা দুটি, হাত দুটি আর মুখটি। কিন্তু সেই মুখের সৌন্দর্যই যে অতি অনুপম। সেই মুখের রূপবৈশিষ্ট্য এমন, সে তা চিরদিনের জন্য জগৎচেনা হয়ে আছে। যেকোনো দেশের যেকোনো ব্যক্তি ওই মুখের ছবি দেখবে, সে-ই নির্ভুলভাবে বলবে, ইনি রবীন্দ্রনাথ।’ ডা. ভট্টাচার্য চিকিৎসার প্রয়োজনেই কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তাই কবির রূপ বর্ণনা করতে পেরেছিলেন নিখুঁতভাবে। তিনি লিখেছিলেন, ‘বৈশিষ্ট্য ছিল তার চুলে ও দাড়িতে। ছবিতে দেখে সে বৈশিষ্ট্য হয়তো পুরোপুরি বোঝা যায় না, কিন্তু কাছ থেকে যারা দেখেছেন, তারাই জানেন যে সেই চুল ও দাড়ির কেমন চমৎকারিত্ব। যার তুলনা জগতে কোথাও মেলে না। শ্বেতশুভ্র ঈষৎ ঢেউখেলানো চুলগুলো যেমন চিক্কণ, তেমনই মসৃণ, সুবিন্যস্ত ও ঝরঝরে। মাথা ও মুখ যেন আলুলায়িত ঝালরের ঝিরঝিরে রুপোলি পতাকাসূত্রগুলো দিয়ে ঘেরা। সেই চুলই তার সমস্ত মুখখানিকে এক অপরূপ আলোকের দীপ্তি দিয়ে মুখপদ্মের মতো ফুটিয়ে তুলে ধরেছে। তাই তিনি হাসতে মনে হত যেন পদ্মফুলের হাসি।’
দুধে আর মদে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথাতে মেলে মজার সব তথ্য। তিনি বলেন, মহর্ষিকন্যা শরৎকুমারী দেবীর স্বামী যদুনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুরসিক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ঘরজামাই। ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা কী করে এত ফরসা হয়, তা নিয়ে শহরের অনেকেরই কৌতূহল ছিল। একবার এক ব্যক্তি সেই প্রশ্নটাই করেছিলেন যদুনাথকে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দুধে আর মদে’। সম্পদের অভাব না থাকায় প্রচুর দুধ, ফল, শাকসবজি খাওয়ার চল ছিল ঠাকুরবাড়িতে। বাসিন্দারা জানতেন, সঠিক খাওয়াদাওয়ার ওপরেই ত্বক, চুল আর শরীরের ঔজ্জ্বল্য নির্ভর করে। সকালে তাই ঘুম থেকে উঠেই আদাকুচি আর অল্প আখের গুড় দিয়ে কল-বেরোনো ছোলা ও গোটা মুগ খাওয়ার চল ছিল। তারপর সঠিক সময়ে জলখাবার খাওয়া। তাতে লুচি-তরকারি থাকলেও সঙ্গে দুধ ও নানা রকম ফলও থাকত। খাঁটি প্রচুর দুধ ও ফল খাওয়া হতো বলেই ত্বক ও চুলে একটা আলাদা জেল্লা আসত। ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের কোনো দিনও আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মতো আটপৌরে ধরনের জীবনযাত্রা ছিল না। জীবনচর্যায় নিয়মকে নিগড় না ভেবে আপন করে নিয়েছিলেন বলেই হয়তো তাদের মধ্যে লক্ষ করা যেত একটা আলাদা সৌন্দর্য। সে জন্য যশোরের সুন্দরী মেয়েদের ঠাকুরবাড়িতে বউ করে আনার পরও সেই রূপকে ধরে রাখার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাসের দিকে বাড়তি নজর দেওয়া হতো সব সময়।
চন্দ্রে তব মুখশোভা, মুখে চন্দ্রোদয়
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা জন্মসূত্রেই রূপসী ছিলেন। তার ওপর নিয়মিত রূপচর্চায় তাদের রূপ যেন আরও ফেটে পড়ত। তাদের কাছে ছিল অফুরন্ত রূপটানের সন্ধান। যেমন ১০-১২টা কাঠবাদাম খানিকটা দুধে তিন-চার ঘণ্টা ভিজিয়ে বেটে নিয়ে তাতে অল্প দুধ আর জাফরান মিশিয়ে তারা রূপটান বানাতেন। আবার মধু, বার্লি গুঁড়া আর ডিমের সাদা অংশ মিশিয়েও মাখানো হতো মুখে। বসন্ত বা ব্রণের দাগ তুলতে নরম কাপড় বা তুলা ডাবের পানিতে ধুয়ে নিতেন। এভাবে নিয়মিত মাখলে দাগ চলে যেত। এখন তো অনেক রকম ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সে সময় অতশত জিনিস পাওয়া যেত না। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও একধরনের রূপটান বাড়িতে তৈরি করতেন, যা ত্বকরঙের ঔজ্জ্বল্য তো বাড়াতই, সঙ্গে গায়ের রংও ফর্সা করে তুলত। এই বিশেষ ক্রিমকে তারা বলতেন বিডি ক্রিম। এটা বানাতে ব্যবহৃত হতো আধা আউন্স শক্ত প্যারাফিন, ২ আউন্স সাদা ভ্যাসলিন, আধা চা-চামচ বোরিক পাউডার, ক্যামফর অয়েল, গন্ধের জন্য অল্প চন্দন তেল। প্রথমে প্যারাফিন গলিয়ে নিয়ে ছেঁকে আগুনে বসিয়ে তাতে নাকি সব কটি উপাদান মিশিয়ে নামিয়ে নিতেন। খানিকক্ষণ রেখে দিলেই সেটা জমে যেত। এই ক্রিম মুখে মেখে খানিক পরে কাপড় দিয়ে মুছে নিতেন তারা। স্নানের আগে শরীরে মাখার জন্য তৈরি হতো বিশেষ রূপটান। সর সমেত আধা পেয়ালা দুধে দুই চা-চামচ ময়দা, দুই চা-চামচ কমলালেবুর খোসাবাটা, দু-চার ফোঁটা মধু, দুই চা-চামচ সুগন্ধি তেল, মঞ্জিষ্ঠার (লাল একধরনের লতাবিশেষ, যা বেনেদের দোকানে পাওয়া যেত) কয়টি পাতা একসঙ্গে মিশিয়ে মাখা হতো সারা গায়ে। সাবান তারা ব্যবহার করতেন না। বদলে ব্যবহার করা হতো বেসন। তবে গ্লিসারিন সাবান মাখা হতো। একটা শিশিতে গ্লিসারিন, গোলাপজল আর কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে রেখে দেওয়া হতো। শীতকালে স্নানের পর এটা গায়ে মাখলে আর চামড়া ফাটত না। তারা নিজেরাই বাড়িতে বসে বানিয়ে নিতেন মোমরুট বা মোমরাট নামের একরকম ঘরোয়া ক্রিম। এর জন্য জোগাড় করতে হতো মৌচাকের মোম। পাথরের বাটিতে ঘষে ঘষে সেই মোম গুঁড়া করতেন তারা। তারপর তাতে অল্প নারকেল তেল ভালো করে মিশিয়ে ক্রিমের মতো করে কৌটায় ভরে রাখতেন। সারা বছর স্নানের পর তারা এই ক্রিম গায়ে মাখতেন। চামড়া ভালো রাখতে। বাড়ির ছোটদেরকেও একইভাবে নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতে শেখানো হতো। তারা সঠিক যত্ন নিচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা হতো। শরীরের ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে কমলালেবুর খোসাগুঁড়া, বেসন আর কাঁচা দুধ মিশিয়ে বানানো রূপটান মেখে স্নানের প্রচলন ছিল ঠাকুরবাড়িতে। ত্বক নিষ্প্রাণ হয়ে গেলে সরময়দার রূপটানের সঙ্গে লেবুর খোসাবাটা আর কুসুম ফুলের বীজ বাটা মিশিয়েও গায়ে মাখতেন। আর রোদে পোড়া ত্বকের জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। সমুদ্র বা পাহাড় থেকে ঘুরে আসার পর আটা শুকনো করে মুখে আর গায়ে মাখিয়ে নিয়ে ঘষতেন, দুই দিনের মধ্যেই ত্বক আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠত। বাড়িতেই ঘরোয়া উপায়ে বানানো হতো অ্যাসট্রিনজেন্ট। শসা চাকা চাকা করে কেটে সেগুলো আধা কাপ কাঁচা দুধে খানিকক্ষণ রেখে সেটি মুখে মাখলেই অ্যাসট্রিনজেন্টের কাজ করত।
রূপচর্চায় পিছিয়ে ছিলেন না ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরাও। নিকট সান্নিধ্যে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক পশুপতি ভট্টাচার্যের মধ্যে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা হতো। আর তা থেকেই পাওয়া যায় কবির রূপচর্চাসংক্রান্ত খুঁটিনাটি নানা তথ্য। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ শরীরে ডালবাটা মাখতেন, আধা বাটা সর্ষের সঙ্গে মিশিয়ে। এতে চামড়া মোলায়েম থাকত। ঠাকুরবাড়িতে নারী-পুরুষনির্বিশেষে ছিল রূপটান মেখে ¯œান করার চল। কবি অবশ্য পরে ‘তরলা’ সাবান ব্যবহার করতেন। এই লিকুইড সাবান তাকে জোগান দিতেন ডা. পশুপতি ভট্টাচার্যের ভাই বিজ্ঞানী গিরিজাপতি ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন তার ভাইবোনদের চেয়ে কালো। তার ওপর ছোটবেলায় মাটি মেখে কুস্তিও করতেন। এ জন্য তার মা তাকে ধরে বাদামবাটা, সর, কমলালেবুর খোসাবাটা মিশিয়ে গায়ে মাখিয়ে দিতেন।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘পুরাতনী’ থেকে জানা যায়, দেবেন্দ্রপত্নী সারদা দেবী একটা তক্তপোষে বসে থাকতেন, তার তত্ত্বাবধানে দাসীরা ছেলের বউদের রূপটান মাখাতেন। জ্ঞানদানন্দিনী লিখেছেন, ‘প্রথম বিয়ের পর শাশুড়ি আমাদের রূপটান মাখিয়ে রং সাফ করার চেষ্টা করতেন।’ ছোট বউদের এভাবেই অভ্যাস গড়ে তোলা হতো। এ বাড়ির মেয়েরা সারা দিনে অন্তত একবার স্নানের আগে দুধের সর আর ময়দা ভালো করে মিশিয়ে সারা গায়ে মেখে খানিকক্ষণ রেখে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে শরীরের ময়লা তুলতেন। তারপর ভালো করে তা ধুয়ে গামছা দিয়ে গা ঘষতেন। এতে ত্বক মসৃণ হয়ে উঠত, রোমও তেমন বাড়ত না। এভাবেই অমন ফরসা পেলব হয়ে উঠতেন তারা। তা ছাড়া বাড়ির মেয়েরা রোদেও খুব একটা বেরোতেন না। ছোট মেয়েদের মধ্যে যারা রোদে খেলা করত, তাদের এই সরময়দার সঙ্গে হলুদ আর লেবুর রস মিশিয়ে মাখিয়ে দেওয়া হতো। মসুর ডাল যেমন ত্বকের ময়লা তুলে দিত, লেবুর রস তেমনি সারাত রোদে পোড়া দাগ। ছোট ছেলেদেরও তাদের মায়েরা ধরে ধরে এসব মাখিয়ে দিতেন।
গোসলের সময় পাতলা হাতলওয়ালা ঝামা দিয়ে পায়ের গোড়ালি, হাতের কনুই আর পুরো শরীর ঘষার রেওয়াজ ছিল। সরময়দা মেখে স্নানের পর সবাই গায়ে ভালো করে খাঁটি সরিষার তেল বা বিলেত থেকে আনানো অলিভ অয়েল মালিশ করতেন। সপ্তাহে এক দিন ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে নাপিতানি আসত। সবার হাত-পায়ের নখ কেটে ঝামা দিয়ে পরিষ্কার করে দিত। পরিয়ে দিত আলতা।
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা
কীভাবে বাঙালি নারী সাজবে, কোন দিকে সিঁথি কেটে চুল বাঁধবে, চুলের খোঁপার ছাঁদ কেমন হবে- এসবের পাশাপাশি কী কী ব্যবহার করলে রূপ আরও খোলতাই হবে এবং নারী তার রূপের দ্যুতি বাড়িয়ে তুলতে কোন কোন প্রসাধনী ব্যবহার করবে- সবকিছুরই হদিস দিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা।
অবনঠাকুরের দিদিমা গিরীন্দ্রপত্নী যোগমায়া দেবী খুব ভালো সাজাতে পারতেন। তিনি তার ছোট জা ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে তার স্বামীর কাছে পাঠানোর আগে নিজ হাতে বেনেখোঁপা বেঁধে, ভালো শাড়ি পরিয়ে, আতর মাখিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে কনে বউয়ের মতো সাজিয়ে পাঠাতেন। ভালো সাজাতেন মহর্ষি পরিবারের গৃহরক্ষয়িত্রী মহর্ষিকন্যা সৌদামিনী দেবীও। বোনদের বা বাড়ির বউদের তিনিই নিখুঁত করে চুল বেঁধে সাজিয়ে দিতেন।
৫ নম্বর বাড়ির মেয়ে বিনয়িনী দেবীও চমৎকার খোঁপা বাঁধতে পারতেন। বোনঝি, ভাইঝিরা তার কাছেই চুল বাঁধতে যেত। তিনি বেনেবাগান, মনভোলানো, ফাঁশজাল, কলকা, বিবিয়ানা- কত রকম ছাদের খোঁপাই-না বেঁধে দিতেন তাদের চুলে। গগনেন্দ্রকন্যা সুজাতা দেবী এবং তার দিদি সুনন্দিনী দেবীর অনেক চুল ছিল। তারা বাঁধতেন খেজুর ছড়ার খোঁপা। এ জন্য মাথা পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাতা কেটে পেছনে অনেক বিনুনি করে খোঁপা বাঁধতে হতো। সাজানোর জন্য তাতে দেওয়া হতো সোনার ফুল, সোনা বা রুপোর চিরুনি অথবা কাঁটা, এমনকি সোনার মালাও।
এরপর শুরু হতো মুখের প্রসাধন। প্রথমে তারা মাখতেন ভিনোলিয়া ক্রিম। সেটি চটচটে লাগলে তার সঙ্গে মেশানো হতো গোলাপজল। তারপর ক্রিম ভালো করে মুছে মাখানো হতো চন্দনগুঁড়ার পাউডার। কাজল বা সুরমা দিয়ে চোখের প্রসাধন করতেন তারা। বাড়িতেই মনসাপাতায় ঘি লাগিয়ে প্রদীপের শিখায় ধরে তৈরি হতো কাজল। ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা আমৃত্যু মনসাপাতার কাজল পরেছেন রাতে শোয়ার সময়। এতে বয়সকালে চোখে জলকাটার সমস্যা হতো না। অল্পবয়সী মেয়েরা রুপার কাজল লতায় কাজল বানিয়ে চোখে দিত। আর বউয়েরা চোখে মাখতেন সুরমা। ভ্রুর রঙের গাঢ়তা আনতে কক পুড়িয়ে তা দিয়ে দিতেন টান। রুজের বদলে তারা সিঁদুরগুঁড়া হালকা করে গায়ে দিয়ে গাল রাঙাতেন। ঠোঁট রাঙাবার জন্য ছিল পান।
তারা নানা রকম টিপ পরতে ভালোবাসতেন। শিউলি ফুলের পাপড়ি দিয়ে একরকম টিপ বানাতেন। তা বানাবার ছিল বিশেষ পদ্ধতি। শিউলি ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে বেটে একটি লোহার পাত্রে রেখে তাতে দেওয়া হতো অল্প খয়ের। খানিক পরেই তা কালো রঙের হয়ে যেত। তা দিয়ে তারা কপালে নানা নকশা করে টিপ পরতেন। এ ছাড়া মরা কাঁচপোকার ডানা ছিঁড়ে সেটিকে গোল করে কেটে চকচকে টিপও পরা হতো কপালে। এগুলো ছিল কুমারী মেয়েদের জন্য। আর বিবাহিতরা পরতেন সিঁদুরের টিপ।
ছিল আলতা পরারও প্রচলন। তবে বোতলে কেনা আলতা নয়, আলতাপাতা ছিঁড়ে হাতে গুলি পাকিয়ে টিপে টিপে রস বের করে তা বাড়ির মেয়ে, বউদের পায়ে পরিয়ে দিতেন নাপিতানিরা। এয়োস্ত্রীদের পায়ের তলাতেও আলতা পরার প্রচলন ছিল। আর অবিবাহিত মেয়েদের পায়ের পাশ দিয়ে সরু নকশা করে তারপর আঙুলগুলো আলতা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হতো। হাত-পায়ের আঙুল রাঙানো হতো মেহেদিপাতা বাটা দিয়েও।
দেশি প্রসাধনীর দারুণ কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে। কনের তত্ত্ব সাজাতেও তা ব্যবহৃত হতো। গগনেন্দ্রনাথের কন্যা পূর্ণিমা দেবী তার ‘ঠাকুরবাড়ির গগনঠাকুর’ বইতে লিখেছিলেন, তার বিয়েতে তার বাবা তত্ত্বে সব দেশি জিনিস দিয়েছিলেন। তখন দেশি ভালো পাউডার ও পাউডারের পাফ পাওয়া যেত না বলে চন্দন কাঠ গুঁড়িয়ে বাড়িতেই পাউডার বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।
সুগন্ধের জন্য তখন মাখা হতো আতর বা গোলাপজল। সারদা দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী- এরা সবাই গায়ে তা মাখতে পছন্দ করতেন। বাড়ির পুরুষদের কাছেও আতরের কদর ছিল। ‘তেল, বেসন, সরময়দা- কত রকম যে তখনকার প্রসাধন দ্রব্য ছিল, তার সেবনবিধি জানলেও কাজে লাগালে হয়তো আমাদের আধুনিকাদের আরেকটু রঙের জলুষ হত।’ এমনটাই লিখেছিলেন ইন্দিরা দেবী তার ‘স্মৃতিসম্পুট’ গ্রন্থে। একদমই ভুল বলেননি কিন্তু। সে সময় ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেক নারীর পোশাক পরার ধরন, পরিমিত সাজগোজ, রূপ রক্ষার কৌশল- সবেতেই ছিল নবজাগরণ ও আন্তঃসাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ছায়া। যা আজকের আধুনিকাদের জন্যও দারুণ দৃষ্টান্ত। প্রথা ভাঙার পথিকৃৎ হবার অনুকরণীয় উদাহরণ।
তথ্য সংগ্রহ: শান্তা শ্রীমানী, ঠাকুরবাড়ির রূপ-কথা
মডেল: তাসনিয়া ফারিণ ও নাহিদ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সেইলর
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: ফারাবী তমাল