skip to Main Content

টেকসহি I বিকল্প বিস্ময়

দূষণে বিপত্তি। বর্জনে বিলম্বের ভয়। ফ্যাশনে প্রাণিদেহ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত সচেতনেরা সমাধান খুঁজছেন অন্যত্র। উদ্দেশ্য—প্রাণিকুল রক্ষা, সঙ্গে ধরণিও

 যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণী-সচেতনতামূলক প্রতিষ্ঠান অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, অন্তত ৫ বিলিয়ন পশু ও পাখি প্রতিবছর ফ্যাশন শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
 প্রাণিকুল থেকে প্রাপ্ত উপাদানে তৈরি পণ্য আভিজাত্য, সাহস, প্রতাপের প্রতীক হিসেবে কদর পেয়ে আসার কারণে নিয়মিত চাহিদা বাড়ছে।
 নিরীহ প্রাণীদের ওপর অত্যাচার পৌঁছেছে নৃশংসতার চূড়ান্তে। টনের পর টন আবর্জনা জমেছে মাটি আর পানিতে। বাতাস হয়েছে ভারী। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে।
পশ্চিমা বিশ্বে ফেদার, লেদার, ফার ও ডাউনের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। শীতপ্রধান হওয়ার কারণে এসব দেশের পোশাকে তাপমাত্রা সংরক্ষণ করতে পারে এমন ম্যাটেরিয়ালের বিশাল বাজার রয়েছে। সর্বাধিক ব্যবহৃত উপাদানের তালিকায় লেদার, ফেদার, ডাউন, উল, ফারের নাম আসে। এর কারণ এসবের গুণগত দিক। কম তাপমাত্রার দেশের ক্লদিং এবং বেডরুম প্রোডাক্ট তৈরিতে হালকা ওজনের র ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের চাহিদা আছে। ডাউন অর্থাৎ পাখির গলার কাছাকাছি অবস্থিত চামড়া, পালক ব্যবহারে আইটেমগুলোর ওজন কম থাকে। আবার উল, পশম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় উইন্টার আউটারওয়্যারে। আর চামড়ার তৈরি পণ্যের চাহিদা আকাশচুম্বী বহুকাল ধরে। সৌন্দর্য এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে এই বাজারের কলেবর বেড়েছে। ফল—বেশি লাভের আশায় নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে ফ্যাশন বিশ্ব।
পিপল ফর দ্য ইথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিমেলসের (পেটা) ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিমি বেথেচি বলেছেন, ফ্যাশন এলিগেন্স এবং সৌন্দর্য উদ্‌যাপনের উপকরণ হওয়ার কথা ছিল; পীড়া কিংবা অত্যাচারের প্রতীক নয়। নন্দিত অনেক ব্র্যান্ডকেই এই নিন্দিত কাজে অংশ নিতে দেখা গেছে। এই অমানবিক আচরণ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হিসেবে পেটা পরামর্শ দেয় বিকল্প ব্যবহারের। যা কিছু অ্যানিমেল বডি থেকে প্রাপ্য, এর সবকিছু বর্জনের মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে প্রতিকার। পশুবান্ধব বিকল্পগুলো চোখের দেখায় একদমই আলাদা কিছু নয়। আবার, গুণাগুণও একই ধরনের। ক্রেতাসন্তুষ্টি আশাব্যঞ্জক বলেই জানা যায়। তবে গ্রিন মার্কেটিং পলিসি একে আরও এগিয়ে নেবে বলে ধারণা করা যায়।
বিকল্পে সমাধান
লেদার
গ্লোবাল সিনথেটিক লেদার মার্কেট অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালে কৃত্রিম চামড়া থেকে তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়বে। সিনথেটিক লেদারকে বিকল্প উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হলেও এর আবিষ্কারে প্রকৃতি দূষিত হয়েছে প্রচণ্ড। আবার ব্যবহারকারীদের আক্ষেপের ঝুড়িও বিশাল। তাদের সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব দিয়ে এই সেক্টর উন্নয়নের চেষ্টা চলেছে নিয়মিত।
ইকো ফ্রেন্ডলি লেদারের বাড়তি চাহিদা থাকায় চামড়া তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে কফি, সামুদ্রিক শৈবাল, মাশরুম ও মাছের চামড়া। প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় এমন কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না, যা পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। একইভাবে এভাবে উৎপাদিত লেদার গুডসও ক্ষতিকর নয় বলে জানা যায়। ভেজিটেবল ট্যানড লেদারও এমনই একটি আবিষ্কার। এই আধুনিক ধরনগুলো টক্সিক ক্রোম-ট্যানড লেদারের মতো পরিবেশদূষণ করে না। পোশাক, জুতা, ব্যাগসহ নানান রকম অনুষঙ্গ তৈরিতে ব্যবহার উপযোগী তো বটেই, পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি যত্নবান এই লেদার। স্টেলা ম্যাককার্টনি, ভিরা এবং কালথ্রেড ভেগান লেদারের ব্র্যান্ড। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনে, চামড়া এবং চামড়া থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যরে পরিমাণ কমায়। ভেগান লেদার ছোট ছোট গাছগুল্ম থেকে তৈরি করা হয়। আনারস গাছের পাতা এর মূল উপাদান। পাইনঅ্যাপল লেদার এরই মধ্যে বাজারে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। একই পথে আছে অ্যাপল থেকে তৈরি অ্যাপল লেদার।
ফেদার
ইকো ফ্রেন্ডলি লেদারের মতো ইকো ফ্রেন্ডলি ফেদারের প্রতিও আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। ডিজাইনাররা ব্যবহার করছেন এসব পালক। যার মূল উপাদান তিন ধরনের হতে পারে—শতভাগ প্রাকৃতিক, শতভাগ সিনথেটিক অথবা প্রাকৃতিক ও সিনথেটিকের মিশেল। প্রকৃতি থেকে পাওয়া উপাদানে তৈরি পালক ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত। বাজারের নামকরা ইকো ফ্রেন্ডলি ফেদার রয়েছে কয়েকটি। পোলারটেক একটি বায়োডিগ্রেডেবল এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ম্যান মেইড লেদারের উদাহরণ। প্রিমালোফ শতভাগ ভেগান লেদার। কোনো ধরনের সিনথেটিক লেদারের উপস্থিতি এতে নেই। ফ্যাব্রিক ও ইনস্যুলেশন তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ডাউন
ডাউনের বিশাল চাহিদার কারণ, এটি অনেক পণ্যের মূল উপাদান। ওজনে হালকা হওয়ার কারণে শীতপোশাক ও কমফোর্টারের জন্য বেশ উপযোগী। পাখির ত্বকের কাছাকাছি লেয়ারের চামড়াকে বলা হয় ডাউন। এটি সংগ্রহের প্রক্রিয়া খুবই নির্মম। তাই এখন রিসাইকেলড পলিয়েস্টার থেকে তৈরি করা হচ্ছে ডাউন; যার নাম রাখা হয়েছে পাম টেক। থার্মালও এমন একটি ইনস্যুলেশন। যার ব্যবহারে দেহে ঘাম উৎপন্ন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফ্লাওয়ার ডাউন ফুল দিয়ে তৈরি করেছে ডাউন। ফুল, বায়োপলিমার এবং অ্যারোজেল ব্যবহারে তৈরি করা হয়েছে এই লেদার। কটন, ওয়াইল্ড সিল্ক, হেম্পও ব্যবহার করা যেতে পারে ডাউনের বিকল্প হিসেবে।
ফার
ইউরোপিয়ান নিয়ম অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে কোনো পণ্যে ফারের ব্যবহার হলে সে সম্পর্কে ক্রেতাকে ওয়াকিবহাল রাখতে হবে। অর্থাৎ লেবেলেই পাওয়া যাবে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত। প্রকৃতির ক্ষতি করবে না, এমন বেশ কিছু ফার এরই মধ্যে ব্যবহার করছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। বায়োবেইজড ফার দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এর মধ্যে হেম্প এবং কোবা বেশ এগিয়ে। গাছা নামের ফারের প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। এটি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ১৮০ দিনের মতো সময় নেয়।
অ্যাংগোরা হেয়ার
অ্যাংগোরা মূলত এক জাতের খরগোশ। এই ছোট্ট প্রাণীর পশম থেকে তৈরি করা হয় অ্যাংগোরা হেয়ার। এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে টেন্সেল। বায়োডিগ্রেডেবল গুণসম্পন্ন বিকল্প এটি। এ ছাড়া হেম্প উল, ব্যাম্বু উল, লিনেন উল, কটন উল, ফ্লাক্স উল বেছে নেওয়া যায়।
শেষ কথা
ক্রুয়েলটি ফ্রি ফ্যাশনের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এ জন্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি সচেতন হতে হবে ক্রেতাকেও। কেনাকাটার সময় পণ্যে সংযুক্ত লেবেল মনোযোগসহকারে পড়তে হবে। অ্যানিমেল ক্রুয়েলটির শঙ্কা থাকলে সচেতনতার সঙ্গে পণ্য বর্জন করা যেতে পারে। শুধু লাইভ প্লাকিং নিষ্ঠুরতা নয়, পেটার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে প্রাণী হত্যাও নিষ্ঠুরতার শামিল। ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি প্রাণিদেহ থেকে কোনো কিছু ব্যবহার করলে তা লেবেলে উল্লেখ করতে বাধ্য। এমন নিয়ম সব দেশে প্রযোজ্য হলে ক্রেতা যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন। আমেরিকান মার্কেটিং সোসাইটি প্রথম ইকো ফ্রেন্ডলি মার্কেটিং বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন করে। সালটি ছিল ১৯৭৫। তখন থেকেই এই দর্শন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রতি সচেতনতার আহ্বানে এ ধরনের পণ্য আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের।

 সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top