ফিচার I প্যালেট ক্লিনজার
প্রস্তুতি পরের সিজনের জন্য। সংবেদনকে পুনরায় শাণিয়ে নেওয়া। সম্ভাবনাময় সব ফ্যাশন-প্রবণতাকে পুরোপুরি উপভোগের ইরাদায়
আদতে কিন্তু ব্যাপারটা স্বাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিসংক্রান্ত। কোনটা আবার—প্যালেট ক্লিনজার! টেস্টবাডকে পুনরায় উসকে দেওয়াই যার মূল কাজ। ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে বহুল ব্যবহৃত। পরিবেশিত হয় মিল কোর্সগুলোর মাঝে মাঝে। ছোট ছোট পোরশনে। খাবার কিংবা পানীয় রূপে। যেন মুখে লেগে থাকা আগের খাবারের স্বাদ মুছে যায় পুরোপুরি। পরবর্তী আহার আস্বাদনে।
কিন্তু ফ্যাশনকে খাবারের পাতের সঙ্গে তুলনা, সে-ও কি হয় নাকি! বাড়াবাড়ি নয়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোটাই মেটাফোর। ক্যালেন্ডারে সময়টা গেল বছরের। স্প্রিং/সামার ২০২৩ নিয়ে ফ্যাশন বিশ্ব মশগুল তখন। হঠাৎ আবির্ভাব কিম কার্দাশিয়ানের। তার এক ছবিতেই দুনিয়া তোলপাড়। লিপস্টিক পরা ঠোঁটে পমোডোরো টপড স্প্যাগেটিতে সুড়ুৎ টান দিচ্ছেন কিম। প্রচারমূলক ছবিটি ছিল #ciakim-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা—ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার সঙ্গে তার ডিজাইন কোলাবোরেশনের। কিন্তু ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা কিমের প্রিমি প্লেটে খুঁজে পেয়েছিলেন ভিন্ন বার্তা। তাজা টমেটো, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল আর রসুনকুচির মতো নিদেন রসনাসংক্রান্ত উপাদানগুলো রূপকের সঙ্গে মিলেমিশে যেন আভাস দিচ্ছিল পুরো ফ্যাশন সিজনের।
তাহলে স্প্রিং/সামার ২০২৩-এ ব্রেড আর বাটার কী ছিল? মানে, বেসিকটা কেমন ছিল, সেদিকেও তো চোখ রাখা চাই। বাড়াবাড়ি রকম এমবেলিশমেন্টের ভিড়ে প্যালেট ক্লিনজারের কাজ করেছে এসেন্স—ড্রিভেন ডিজাইন। ফ্যাব্রিকেশন আর শিলুয়েটের বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে। সহজ-সরল, একদম বেসিক শিলুয়েটে তৈরি। ব্র্যান্ডের ডিজাইন ডিএনএ-কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। চেষ্টা ছিল লেমন সোরবের মতো সতেজ লুক সৃষ্টি। সে সময়কার স্টাইলিংগুলো মিলে যাচ্ছিল ঠান্ডা এক গ্লাস শসার পানির স্বাদে যে সতেজ অনুভূতি, তার সঙ্গে। উদ্দেশ্য একটাই—প্যালেট ক্লিনজিং। মাছের ঝোলে এক মুঠো ধনেপাতা যেমন মুখে লেগে থাকা আগের আস্বাদনের অনুভূতি ভুলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি।
বিশ্বজুড়ে সবকিছু নিয়েই যখন বাড়াবাড়ি, ঠিক তখনই ডিজাইনারদের ঝোঁক এসেনশিয়ালিজমে, অর্থাৎ অপরিহার্যতায়। মিলানে ইতালিয়ান ডিজাইনার লরেঞ্জো সেরাফিনির স্প্রিং/সামার ২০২৩ কালেকশনে তা ছিল সুস্পষ্ট। ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগকে দেওয়া বক্তব্যে সেই চেতনার সুর ছিল পস্ট। তার মতে, আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন মিনিমাল নয়; বরং নিপাট সহজ কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই তো তিনি র্যাম্পে প্রদর্শন করেন বিলাসবিহীন সব পরিধেয়। বেশির ভাগই সুতিতে তৈরি। ড্রেসে নজর কেড়েছিল আরেক ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার রোমিও গিগলি অনুপ্রাণিত নট আর ড্রেপ। সেরাফিনির উদ্দেশ্য ছিল ওভার স্টাইলিং আর ওভার ডেকোরেটিং নিয়ে চরম মাতামাতির মাঝে এমন কিছু সৃষ্টি, যা আগের সবকিছু হটিয়ে নতুন পথ দেখাবে।
সেই সিজনে লন্ডন বেসড ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার মলি গডারডকেও অনুপ্রাণিত হতে দেখা গেছে ফ্যাব্রিকেশনের বিশুদ্ধতম রূপ থেকে। সাধারণত তার কালেকশনে দেখা মেলে টুল, লেয়ার আর চোখধাঁধানো সব রঙের প্রাচুর্য। কিন্তু স্প্রিং/সামার ২০২৩ ছিল একদম আলাদা। মডেলদের পরিহিত মেঝে ছোঁয়া স্কার্ট আর ভলিউমনাস ড্রেসগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল একদম বেসিক ওভেন ফ্যাব্রিক; যা পারফেক্টলি ফিনিশড প্রতিটি পোশাকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। আরেক ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার এমিলিয়া উইকস্টেডকেও সরলতায় নত হতে দেখা গেছে সেই একই সময়ে। তার লি মিলার প্রাণিত কালেকশনে দেখা গেছে ইউটিলিটিরিয়ান কটনের ব্যবহার। এন্ড্রোজিনাস ফ্ল্যাপ পকেটের প্রিস্টিন হোয়াইট শাটিং, নি লেন্থ প্লিটেড স্কার্টসমেত। বিশেষ আয়োজনে যারা পরিপাটি পোশাকে সেজে উঠতে পছন্দ করেন, তাদের প্রতিদিনকার ড্রেসিং কেমন হতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে তার সেবারকার কালেকশনে।
একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছিলেন ম্যাক্স মারার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ইয়ান গ্রিফিথ’সও। তাই তো ব্র্যান্ডটির কালেকশন ছিল আধুনিকতার পথিকৃৎ, স্থপতি এবং ডিজাইনার ইলিন গ্রের নৈপুণ্যপ্রাণিত। পেনসিল স্কার্ট, ওয়াইড ট্রাউজার আর স্যুটিংয়ের মতো ক্ল্যাসিক পিসগুলো তৈরি করা হয়েছিল লিনো গ্রেজ্জো দিয়ে; যা আদতে বারলেপ বা চটের মতো দেখতে, প্রক্রিয়াবিহীন, ডাই না করা, র-হেমের লিনেন। ডে টু ডে ড্রেসিংয়ের দারুণ সব স্টাইলিং চোখে পড়েছিল সেই সিজনের বটেগা ভেনেটার কালেকশনেও। প্লেইড শার্টিং, রাগবি শার্ট, জিনস আর ডেনিমে স্কার্ট ছাড়াও প্রদর্শিত হয় নরম চামড়ার ওপর অপটিক্যাল ইলিউশনের অত্যাধুনিক সব ফ্যাশন পিস।
ওভারকোট, পেনসিল স্কার্ট, বোলিং ব্যাগ—মিউসিয়া প্রাদা মানেই ক্ল্যাসিক-সদৃশ সব ডিজাইন। স্প্রিং/সামার ২০২৩-এ যেখানে সুস্পষ্ট ছিল দৈনন্দিন জাগতিকতা। প্রতিটি পোশাক ছিল ছলাকলা ছাড়া, অপ্রয়োজনীয় দুর্বোধ্যতাবিহীন। পোশাকগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পরা ছিল; ছিল ভাঁজযুক্ত, কুঁচকানো, কোনোটা আবার রং করা। বাড়তি চাকচিক্য কিংবা এমবেলিশমেন্ট নয়, একেকটি পোশাককে শিল্পে পরিণত করে এটি পরিধানকারীর জীবন, তার মানবতা আর তার জীবিত থাকার সব চিহ্ন—সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল ব্র্যান্ডটি।
প্যালেট ক্লিনজিং দৃষ্টির বিশুদ্ধতা সৃষ্টিতে সহায়ক। সেটা যে রংহীন হতে হবে, তা কিন্তু আবশ্যক নয়। তা-ই করে দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ম্যাক্সিমিলিয়ান ডেভিস, তার সালভাতোর ফেরাগামোর প্রথম শোতে। ব্র্যান্ডটির ঐতিহ্যবাহী শিলুয়েট আর ওল্ড হলিউড ইনফিউজড ইতিহাসের সঙ্গে একীভূত হয়েছিল ডিজাইনারের সিগনেচার শেড—লাল। প্রকাশিত হয়েছিল ব্র্যান্ড ও ডিজাইনার—উভয়েরই ডিজাইন ডিএনএ। শিলুয়েট ড্রিভেন, পিওরিটি- ফোকাসড ডিজাইন। প্যালেট ক্লিনজিংয়ের সূত্র মেনে।
জাহেরা শিরীন
ছবি: ইন্টারনেট