skip to Main Content

ফিচার I আচকান আখ্যান

সেই শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, কুর্তায় কত দিন আর আটকে থাকা! সমসাময়িক ট্রেন্ডে মিলছে পেছন ফিরে তাকানোর আভাস। ঐতিহ্যের বনিয়াদে প্রভাবিত

শুরুর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষদের; বিশেষ করে সমাজের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং রাজপরিবারের সদস্যদের পছন্দের পোশাক ছিল আংরাখা। চওড়া ঘের দেওয়া রাজোচিত এক পোশাক। তবে ব্রিটিশদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এতে লাগে বদলের ছোঁয়া। ভিন্নধর্মী সূচিশৈলী আর ইউরোপিয়ান স্টাইলের সংস্পর্শে নতুন ধরনের টেইলরিং জনপ্রিয় হতে থাকে। ফলাফল—আংরাখার ওয়েস্টার্ন স্টাইলিং। যার দরুন পোশাকের ঝুল কমে সরু হতে শুরু করে, হারিয়ে যায় কোমরের জোড়ার অংশ। সটান সোজা শিলুয়েটে প্রাধান্য পেতে থাকে সামনে পুরোটা খোলা নকশা। ব্যস, আচকানের আবির্ভাব!
ইতিহাসবিদের অনেকের মতে আচকান শব্দটিও আংরাখাপ্রসূত। প্রথম দিককার আচকানগুলো আংরাখার মতোই পাশে বেঁধে নেওয়া হতো। কিন্তু ক্রমেই তাতে পরিবর্তন আসে। যোগ হয় ব্র্যান্ড কলার আর বোতাম। আচকানের ভেতরে বালাবার নামে একটি বাড়তি প্যানেল থাকত, যা বেঁধে নিলে পোশাকের ফাঁক গলে শরীর দেখা যাওয়ার আশঙ্কা এড়ানো যেত যথার্থভাবেই। সঙ্গে পরা হতো পাটকা বা ওয়েস্ট ব্যান্ড। চুড়িদার অথবা পাজামার জোড়েই তৈরি হতো জবর সব লুক।
অনেক ইতিহাসবিদের মত, দিল্লির সালতানাত এবং মোগল সাম্রাজ্যের রাজসভার পারস্য ও তুর্কি বংশোদ্ভূত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের পরতে দেখা যেত আচকান। আঠারো শতকের শেষ কিংবা উনিশ শতকের শুরুর দিককার আগেও ছিল এর প্রচলন। তাদের ভাষ্যে আচকান দুটি ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সংমিশ্রণ। ইন্দো-পারসিয়ান চাপকান এবং চোগার সঙ্গে ব্রিটিশ ফ্রকের ফিউশন। আবার অনেকের কাছেই এটি আংরাখা এবং ইউরোপিয়ান কোটের সংকর। কুর্তা-এ-খাস, ফিরাঙ্গি সুরতুগ, ইউরোপিয়ান স্টাইল কোট—ইতিহাসের পাতায় তাই এর নাম নিয়েও মিলবে বিভিন্নতা। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও রাজবংশীয় প্রভাবের আকর্ষণীয় রূপান্তরের চমৎকার উদাহরণ; যা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আভিজাত্যের অতীত ধারণাকে জিইয়ে রেখেছে আজ অবধি। ইতিহাসের অতশত গলি পেরিয়েও হারায়নি আবেদন।
আচকান কী
লম্বা হাতাওয়ালা, হাঁটু ছোঁয়া সনাতন স্টাইলের আপার ওয়্যার। অনেকটা টেইলরড কোটের মতো এই পোশাকের দুই পাশ ফাড়া আর কলার উঁচু। সামনে খোলা এ পোশাকের গলা থেকে বুক বেয়ে নেমে পেট অব্দি বোতাম দিয়ে আটকে নেওয়া যায়। এই উপমহাদেশের পুরুষদের জন্য আচকানই প্রথম পোশাক, যাতে বোতাম ও বোতামঘর এমন বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকের মনে হতেই পারে, এ তো শেরওয়ানির স্বরূপ। কিন্তু ধারণা মোটেই সঠিক নয়। বেসিক পার্থক্য বিদ্যমান দুইয়ের মধ্যে। প্রথমটা দৈর্ঘ্য।ে শেরওয়ানি লম্বায় আচকানের চেয়ে বড়। শেরওয়ানির ঘের বেশি থাকে; কিন্তু আচকান সে তুলনায় অনেকটা ফিটেড ও টেইলরড, মাসকুলিন লুক তৈরির জন্য। আচকান হালকা এবং ফ্লোয়ি ফ্যাব্রিকে তৈরি করা হয়; কিন্তু শেরওয়ানি বানানোর জন্য একটু ভারী কাপড়ই বেশি পছন্দ। যদিও এখন ব্রোকেড, ভেলভেটের মতো কাপড়েও তৈরি হচ্ছে আচকান। বাদলা ও জারদৌসির মতো অভিজাত এমব্রয়ডারির এমবেলিশমেন্টে। মসলিনের ওপর সূক্ষ্ম চিকনকারী করা কাপড়ে তৈরিগুলোও হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। এগুলো সামার ওয়্যার হিসেবে দারুণ আকর্ষণীয়।
নকশায় স্বাতন্ত্র্য
উঁচু, বন্ধ গলার হয়ে থাকে আচকান। নেকলাইনের নকশায় রাউন্ড বা স্ট্যান্ড-আপ—দুই-ই সই। এর লম্বা সটান সোজা শিলুয়েট পৌঁছে যায় হাঁটু অব্দি। তা থেকে সামান্য নেমে গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু সেটা যেন আবার বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। সিল্ক, ব্রোকেড, ভেলভেটের মতো বিলাসী ফ্যাব্রিকে তৈরি হয় আচকান। উদ্দেশ্য, প্রাচুর্যের পোশাকি উপস্থাপন। এর ওপর করা হয় এলাবোরেট এমব্রয়ডারি, সূক্ষ্ম সূচিকর্ম, জারদৌসি আর স্টোন সেটিংয়ের মতো এমবেলিশমেন্টে।
রূপান্তরণ
গত এক দশকে বদলেছে পুরুষ ফ্যাশনের দৃশ্যপট। সনাতনের সৌন্দর্য আর সমসাময়িক নান্দনিকতার সম্মিলনে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন সব ট্রেন্ড। প্রমাণ—মেনজ এথনিক ওয়্যারের শতকরা ২০ ভাগ এখন ইন্দো-ওয়েস্টার্ন আউটফিটের দখলে। সাম্প্রতিক ট্রেন্ডোমিটার অনুসারে আচকান এখন ইন্দো-ওয়েস্টার্ন স্টাইলের অন্তর্ভুক্ত। পোশাকের আধুনিকায়নের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত এড়িয়ে যাওয়ার উপায় আছে!
ফ্লোরাল
ফুলেল মানেই মেয়েলি—বড্ড সেকেলে সেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসেছেন এখনকার ডিজাইনার। পষ্ট প্রকাশ—পুরুষের পোশাকের জমিনে এখন ফুটছে ফুল; বিশেষ করে এথনিক ওয়্যারে। সলিড রঙের কুর্তা আর চুড়িদার সেটের ওপর একখানা ফ্লোরাল প্রিন্টের আচকান চাপিয়ে স্টেটমেন্ট স্টাইল তৈরি হচ্ছে অহরহ।
অ্যাসিমেটরিক
সিমেট্রি ইজ ওভাররেটেড। তাই অসামঞ্জস্যে বাড়ছে আকর্ষণ। অ্যাসিমেটরিক নকশায় তৈরি ইন্দো-ওয়েস্টার্ন আচকানগুলো পরিধানে তৈরি হচ্ছে পরিশীলিত লুক। অন্যদের থেকে আলাদা দেখাতে ওয়্যারড্রোবে এমন একটা আউটফিটই যথেষ্ট।
এমব্রয়ডারড
বিশেষ উদ্‌যাপনের জন্য আচকান চাই? সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারড অপশনগুলো এ ক্ষেত্রে থাকতে হবে সবার আগে। থ্রেডওয়ার্ক, জরিওয়ার্ক, সেলফ ডিজাইন থাকতে পারে তালিকায়।
জ্যাকার্ড
সূক্ষ্ম জ্যাকার্ড বুননের ফ্যাব্রিক আচকানকে নিমেষে করে তুলতে পারে অভিজাত। যেকোনো আয়োজনে সবার নজরে পড়তে চাইলে অনায়াসে বেছে নেওয়া যায়।
ডাবল ফ্ল্যাপ
ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ধাঁচের আচকানগুলোতে এই সামান্য কাস্টমাইজেশন ডিজাইনারদের খুব পছন্দ। বুকের ওপর ডাবল ফ্ল্যাপ ক্লোজার দেওয়া এই পিসগুলো যেন পুরোনো নকশায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে, দেয় মডার্ন টাচ।
জোড়ে জবর
আচকানের নিচে সামান্য লম্বা কুর্তা দিয়ে লেয়ার করে নেওয়া যায়, না করলেও ক্ষতি নেই। বটমের বিকল্প রয়েছে মেলা। চুড়িদার, ধুতি থেকে পেশওয়ারি—চলবে সবই। বিশেষ আয়োজনে অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ করা যেতে পারে নেকপিস, ব্রেসলেট আর আংটি। তবে পকেট স্কয়ার মাস্ট। ম্যাচিং কিংবা কনট্রাস্ট কালারের। পায়ে মোজরি, মিউল অথবা জুত্তি। ব্যস, শাহি সাজ তৈরি।
 জাহেরা শিরীন
মডেল: জারিফ ও তমাল
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ওয়্যারড্রোব: ওটু
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top