ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I পাক সার জামিন
পুরোটাই কি জনপ্রিয় সব পাকিস্তানি ড্রামার বদৌলতে? নাকি প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক সময়ের সোশিও-পলিটিক্যাল পটপরিবর্তনের বদলতি তাসবিরের বনিয়াদে? শুল্ক নিয়ন্ত্রণের বদলে যাওয়া নিয়মটা আবার কারণ নয়তো! বাকিটা জাহেরা শিরীনের জবানিতে
পাখি ড্রেস থেকে পুষ্পা-২ শাড়ি। এই তো গেল বছরের গল্প। বাংলাদেশের ঈদবাজারের একটা বড় অংশজুড়ে ভারতীয় ফ্যাশন ট্রেন্ডের পষ্টতা। বলিউড স্টার থেকে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি আর ইনফ্লুয়েন্সারদের সাজে নিজেকে সাজাবার সাধেরই প্রতিফলন শপিং মলের মেনিকিন আর সারি সারি হ্যাঙ্গারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বাজার দখলের পষ্ট পয়গাম দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশের, পাকিস্তানের।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাস মোটেই ইতিবাচক নয়। তিক্ত সত্য; কিন্তু এটাই বাস্তবতা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রেক্ষাপট কেমন যেন বদলে গেছে! নানান নেতিবাচকতার ভিড়ে পাকিস্তানি ফ্যাশন, মিউজিক, কবিতা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ডের মতো সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে একধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে; বিশেষ করে তরুণদের মাঝে। যা দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংযোগের প্রতিফলন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
দ্য পাকিস্তানি প্রেজেন্স
এমন পাকিস্তানপ্রীতির পেছনে মূল চালিকাগুলো আসলে কী? খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নাটকগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা; যা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান যুগ-পুরোনো ঐতিহাসিক চাপা উত্তেজনার মাঝেও সাংস্কৃতিক ব্যবধান দূর করতে সাহায্য করছে। প্রায় কাছাকাছি মূল্যবোধ, চিত্তাকর্ষক স্টোরিলাইন আর ইন্টারনেটের বদৌলতে সহজলভ্য হওয়ায় পাকিস্তানি নাটকগুলো বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করে নিচ্ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। হামসাফার, জিন্দেগি গুলজার হে, ইয়াকিন কা সাফার এর মধ্যে অন্যতম। প্রেম, পরিবার আর সামাজিক নানা সমস্যা তুলে ধরা হয় এগুলোতে। শেষ করে দেওয়া হয় ২০-৩০ পর্বে; ভারতীয় ড্রামার মতো বছরের পর বছর টানা হয় না। এটাও জনপ্রিয়তার আরেক কারণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাটকগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাকিস্তানি পোশাকপ্রীতি। চরিত্রগুলোর পরনের পোশাক প্রভাবিত করছে সাধারণ ফ্যাশনপ্রেমীদের ফ্যাশন ভাবনাকে।
সুস্পষ্টভাবেই পাল্টাচ্ছে পোশাকের ট্রেন্ড। পাল্টে যাচ্ছে শিলুয়েট, ফ্যাব্রিক, এমব্রয়ডারি টেকনিক। লম্বা, সটান সোজা কুর্তার কাটতি যেন বেড়েই চলছে দিন দিন। লম্বা হাতা, ঢিলেঢালা সালোয়ার-কামিজ, সঙ্গে স্টাইলিশ দোপাট্টার কম্বিনেশন এখন হিট। পাকিস্তানি নাটকের অভিনেত্রী মাহিরা খান আর সাজাল আলির বরাতে প্যাস্টেল শেডের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে ক্রেতাদের, এমনকি ডিজাইনারদেরও। জমিনজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সূক্ষ্ম সুচের ফোঁড়, মিরর ওয়ার্ক আর মিনিমালিস্টিক এমব্রয়ডারি। গ্রেসফুল মডেস্ট ক্লদিংয়ের কদর বেড়েছে। বিয়েতে বেড়েছে লেহেঙ্গা, আনারকলি আর ভারী এমব্রয়ডারড ড্রেসের চাহিদা। ট্রেন্ডগুলোর পুরোটাই পাকিস্তানপ্রাণিত। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে হাই কোয়ালিটি লন স্যুট। পরতে আরামদায়ক; দেখায় উৎসবসম্মত। ব্রিদেবল কাপড়ে তৈরি; কিন্তু একদমই সি-থ্রু নয় বলে বাংলাদেশি আবহাওয়ার জন্য পারফেক্ট এই কুর্তা আর বটমের ডুয়ো। সঙ্গে থাকে দোপাট্টা। আনস্টিচড পিসগুলোতে সেটের সঙ্গে থাকে নানা ডিজাইনের লেস ট্রিমিং, অর্নামেন্টেশনের জন্য। প্রতিদিন পরা যায়, এমনকি প্রফেশনাল সেটিংয়ে মানানসই স্মার্ট ক্যাজুয়াল হিসেবেও।
ভারত বাস্তবতা
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও। ভিসা রদ, এলসি তৈরিতে ঝুটঝামেলা ইত্যাদি কারণে ভারতীয় পোশাকের সহজলভ্যতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে নানাভাবে। অন্যদিকে কাস্টম রেগুলেশনের সাম্প্রতিক পরিবর্তন পাল্টে দিয়েছে পরিস্থিতি। অক্টোবর ২০২৪-এ পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর থেকে শতভাগ ফিজিক্যাল ইন্সপেকশনের বাধ্যতামূলক নিয়ম রদ করে দেয় এনবিআর। যার মূল লক্ষ্য শুল্ক ছাড়পত্র ত্বরান্বিত করা এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের কার্যকারিতার উন্নতি সাধন। এর আগে পাকিস্তান থেকে আসা সব পণ্যের ম্যানুয়াল ইন্সপেকশন হতো ন্যাশনাল সিলেকটিভলি ক্রাইটেরিয়ার তত্ত্বাবধায়নে। এটি তুলে দেওয়ার ফলে পুরো প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন সম্ভব হয় এবং রপ্তানি খরচ কমে যায়। ফলে বাংলাদেশি আমদানিকারক ও ক্রেতারা ভারতের বদলে পাকিস্তানি পোশাকেই এখন আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছেন।
এর চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, খোদ ভারতই ভুগছে পাকিস্তানি পোশাক-জ্বরে। সেলিব্রিটিদের সাম্প্রতিক আউটফিট সিলেকশনে তো সেটা সুস্পষ্ট। যেমন হালের হার্টথ্রব তৃপ্তি দিমরিকে তার সিনেমার প্রচারের সময় দেখা গেছে গারা এমব্রয়ডারি করা বেল্টেড এমবেলিশড লেহেঙ্গা পরনে। পোশাকটির ডিজাইনার? করাচি বেসড ইকবাল হোসেন। এই ডিজাইনারের বরাতে রিল্যাক্সড টেইলারিংয়ের ট্রেন্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতজুড়ে। খাটো কুর্তার সঙ্গে কখনো পেনসিল প্যান্ট তো কখনো চওড়া হেমের সালোয়ারকেও করেছেন ট্রেন্ডের শামিল। টিউলিপ স্টাইল সালোয়ার, সূক্ষ্ম এমব্র্রয়ডারির পাশাপাশি লন (কম্বড কটন) এবং র সিল্কের ব্যবহারও বেড়েছে তার হাত ধরে। যার প্রতিটিই ‘মেইড ইন পাকিস্তান’-এর রিপ্রেজেন্টেশন।
সম্প্রতি মুম্বাইতে একটি মাল্টি ডিজাইনার রিটেইল স্টোরে স্টকিংয়ের কাজ শুরু করেছেন এই পাকিস্তানি ডিজাইনার। জটিল সোশিও-পলিটিক্যাল সম্পর্কে তো বহু যুগের। তার ওপর ভারত ২০০ শতাংশ কর বসিয়েছে পাকিস্তান থেকে আমদানি কিংবা ভারত থেকে রপ্তানি করা যেকোনো পণ্যে। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও ভারতের বাজারে পাকিস্তানি ডিজাইনারদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আর চাহিদা চমকে দেওয়ার মতোই। বিশেষজ্ঞদের মত, ক্রস কালচার ইনস্টাগ্রাম এক্সচেঞ্জের ফল এটি। তাই তো সোনম কাপুরকে বিজয়া দশমীতে দেখা গেছে লাহোর বেসড ডিজাইনার জারা শাহজাহানের প্রিন্টেড আনারকলি পরনে। আর সারাহ আলি খান ম্যাগাজিন কাভারে উপস্থিত হয়েছেন ইকবাল হোসেনের পোশাকে। তবে তারকাদের বহু আগে থেকে পাকিস্তানি কাট আর শিলুয়েটের পোশাক পরে অভ্যস্ত ক্রেতারা। ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অনেকে ২০১৩ থেকে নানা ধরনের এক্সিবিশনের আয়োজন করতেন। যেখানে পাকিস্তানি ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজারদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। সানিয়া মাসকাটিয়া, নিদা আজওয়ের, জারা শাহজাহান আর ফারাজ মানানের মতো ডিজাইনাররা অংশ নিতেন সেগুলোতে। এ ছাড়া ভারতের অনেক অনলাইন রিটেইলার আর ফিজিক্যাল স্টোরেও বছরের পর বছর দেদার বিকিয়েছে পাকিস্তানি পোশাক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভারতের ফ্যাশন-সচেতনদের মাঝে পাকিস্তানের পোশাকের এমন ঝোঁক বাংলাদেশি ক্রেতাদের ক্রয়ভাবনাকে প্রভাবিত করছে।
ছবি: ইন্টারনেট