ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I সিলভার জুবিলি সেলিব্রেশন
পঁচিশে পদার্পণ উদ্যাপিত হলো সম্প্রতি। সাড়ম্বরে। কিন্তু ফেলে আসা আড়াই দশকে ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আইকনিক হয়ে ওঠার অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলো কেমন ছিল। জানার ইচ্ছা জাগে বৈকি
মাইলফলকই বটে। পঁচিশ বছর ধরে ইন্ডিয়ান ফ্যাশনকে তিলে তিলে রূপায়ণের গল্প। সেই মুম্বাইয়ের দ্য তাজমহল প্যালেসের শুরুর দিনগুলো থেকে সম্প্রতি জিও ওয়ার্ল্ড কনভেনশন সেন্টারে শোকেস—যাত্রার পুরোটা বিবর্তনের কম কিছু নয়। কখনো সৃজনশীলতার রণক্ষেত্র তো কখনো উদীয়মান প্রতিভার সূচনাস্থল ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চ। এমন এক প্রদর্শনস্থল; যেখানে বলিউড, ব্যবসা আর কতুর মিলিত হয় সবচেয়ে নাটকীয় উপায়ে। এত বছর পরেও ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শো হিসেবে বিবেচিত ল্যাকমে ফ্যাশন উইক প্রতি সিজনেই প্রথাকে উপেক্ষা করে, নতুন ট্রেন্ড স্থাপন করে।
‘জেননেক্সট’ প্রোগ্রামের যুগান্তকারী সূচনা থেকে বলিউড শোস্টপারদের রানওয়েতে হাঁটানোর সূত্রপাত—এলএফডব্লিউ বরাবরই ফ্যাশনকে উপস্থাপনের ছক বাঁধা নিয়মগুলোকে ভেঙেচুরে নতুন করে পেশ করেছে। শুধু কি তাই, ভারতের প্রথম প্লাস-সাইজ মডেল হান্টের মাধ্যমে উসকে দিয়েছে ইনক্লুসিভিটিকে। ক্যারল গ্রেসিয়াস আর কারিনা কাপুরের ম্যাটারনিটি ওয়াক মোমেন্টের মাধ্যমে ভেঙেছে ট্যাবু। ভারতীয় ডিজাইনারদের পৌঁছে দিয়েছে বিশ্ব ফ্যাশন দরবারে। ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের ২৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনে এমন ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের দিকে ফিরে তাকানো যায়, যা ভারতীয় ফ্যাশনের কাঠামোকে নতুন রূপ দিয়েছে। ল্যাকমে ফ্যাশন উইককে পরিণত করে তুলেছে আ পিওর রানওয়ে ম্যানিয়াতে।
উদ্বোধনী উচ্ছ্বাসে (১৯৯৯)
ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের প্রথম সংস্করণ। আয়োজিত হয়েছিল দিল্লিতে। যাতে অংশ নিয়েছিলেন সমগ্র ভারত থেকে আসা ৩৩ জন ডিজাইনার। উপস্থাপন করেছিলেন তাদের প্রেট কালেকশন। দ্য তাজ প্যালেস কনভেনশন সেন্টারে সাত দিনব্যাপী চলা এই মহাযজ্ঞে শো হয় মোট ২৭টি। উদ্যমে অপরিপক্ব হলেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সাত আসমান ছোঁয়া। এর মাধ্যমেই ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি খুঁজে পায় তাদের প্রথম পাকাপোক্ত প্ল্যাটফর্ম।
মনীশ মালহোত্রার বলিউড রেভল্যুশন (২০০০)
ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ডিজাইনারের হাত ধরেই ভারতের ফ্যাশন শোর মঞ্চে সেলিব্রিটি শোস্টপারের ধারণাটি প্রথম বাস্তব রূপ পায় এবং দারুণ সমাদৃত হয়। ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে শাহরুখ খান আর কারিনা কাপুরকে হাঁটিয়ে সবাইকে চমকে দেন এই ডিজাইনার। এমন একটি ট্রেন্ডের সূচনা ঘটে, যা বহাল তবিয়তে চলে আসছে আজ অব্দি।
জেননেক্সট ডিজাইনারদের উত্থান (২০০০)
‘জেনারেশন নেক্সট’ প্রোগ্রামটি উদীয়মান ডিজাইনারদের জন্য একটি লঞ্চপ্যাড হিসেবে চালু করা হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে এর মাধ্যমে ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি খুঁজে পায় এমন সব ডিজাইনার, যারা এরপর দেশ তো বটেই, দেশের বাইরেও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মাসাবা গুপ্তা, রাহুল মিশরা, নচিকেত বারভে আর অনীথ অরোরার মতো প্রতিভারা এই উদ্যোগের মাধ্যমে পা রাখেন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। আজ অব্দি ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এলএফডব্লিউর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মধ্যে একটি এটি। যা এখনো ইন্ডিয়ান ডিজাইনের ভবিষ্যৎকে ক্রমাগত রূপ দিয়ে যাচ্ছে।
সব্যসাচীর কাশগার বাজার (২০০২)
প্রতিভাবান এক ডিজাইনারের পথচলার শুরু। সব্যসাচী মুখার্জির প্রথম আত্মপ্রকাশে গ্লেম চেঞ্জিংয়ে কালেকশনটি ঔপনিবেশিক কলকাতার রোমান্সকে বোহিমিয়ান স্ট্রিট স্টাইলের সঙ্গে মিশিয়ে দর্শকদের যেন নিয়ে গিয়েছিল পুরোনো স্মৃতির জগতে।
ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ডে (২০০৯)
ভারতের ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইলগুলো উদ্যাপনের জন্য আয়োজিত। এখন ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে’ ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে রূপান্তরিত হয়েছে; যা ফ্যাশনের সঙ্গে সচেতন পছন্দের সামগ্রিক মিশন ঘটায় প্রতিবছর।
চ্যারিটির জন্য নাওমি ক্যাম্পবেল (২০০৯)
মহারাষ্ট্রের বন্যায় ত্রাণ সংগ্রহের জন্য ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে হাঁটেন এই সুপারমডেল। নিজের তারকা শক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর মঞ্চে আলোকিত করেন এই শোর প্রাসঙ্গিকতা।
সেভ আওয়ার টাইগারস ইনিশিয়েটিভ (২০১৩)
প্রথমবারের মতো অ্যাকটিভিজম প্রদর্শনের মঞ্চতে পরিণত হয় এলএফডব্লিউ। ৪০ জন ডিজাইনার একত্র হয়ে বাঘ সংরক্ষণের পক্ষে অভিনব এক কালেকশন মঞ্চে উপস্থাপন করেন।
কারিনার ম্যাটারনিটি ওয়াক (২০১৬)
রিহানারও বহু আগে প্রেগন্যান্সি ফ্যাশনকে ফ্যাশন মোমেন্টে পরিণত করেন কারিনা কাপুর খান। প্রেগনেন্ট অবস্থায় সব্যসাচীর তৈরি এমব্রয়ডারড লেহেঙ্গা পরে হাঁটেন এলএফডব্লিউর মঞ্চে।
ভারতের প্রথম প্লাস সাইজ শো (২০১৬)
লিটল শিল্পার ডিজাইনার শিল্পা চবনের আয়োজনে। ট্র্যাডিশনাল বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি মূলধারার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে উপেক্ষিত বডি টাইপগুলোকে উপস্থাপনের মাধ্যমে তৈরি হয় ইনক্লুসিভিটির যাত্রা।
ক্যারল গ্লেসিয়াসের বেবি বাম্প মোমেন্ট (২০১৬)
প্রেগনেন্ট অবস্থায় ডিজাইনার গৌরাঙ্গ শাহের জন্য হেঁটে হেডলাইনে পরিণত হন এই সুপারমডেল। তার এমন উপস্থাপন ইনক্লুসিভিটি এবং বডি পজিটিভিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
ট্রান্সজেন্ডার রিপ্রেজেন্টেশন (২০১৭)
নেপালি মডেল অঞ্জলি লামা প্রথম ট্রান্সজেন্ডার মডেল হিসেবে এলএফডব্লিউ রানওয়েতে হেঁটে ইতিহাস তৈরি করেন। তার উপস্থিতি ভারতীয় ফ্যাশনে বৈচিত্র্য এবং প্রতিনিধিত্বের একটি শক্তিশালী মুহূর্ত তৈরি করে, যা পরে বৃহত্তর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
প্রথম ক্রুজ শো (২০১৭)
মনীষা জয়সিংয়ের এই লাক্সারি ক্রুজ লাইন কালেকশনের পুরো উপস্থাপনা ছিল দর্শকদের জন্য এক অভিনব অভিজ্ঞতা।
শেডস অব ইন্ডিয়া x ক্রান্তি (২০১৭)
ফ্যাশনকে সামাজিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে একীভূত করার কাজ করে দেখিয়েছে এলএফডব্লিউ ২০১৭ এর এই শো দিয়ে। এনজিও ক্রান্তির সঙ্গে অংশীদারিতে করা এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল মুম্বাইয়ের রেড লাইট এরিয়ার নারীদের ক্ষমতায়ন। শোতে প্রফেশনাল মডেলদের বদলে র্যাম্পে হাঁটতে দেখা গিয়েছিল সেসব নারীকে, যারা ফ্যাশনের মাধ্যমে তাদের গল্প সবার সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন।
পদ্মলক্ষ্মীর চোখধাঁধানো শো (২০১৭)
সে বছর এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান সুপারমডেল এবং টিভি হোস্ট ডিজাইনার তরুণ তাহলিয়ানির জন্য র্যাম্পে হাঁটেন; দর্শকদের হতবাক করে। একটি হাইব্রিড স্টাইলের শাড়ি গাউন পরিহিত অবস্থায় দেখা যায় তাকে। আত্মবিশ্বাস, সৌন্দর্য আর শক্তির বহিঃপ্রকাশ ছিল সেই লুকে, যা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয় যে কেন তিনি একজন ফ্যাশন আইকন।
সুস্মিতা সেনের কামব্যাক ওয়াক (২০১৮)
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জটিলতার কারণে একটা বড় বিরতির পর এই সাবেক মিস ইউনিভার্স ফ্যাশনের মঞ্চে ফিরে আসেন, তার কালজয়ী গ্ল্যামার নিয়ে। হাঁটেন ডিজাইনার সুনীতা শঙ্করের পোশাকে। পান স্ট্যান্ডিং ওভেশন। তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত ছিল এটি।
সিয়ার্ক ডিউ সোলে অ্যাট এলএফডব্লিউ (২০১৮)
ফ্যাশন মিট পারফরম্যান্স—এমনই এক অভিনব মুহূর্ত তৈরি করে দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ এর গ্র্যান্ড ফিনালে শোতে।
বলিউড ডিভা টাবুর প্রত্যাবর্তন (২০১৯)
রানওয়ে থেকে বহু বছর দূরে থাকার পর টাবুকে দেখা যায় ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে। করণ জোহরের সঙ্গে তিনি হাঁটেন ডিজাইনার গৌরব গুপ্তার স্প্রিং সামার ২০১৯ কালেকশনের পোশাক পরে।
প্রথম ডিজিটাল এডিশন (২০২০)
করোনা প্যানডেমিক এলএফডব্লিউকে বাধ্য করে নতুন উদ্ভাবনে। ফলাফল—ডিজিটাল ফরমেট; যা ভারতীয় ফ্যাশন উপস্থাপনের ধারায় বিপ্লব এনে দিয়েছিল।
এফডিসিআই এবং ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের ঐতিহাসিক সম্মিলন (২০২১)
ভারতের দুটি বৃহত্তম ফ্যাশন সংস্থার এই পার্টনারশিপ ছিল এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। ফলাফলে সেবার আয়োজিত ফ্যাশন উইকটিও অন্যবারের থেকে আলাদা; যা ইন্ডিয়ান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কোলাবোরেশনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। দুটো প্ল্যাটফর্মের সেরাদের নিয়ে আসে একত্রে।
গৌরব গুপ্তার গ্লোবাল ব্রেকথ্রু (২০২২)
তার তৈরি স্কাল্পচারাল কতুর আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মনোযোগ আকর্ষণ করে। পরে গৌরব অংশ নেওয়ার সুযোগ পান প্যারিস ওত কতুর উইকে। ডিজাইন করেন বিয়ন্সের পোশাক।
জিনাত আমানের ইলেকট্রিফায়িং ওয়াক (২০২৩)
বয়স ৭১ বছর। কিন্তু সে যে শুধু একটি সংখ্যা, তা-ই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন এই প্রথিতযশা অভিনেত্রী। ডিজাইনার শাহিন মান্নানের তৈরি বোল্ড রেড প্যান্ট স্যুট পরে মঞ্চে হেঁটে তিনি আরও বুঝিয়ে দেন, স্টাইলের ক্ষেত্রে বয়স মোটেই কোনো সীমাবদ্ধতা নয়।
পেরো x হ্যালো কিটি কোলাবোরেশন (২০২৪)
একদমই অপ্রত্যাশিত কিন্তু দারুণ ছিল এই ক্রসওভার। ডিজাইনার অনীথ অরোরার পেরো কোলাবোরেট করে হ্যালো কিটির সঙ্গে, ২০২৪ ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের এক অভূতপূর্ব কালেকশন তৈরিতে। সমসাময়িক ফ্যাশনের সঙ্গে স্মৃতির মিশেলে তৈরি পুরো সংগ্রহে প্রাধান্য পায় চোখধাঁধানো সব রং, মজার সব মোটিফ এবং অনায়াস তারুণ্যোচ্ছলতা।
আব্রাহাম অ্যান্ড ঠাকুরের আপসাইকেলড কতুর (২০২৪)
টফি র্যাপার, ক্যাসেট টেপ, বিন ব্যাগ, কিচেন ফয়েল আর চালের বস্তা থেকে সিকুইন, রিবন আর স্কয়ার তৈরির এমন প্রক্রিয়া এর আগে দেখেনি ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু যেখানে সাসটেইনেবিলিটিই মূল লক্ষ্য, সেখানে এমন অভিনব উপাদানের ব্যবহার হওয়াই তো স্বাভাবিক। আর সেটাই করে দেখিয়েছেন এই ডিজাইনার ডুয়ো। পুরো কালেকশন তৈরি হয়েছিল আপসাইকেলড ম্যাটেরিয়াল থেকে। হাই ফ্যাশন প্রতিটি পিস লাক্সারি এবং ওয়েস্টের মেলবন্ধনে এমন বোল্ড স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিল, যা দেখে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল ফ্যাশনবোদ্ধাদেরও।
রোহিত বালের ফিরে আসা
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যায় দীর্ঘদিন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বাইরে ছিলেন বিখ্যাত এই ডিজাইনার। কিন্তু আবার ফিরে আসেন এলএফডব্লিউর ২০২৪ এর আসরে। কালেকশন ‘কায়েনাত’ নিয়ে। পুরোটাই ছিল ভারতীয় ঐতিহ্য নিদর্শনস্বরূপ। নকশায় প্রাধান্য পায় সূক্ষ্ম সূচিকর্ম আর কাশ্মীরের প্রভাব।
ওটিটি নিয়ে তরুণ তাহলিয়ানি (২০২৪)
বিলাসী ব্রাইডাল পোশাকের জন্য দারুণ জনপ্রিয় এই ডিজাইনার। একদমই নিজস্ব ধারার বাইরে গিয়ে সাহসী এই পদক্ষেপ নেন। বাজারে আসে তার অভিজাত প্রেট কালেকশন ‘ওটিটি’। ঐতিহ্য আর সমসাময়িক নকশার সাহসী সংমিশ্রণে তৈরি কালেকশনের প্রতিটি পোশাক প্রমাণ করে দেয়, রেডি-টু-ওয়্যারও এমন অভিনব হতে পারে।
জাহেরা শিরীন
ছবি: ইন্টারনেট
