ফিচার I খুসসার কিসসা
হারিয়ে যাওয়া অভিজাতদের জুতা ফিরে এলো নতুন করে। উৎসবের জন্য
রাজা-বাদশাহ, সুলতানেরা নেই, বহু বছর হলো। কিন্তু তাদের আভিজাত্যের ছাপ রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মনের জমিনে থেকে গেছে সুলতানি ঠাটের কিছু বীজ, যেগুলোয় একটি নমুনা খুসসা নামক জুতা।
খুসসা বা জুতি মূলত উত্তর ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনপ্রিয় জুতা, যা সাধারণত চামড়া দিয়ে তৈরি হয় এবং এতে সূক্ষ্ম কারুকাজ থাকে। একসময় এগুলোতে সোনা ও রুপার সুতা ব্যবহার করা হতো। এখন রাবারের তলি ব্যবহৃত হয়। পাঞ্জাবি জুতি ছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন প্রকার জুতি পাওয়া যায়। অমৃতসর ও পাটিয়ালা হস্তনির্মিত জুতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র, দুটি স্থান থেকেই বিশ্বজুড়ে পাঞ্জাবি প্রবাসীদের জন্য এই পাদুকা রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এরা ঘনিষ্ঠভাবে মোজারির সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভিন্ন স্থানীয় নকশার বৈচিত্র্য এর বিবর্তনের ধারাকে প্রলম্বিত করছে, যা অনেকাংশেই স্বতন্ত্র মুচির ওপর নির্ভর করে। এগুলোর তলি সমতল হয় এবং এতে কোনো বাম বা ডান পায়ের প্রকারভেদ থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো পায়ের আকৃতি নিতে শুরু করে। খুসসার গড়ন নারী ও পুরুষভেদে আলাদা। পুরুষদের এই জুতিতে সামনের দিকে একটি বাঁকা অংশ থাকে, আর নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় গোড়ালির কাছটা উন্মুক্ত থাকে। আনুষ্ঠানিক পোশাকের অংশ হিসেবে, প্রধানত বিবাহের অনুষ্ঠানে জুতি এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অনলংকৃত জুতি পাঞ্জাবের অধিকাংশ জায়গায় পুরুষ ও মহিলাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক পাঞ্জাবি পল্লিগীতিতে জুতির উল্লেখ আছে।
ভারতে, বিশেষত পাঞ্জাবে এ ধরনের জুতা বিত্তশালী জমিদার, নবাব, জায়গিরদার, মহারাজা ও মহারানিদের পরিধানসামগ্রী হিসেবে দেখা হতো। মোগল অনুপ্রাণিত বিভিন্ন নকশার ব্যবহার এতে দেখা যায়। এই জুতি উত্তর ভারতে, বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জুতা হিসেবে জুতি অত্যন্ত জনপ্রিয়। কুর্তা পাজামা বা শেরওয়ানির সঙ্গে হাতে তৈরি এই জুতির ব্যবহার বিশেষভাবে প্রচলিত।
খুসসা বা জুতি ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে সাধারণভাবে মোজারি হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানে এর একটি বিকল্প নাম হলো খুসসা, যা এখন পাশ্চাত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর মধ্যে বিশেষ একধরনের জুতি রয়েছে। আকারে লম্বা এবং সামনের দিকের অংশটি শুঁড়ের মতো বাঁকা। জুতির নকশা এক প্রজন্মের থেকে অন্য প্রজন্মে কিছু রূপান্তরের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। সাধারণত মসৃণ চামড়া দিয়ে তৈরি হয় এবং এতে সুতা অথবা পুঁতির কাজ থাকে। এই জুতা পায়ে গলিয়ে পরতে হয়। পায়ের পেছনে অ্যাকিলিস টেন্ডনের কাছে এটি একটু উঠে থাকে। সামনের দিকে পায়ের আঙুলগুলো ঢাকা থাকে এবং গোলাকার হয়। উপরের দিকে প্রচুর কারুকাজ থাকে, কিন্তু পায়ের পাতার উপরের অংশ প্রায় উন্মুক্ত। কিছু কিছু জুতি সম্পূর্ণভাবে হাতে তৈরি হয় এবং সূচিকর্মের নকশায় সুসজ্জিত থাকে।
বিভিন্ন উৎসবে চুড়িদার পাজামা লন প্রিন্ট অথবা ফেন্সি শিফন সালোয়ার কামিজের সঙ্গে গ্লিটারড বা পুঁতি-স্টোনবিশিষ্ট এক জোড়া খুসসা অনায়াসে মানিয়ে যায়। পাজামার সঙ্গে ফ্রক স্টাইলের কামিজ, কুর্তা কিংবা লং কুঁচিওয়ালা ফ্রক পরলে জুতি বা খুসসা সাজসজ্জায় নতুন মাত্রা এনে দেয়। বিয়েতে কনের পোশাক হিসেবে ভেলভেট লেহেঙ্গা চোলি অথবা সিল্ক লেহেঙ্গা চোলি- যা-ই পরা হোক না কেন, খুসসার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। বরের সাজসজ্জা কুর্তা পাজামা বা শেরওয়ানির সঙ্গে জুতি বা খুসসার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। তবে সাধারণত বর ও কনের জুতি বা খুসসার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল রঙকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
আমাদের দেশে জুতি বা খুসসার ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে, ঢাকায় যেসব ব্র্যান্ডের জুতি বা খুসসার কদর বেশি; মনরো, নওয়া এবং নিডল বি সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
২০১৭ সালের এপ্রিলে মনরোর যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা দুজন। বাদরিয়া আনিস ও সাহার রাহমান। প্রথমজন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বিশেষজ্ঞ বিধায় তিনি নিজ কারখানায় জুতা উৎপাদন করে থাকেন। অপর প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ডিজাইনার। মূলত পোশাক ও জুতা ডিজাইন করেন। সাহার রাহমান খুসসা বা জুতির উপরিভাগ ডিজাইন ও তৈরি করেন এবং বাদরিয়া আনিস স্থানীয় শিল্পীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেন। তারা বলেন, যেহেতু এটি অনলাইন ব্র্যান্ড, তাই বেশির ভাগ অর্ডার সেভাবেই নেয়া হয়। তবে, বর্তমানে গুলশান ১-এ আমাদের দোকান রয়েছে। তাই দোকানে গিয়ে কিংবা অনলাইন- দুভাবেই অর্ডার নেয়া হচ্ছে। আমরা ডেলিভারির জন্য সাধারণত ১০-১৪ দিন সময় নিয়ে থাকি। বাংলাদেশে খুসসা বা জুতি উৎপাদনকারী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে মনরো প্রথম, যেখানে খুসসা স্থানীয় শিল্পীদের মাধ্যমে নিজস্ব ডিজাইনে বাংলাদেশে তৈরি হয়। আমরা খুবই গর্বিত। আমাদের পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে, ১ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ডিজাইনের ধরন অনুযায়ী খুসসা বা জুতির মূল্য সাধারণত ২,৬০০-৪,৯০০ টাকা হয়ে থাকে। শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি জুতি বা খুসসা উৎপাদন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
খুসসার জন্য আজকাল অনেকে নওয়াকে পছন্দের ব্র্যান্ড হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এর মার্কেটিং কনসালট্যান্ট সানিতা আহমেদ বলেন, ‘আমরা মূলত বিভিন্ন ধরনের পাঞ্জাবি এবং ওয়েস্টার্ন পোশাক বিক্রি করে থাকি। গত বছর থেকে খুসসার ট্রেন্ড খুব এসেছে, তাই আমরা খুসসা বিক্রি শুরু করি। আমাদের ইনহাউজ প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট টিম রয়েছে। এখানে নতুন ট্রেন্ড ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে রিসার্চ করা হয়। ফলে, জুতি বা খুসসা আমরা পুরোপুরিভাবে ইনহাউজ ডিজাইন করে নিজস্ব প্রোডাকশনে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রোডাক্ট ডেলিভারির জন্য অনলাইন অপশনটি রাখছি না, কাস্টমাররা খুসসা কেনার জন্য আমাদের দোকানে গিয়ে থাকেন।’ বর্তমানে নওয়ার ৪টি আউটলেট রয়েছে- ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী ও বেইলি রোডে। তিনি বলেন, সাধারণত কোনো ডিজাইনের জুতি আমরা ১৫-২০ জোড়ার বেশি তৈরি করি না। এক্সক্লুসিভিটি মেইনটেইন করার জন্যই। তাই কাস্টমাররা সময়মতো আমাদের স্টোরে না গেলে নতুন কালেকশন না-ও পেতে পারেন। এর মূল্য সাধারণত ২,২৯৫ থেকে শুরু করে ৩,৮৯৫ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এখানে শুধু ক্যাজুয়াল ফুটওয়্যার হিসেবেই নয়, পার্টিওয়্যারের কথা ভেবে অর্নামেন্টেড ডিজাইনে খুসসা তৈরি করা হয়। কিছু জুতিতে হাতের সূক্ষ্ম কাজও রয়েছে।
নিডল বি খুসসা বিক্রয়ে সফল একটি ব্র্যান্ড। এর স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার ফাতিমা নাদিয়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে আমি খুসসা ডিজাইন এবং বিক্রি শুরু করেছি। মূলত আমার তৈরি ডিজাইনগুলো বাইরে পাঠাই এবং প্রোডাক্টটি রেডি হয়ে এলে আমি তা বিক্রি করে থাকি। ডিজাইন ও কোয়ালিটির ওপর এর মূল্য নির্ভর করে। খুসসা কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- ফ্লোরাল, সিম্পল ও গর্জাস কাজ করা। সিম্পল ডিজাইনের খুসসা বিক্রি হয় সাধারণত ১,৫০০-২,৫০০ টাকা এবং গর্জাস ২,৫০০-৩,০০০ টাকায়। গুলশান ১-এ নিডল বি-এর স্টোর রয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতার পায়ের সাইজ নিয়ে কনফিউশন থাকলে স্টোরে গিয়ে কেনাই ভালো। অনলাইনে সহজে অর্ডার করা যায় বলে অনেকে অনলাইনেই কিনছেন। খুসসার বিশেষত্ব হলো এটি ব্যবহারে পায়ে কোনো ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তিবোধ হয় না। ফাতিমা নাদিয়া বলেন, খুসসা নিয়ে আমার কাজের শুরুর উদ্দেশ্য এটাই ছিল- খুসসা কিনতে মানুষকে যেন সারা বছর ধরে বাণিজ্য মেলার জন্য অপেক্ষা করতে না হয়।
খুসসা বা জুতির ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। তবে এ যুগে নতুন করে এর ব্যবহার যেন অতীতকে নতুন করে পাওয়ার সুযোগ। তাই আজকাল ট্রেন্ডি পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পছন্দসই খুসসা না হলে অনেকের চলেই না।
I সৌরীন রহমান
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন