ফিচার I রমজানের কলকাতা
ঈদকে কেন্দ্র করে জন-উন্মাদনার ছবি সম্প্রীতির বার্তাই দেয়। কলকাতার কসমোপলিটন বাজারজুড়ে। লিখেছেন অতনু সিংহ
‘বাজারিরা বাজার করে গুরু/ কত রঙ্গের বাত্তি জ্বলে/ দোকানের ভিড়ে’
ঈদ এলেই কলকাতার বাজারের বাত্তিগুলো রঙিন হয়ে ওঠে। ঈদকে কেন্দ্র করে কেনাকাটার জন্য জনারণ্য হয়ে ওঠে কলকাতার বিভিন্ন এলাকা। ঢাকার মতো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গেও যে ঈদ প্রধান একটি সামাজিক উৎসব, প্রতিবছরের রমজান মাস সে কথা বলে দেয়।
আসলে, বাঙালির ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামাজিক যাপন মিলেমিশে আছে ঈদ ও দুর্গাপূজায়। দুটিই এ অঞ্চলের প্রধান উৎসব। তাই, বাংলাদেশের মতোই ওপার বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গেও ঈদ ঘিরে সাধারণ মানুষের উৎসবমুখরতার আয়োজন কম কিছু নয়। কেননা, পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালি হিন্দুদের পাশাপাশি বড় সংখ্যায় বাঙালি মুসলিমের বসবাস। এ ছাড়া অবাঙালি মুসলিমরাও বাস করেন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাসহ বিভিন্ন শহর ও শহরাঞ্চলে। আর তাই ঈদ বড়সড় একটি সামাজিক উৎসব ওপার বাংলায়।
প্রতিবার রমজান মাসে কলকাতার শপিং মলগুলো থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় বাজারগুলোতে জমে যায় উৎসবোন্মুখ মানুষের ভিড়। মহল্লায় মহল্লায় আর বিভিন্ন রেস্তোঁরাজুড়ে ইফতার পার্টি, ইফতারকে কেন্দ্র করে পাড়ায় পাড়ায় অস্থায়ী দোকানপাটের ভিড় লেগে যায়।
কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন, ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটি কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শিখুন’, রমজান মাসের কলকাতায় এ লাইনটির অন্য রকম তাৎপর্য। কেননা ঈদের বাঁকানো সরু মায়াবী চাঁদের আগেই কলকাতার অলিগলিতে রমজান মাসের আয়োজন অন্য রকম আনন্দদায়ক, কলকাতাকে নতুনভাবে চিনে নেওয়ার এ এক বিশেষ সময়। বাবু বাঙালিদের কলকাতার মধ্যেই যে আরও এক কলকাতা আছে, রমজান মাস এলেই তা চোখে পড়ে। ঐতিহ্যের সঙ্গে হাল ফ্যাশনের যে মেলবন্ধন, তা এই মাস ও ঈদকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কল্লোলিনী এ-নগরীর আবহে।
চিৎপুর
উত্তর কলকাতার সীমানার প্রাচীন অঞ্চল চিৎপুর, মানে নাখোদা মসজিদ। মানে আতর, সুগন্ধি, সুরমা। সেখানে শতাব্দীপ্রাচীন বিফ বিরিয়ানি আর সার বাঁধা কাবাবের দোকান। চিৎপুর মানে পাঞ্জাবি। মূলত ট্র্যাডিশনাল পাঞ্জাবির জন্য স্থানটি বিখ্যাত। এর চাহিদা বেড়ে যায় ঈদের মৌসুমে। পশ্চিমবঙ্গের দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আজও আসেন চিৎপুরের ঐতিহ্যশালী পাঞ্জাবির সন্ধানে। রমজান মাসের দিনগুলোয় দুপুর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে শহরের অলিগলি-পাকস্থলীর ভেতর বিছানো মহল্লা চিৎপুরে। আর ক্রেতাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে নানান নকশার পাঞ্জাবি, কুর্তা, পাজামা। পাঞ্জাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নানা ধরনের টুপিও পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। ঈদ এলে পাঞ্জাবি, কুর্তার পাশাপাশি বৈচিত্র্য দেখা যায় টুপির সম্ভারেও। এ ছাড়া ইফতারের জন্য ফলমূলসহ সুস্বাদু খাদ্যের অস্থায়ী স্টলের মেলা বসে এই এলাকায়। ঈদের জন্য নানা প্রকার সেমাইয়েরও অস্থায়ী স্টলের সারি দেখা যায় চিৎপুরের অলিগলিতে।
নিউমার্কেট, পার্কস্ট্রিট
কলকাতায় নিউমার্কেট চত্বরের পোশাক-প্রসাধনী-অলংকারসহ নানা ধরনের দোকান ও বিপণিগুলোতে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু ঈদ ও দুর্গাপূজা এলে ভিড় একটু বেশি থাকে। শাড়ি-জামাকাপড়-প্রসাধনী-জুতা-গৃহসজ্জার আসবাব কেনার জন্য আশপাশের জেলাগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের ভোক্তারাও ভিড় জমান। জামাকাপড়ের পাশাপাশি জাঙ্ক-জুয়েলারির জন্যও মধ্য কলকাতার নিউমার্কেট ও দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট ভালো জায়গা। শুধু তা-ই নয়, মেট্রোসেক্সুয়ালিটির যুগে উৎসবকে কেন্দ্র করে ট্রেন্ডি পোশাক-আশাকের মতোই হাল ফ্যাশনের রূপসজ্জার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তাই কয়েক বছর ধরে কলকাতার নিউমার্কেট, পার্কস্ট্রিট ট্যাটু পার্লার ও সেলুন-বিউটি পার্লারগুলোতে ঈদ উপলক্ষে চোখে পড়ছে বিশাল লাইন। অগ্রিম বুকিংয়েও ডেট পাচ্ছেন না অনেকে। নিউমার্কেট-পার্কস্ট্রিট এলাকার ট্যাটু পার্লারগুলোতে ত্বকে খুঁড়ে অঙ্গে উল্কির চিত্রশোভা ফুটিয়ে তুলতে ঈদ-উল-ফিতরের আগে গোটা রমজানজুড়ে নতুন প্রজন্মের ভিড় চোখে পড়ার মতো। আর সেলুন, বিউটি পার্লার, স্পা পার্লারগুলোয় ঈদের কিছুদিন আগে তিলধারণের জায়গাও থাকে না। রুমি ট্যাটু কিংবা জাভেদ হাবিবস-এর মতো সেলুন, বারবি বা গ্লোবের মতো বিউটি পার্লারগুলোতে উঁকি মারলেই দেখা যাবে উৎসবের ব্যস্ততায় কেশ, রূপ ও অঙ্গসজ্জায় মগ্ন সেখানকার রূপসজ্জার শিল্পীরা। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে মেহেদির প্রতি মহিলাদের আকর্ষণ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। ঈদকে কেন্দ্র করে দুর্গাপূজার মতোই বাটা, শ্রীলেদার্স, খাদিমের মতো জুতা কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিটি আউটলেটে বিশেষ ডিসকাউন্টের ব্যবস্থাও করে আসছে প্রতিবছর। ফলে বাজেটের মধ্যে হাল ফ্যাশনের জুতা সংগ্রহের জন্যও শহরের জুতা বিপণিগুলোয় ভিড় লেগে যায়। আর নিউমার্কেট চত্বরে ঈদের শপিংয়ে এসে সবাই চান আমিনিয়া, নিজামের মতো রেস্তোঁরাগুলোয় ইফতার সেরে নিতে। আমিনিয়ার বিরিয়ানি আর নিজামের কাবাব বিখ্যাত আইটেম হলেও হালকা ইফতার সেরে নেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয় প্রতি রমজানেই। এই রেস্তোরাঁগুলোতে হালিম ও ফালুদা থাকে স্পেশাল মেনুর তালিকায়।
চাঁদনী, মেট্রোগলি, মার্কেট স্ট্রিট
৩০ দিনের রোজায় প্রতিদিন ইফতারে হালিমের জুড়ি মেলা ভার। ইদানীং শহরের নামিদামি রেস্তোরাঁগুলোতে মাটন হালিম বানানো হলেও চাঁদনি এলাকায় স্টেটসম্যান বিল্ডিং আর টিপু সুলতান মসজিদ-সংলগ্ন ফুটপাতের ঠেলাগাড়িতে যে বিফ হালিম পাওয়া যায়, তা স্বাদ আর কোয়ালিটির দিক থেকে নামিদামি করপোরেট রেস্তোরাঁগুলোকে হার মানায়। এর স্বাদ যিনি পাননি, তাঁর পক্ষে বোঝা অসম্ভব হালিম কতটা সুস্বাদু হতে পারে। স্বল্প আয়ের মানুষ সস্তায় এই হালিমের স্বাদ গ্রহণ করলেও রমজান মাসে এটি খেতে ছুটে আসে নানা শ্রেণি ও বিত্তের মানুষ। ইফতার উপলক্ষে ফলমূলের অস্থায়ী দোকানে ভরে ওঠে চাঁদনি এলাকা থেকে শুরু করে মেট্রোগলি, মার্কেট স্ট্রিট।
মধ্য কলকাতার প্রাচীন এলাকাগুলোর মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তালতলা-সংলগ্ন মার্কেট স্ট্রিট। রমজান মাসে এই এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে জামাকাপড় থেকে শুরু করে প্রসাধনী ও নানা খাবারের অস্থায়ী দোকান। রীতিমতো মেলা বসে যায় এসব এলাকায়।
পার্কসার্কাস
কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরণির অদূরেই পার্কসার্কাস। এই এলাকায় রয়েছে পার্কসার্কাস ময়দান। দুর্গাপূজায় ওই ময়দানের মেলা বিখ্যাত। ঠিক একইভাবে রমজান মাস থেকে শুরু করে ঈদ উপলক্ষে ওই ময়দানে মেলা ও জনসমাগমও কলকাতার প্রধান আকর্ষণ। এই পার্কসার্কাসে ইফতার করার জন্য বেশ কিছু রেস্তোরাঁ বিখ্যাত। যেমন আরসানাল, জমজম, সিরাজ গোল্ডেন ও জোমাটো। ইফতার ও সেহরির বিশেষ ব্যবস্থা থাকে এসব রেস্তোরাঁয়। মোগল, চায়নিজ, বাঙালি, সাউথ ইন্ডিয়ানসহ বিভিন্ন ধরনের মেনু রয়েছে রেস্তোরাঁগুলোতে। তবে, মোগলাই পদের জুড়ি মেলা ভার। ইফতার ও সেহরির জন্য মানুষের লাইন পড়ে যায় এসব রেস্তোরাঁয়। কলকাতায় নতুন গড়ে ওঠা চেইন রেস্তোরাঁ স্যান্টাজ ফ্যান্টাসির আরবি গোস্ত পোলাও, বাঁশ পোড়া বিরিয়ানি, বাঁশ পোড়া কাবাব ইত্যাদি পদেরও বিশেষ চাহিদা রয়েছে কলকাতার যেকোনো উৎসবে। রমজান মাসের দিনগুলোয় ইফতার ও সেহরির ক্ষেত্রে এই চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
সম্প্রীতি
ঈদের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বাজার-দোকান-রেস্তোরাঁয় মানুষের সমাগম চোখে পড়ার মতো। রমজান মাস এলেই বোঝা যায়, সম্প্রীতির কলকাতা আছে কলকাতাতেই, আসলেই এটা জাদুর শহর।
ছবি: সংগ্রহ