skip to Main Content

সাইড স্টোরি I ট্রেন্ড কো-ব্র্যান্ড

প্রায় সব বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডই ঝুঁকছে কো-ব্র্যান্ডের দিকে। বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা নতুন এই ধারার অনুসরণ ঘটছে বাংলাদেশেও। লিখেছেন জাহিদুল হক পাভেল

তরুণদের হাত ধরেই বদলায়। বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডি ভেঙে নতুনকে স্বাগত জানাতে প্রথম পদক্ষেপও নেয় তরুণেরা। রাষ্ট্র, রাজনীতি, চিন্তা, প্রযুক্তি কিংবা ফ্যাশন- সব ক্ষেত্রেই তারা পুরোনোকে পেছনে ফেলে। প্রচলিত প্রথার আগল ভেঙে তৈরি করে নতুন ট্রেন্ড। ওড়ায় নতুনের কেতন। বলা হয় তরুণ-তরুণী বরাবরই ফ্যাশন-সচেতন। বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে যা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে কে কোন পোশাক পরছে, তা জানা যায় মুহূর্তেই। ডিজাইনের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে। অর্থাৎ ফ্যাশন-দুনিয়ার বড় অংশ আবর্তিত হয় এদের পছন্দ, চাহিদা ও চিন্তাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের ফ্যাশনবাজারও এর বাইরে নয়। কেননা নব্বই দশকের শুরুতেই মূলত দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর পথচলা শুরু হয়। সে সময় উদ্যোক্তা হিসেবে তরুণেরাই ছিল সবার আগে। আবার ক্রেতার কাফেলায় তরুণেরাই সিংহভাগ। সেই পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান।
বদল অবশ্য আরও একটা ক্ষেত্রে ঘটেছে। এখনকার তরুণ বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা। তাদের পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে ডিজিটাল-পূর্ব প্রজন্মের ফারাক তাই লক্ষণীয়। ব্র্যান্ডগুলোও বিষয়টি বিলক্ষণ জানে। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি হলেও তরুণদের উচ্ছ্বাসকে উসকে দিতেই ঢাকার ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো সমান্তরালে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে কো-ব্র্যান্ডের সঙ্গে। বেশির ভাগেরই লক্ষ্য তরুণ। কোনো-কোনোটি আবার ঠিক উল্টো করেই ভাবছে। সিনিয়র সিটিজেনরাই তাদের লক্ষ্য।
বেশ আগে এই ধারার সূচনা করে ক্যাটস আই। মূল ব্র্যান্ডের সহোদর হিসেবে ১৯৯৩ সালে মনসুন রেইন আর ১৯৯৮ সালে আনলিমিটেড লঞ্চ করার মধ্য দিয়ে। তখন বিষয়টি নিয়ে অন্য ব্র্যান্ডগুলো ততটা উৎসাহ বোধ করেনি। তবে বেশ অনেক বছর পরে এক্সট্যাসি দুটো ব্র্যান্ড চালু করে। তানজীম ও জার জেইন।
তানজীমের পরে আসে আড়ংয়ের তাগা। ২০০৩ সালে। এরপর বেশ কিছুদিন এই ধারায় বিরতি ছিল। তারপর নতুন কো-ব্র্যান্ড আনে প্রাইড আর অধুনা বন্ধ রঙ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে হিড়িক পড়েছে কো-ব্র্যান্ড খোলার। এগুলোকে কেবল অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখছেন না ব্র্যান্ড মালিকেরা। তাদের ভাষায় এটা সময়ের দাবি। কো-ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক একেবারেই তরুণ-তরুণীদের জন্য। নতুন প্রজন্মের ক্রেতাদের চাহিদা পূরণের জন্য দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর এই প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে চলতি দশকের শুরু থেকেই।
আড়ংয়ের তাগা
আন্তর্জাতিক ফ্যাশনবাজার সামনে রেখে ২০০৩ সালে আড়ং তার নামের সঙ্গে যোগ করে আরও একটি নাম ‘তাগা’। সারা বিশ্বে যে রঙ ও প্যাটার্ন চলে, সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে তাগা তৈরি করে তাদের কালেকশন। এই কো-ব্র্যান্ডের প্রডাক্ট লাইনে রয়েছে কুর্তি, টপস, সিঙ্গেল কামিজ, পালাজো, প্যান্ট, স্কার্ট ও অ্যাকসেসরিজ। এ ছাড়া এখানে হবু মায়েদের জন্য রয়েছে বিশেষ একটি প্রডাক্ট লাইন, যা একাধারে আরামদায়ক ও আধুনিক। এরই মধ্যে তাগা তরুণীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আড়ংয়ের সব শাখাতেই আছে তাগার কালেকশন। এই ঈদে তাগা মেন লঞ্চ করার কথা থাকলেও সেটা হয়ে ওঠেনি। শোনা যাচ্ছে কোরবানির ঈদে হবে।
এক্সট্যাসির তানজীম ও জার জেইন
এক্সট্যাসি লিমিটেডের কো-ব্র্যান্ড তানজীম ও জার জেইন। মূলত ছেলেদের ব্র্যান্ড হিসেবে ২০০৬ সালে তানজীম-এর যাত্রা। আর মেয়েদের ব্র্যান্ড জার জেইন। তরুণদের মধ্যে ডেনিম এবং পোলোর চাহিদাই বেশি। তাই ছেলেদের জন্য ফ্যাশনেবল পোশাকের সীমিত ও আকর্ষণীয় কালেকশন তৈরি করে থাকে কো-ব্র্যান্ডটি। এ ছাড়া ছেলেদের জুতা, ওয়ালেটসহ আনুষঙ্গিক সব জিনিসও রয়েছে এর প্রডাক্ট লাইনে। মেয়েদের জন্য ট্রেন্ডি টিউনিক, কুর্তা, টপসের কালেকশন রয়েছে জার জেইনে।
কে ক্র্যাফটের ইয়াং কে
দেশীয় উপকরণে তরুণদের উপযোগী কালেকশন সব সময়ই করেছে কে ক্র্যাফট। তবে তরুণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়াসে খোলা হয় এর নতুন কো-ব্র্যান্ড করে ইয়াং কে। ২০১৫ সালে। এ নিয়ে কে ক্র্যাফটের উদ্যোক্তা খালিদ মাহমুদ খান বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই নতুন কো-ব্র্যান্ড। আর বর্তমানে সবাই নিজেকে এগিয়ে রাখতে চায়। তরুণ ক্রেতাদের হাতে ভবিষ্যতের পণ্য পৌঁছে দিতে এই আয়োজন। ইয়াং কে-এর প্রথম আউটলেট সোবহানবাগে। পরে পুলিশ প্লাজা, মিরপুর এবং বেইলি রোডে শাখা ছড়ায়।
রঙ বাংলাদেশের চারটি কো-ব্র্যান্ড
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের ট্রেন্ড নিমেষেই জেনে নিতে পারে যে কেউ। তরুণেরা আরও এগিয়ে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তাদেরও চাহিদা হাল পোশাক। আর এই চাহিদা পূরণের জন্য রঙ বাংলাদেশের পাশাপাশি চাই কো-ব্র্যান্ড। সেটাই মনে করেন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ। তিনি আরও বলেন, রঙ বাংলাদেশ সরাসরি দেশীয় ঐতিহ্য ও ধারাকে অনুসরণ করে। সেই জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের ট্রেন্ডকে তুলে ধরাটা একটু কঠিন। তাই আমরা ২০১২ সালে ওয়েস্ট রঙ শুরু করি। তবে ওয়েস্ট রঙে দেশীয় উপাদানেই পোশাকগুলো তৈরি হয়। নকশা ও আঙ্গিকে থাকে ভিন্নতা। এখানে বলে রাখা ভালো, রঙ বিভক্ত হওয়ার আগে দুটো কো-ব্র্যান্ড করেছিল। একটা ওয়েস্ট রঙ আর একটা শ্রদ্ধা। ওয়েস্ট রঙ চলে আসে রঙ বাংলাদেশ-এর দিকে। তখন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মূল ফটকের সঙ্গেই ছিল এর আউটলেট।
ওয়েস্ট রঙে ছেলেদের জন্য আছে পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, কাতুয়া আর মেয়েদের জন্য টপ, কুর্তা ইত্যাদি। রঙ বাংলাদেশের রয়েছে আরও তিনটি কো-ব্র্যান্ড। শ্রদ্ধাঞ্জলি, রঙ জুনিয়র ও আমার বাংলাদেশ।
প্রাইড গার্লস ও আরবান ট্রুথ
নিয়মিত কালেকশনের পাশাপাশি ভিন্ন প্যাটার্ন ও বৈচিত্র্যের পোশাক বাজারজাত করার লক্ষ্যে প্রাইড তৈরি করে নতুন কো-ব্র্যান্ড। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে জন্ম হয় প্রাইড গার্লস। সব বয়সীর রুচি ও চাহিদা মাথায় রেখে প্রাইড গার্লের কালেকশন তৈরি হয়। এখানে আছে আধুনিক এবং স্টাইলিশ ছাপা নকশা, ভিসকস, সুতি, নিট এবং ওভেন ফ্যাব্রিকে তৈরি পোশাক। সাধারণত বিশ্বফ্যাশনের চলতি রঙ ও ধারা অনুযায়ী প্রাইড গার্লের কালেকশন তৈরি করা হয়। কো-ব্র্যান্ডে সেরা এক আকর্ষণ ট্রেন্ডি জুয়েলারি।
নিপুণের মাকু
মিনিম্যালিস্টিক ফ্যাশনে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড নিপুণ শুরু করে তাদের কো-ব্র্যান্ড মাকু। নিপুণের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার মাশিয়া রহমান অতশি বলেন, ট্রেন্ডি ফ্যাশনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকে নিজেদের ওয়্যারড্রোব ভরিয়ে তোলেন। কিন্তু প্রতিদিনের ফ্যাশনে আসলে প্রয়োজন এমন কিছু পোশাক, যা একাধারে স্টাইল স্টেটমেন্ট ও ট্রেন্ডকে তুলে ধরে। এই যেমন অফিসে যাওয়ার জন্য একটি মেয়ের বিভিন্ন ধরনের পোশাক প্রয়োজন। মাকু বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করেছে বিশেষ কালেকশন। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচের মাধ্যমে এর প্রতিটি পোশাক নারীকে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রকাশ করবে।
মাকু বিশেষত মেয়েদের ব্র্যান্ড। এর প্রডাক্ট লাইনে রয়েছে কুর্তা, সিঙ্গেল কামিজ, টপস ইত্যাদি।

অঞ্জন’স-এর তিনটি কো-ব্র্যান্ড
আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে অতি সম্প্রতি অঞ্জন’স শুরু করেছে কো-ব্র্যান্ড মারজিন। পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল পোশাকের রঙ ও উপস্থাপনায় ভিন্নতা আনতে আর্ট অব ব্লু নামে আরও একটি কো-ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছে। নতুন কো-ব্র্যান্ড সম্পর্কে অঞ্জন’স-এর শীর্ষ নির্বাহী শাহীন আহম্মেদ বলেন, ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডি পোশাকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এই নতুন প্রয়াস। এর সঙ্গে আমি আরও একটি বিষয় যোগ করতে চাই। তা হচ্ছে, সহ-ব্র্যান্ডগুলো মূল ব্র্যান্ডের সক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকেও প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে চোখ রাখলে দেখা যাবে, বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কো-ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছে। এককথায় বলতে গেলে ক্রেতাচাহিদাকে পরিপূর্ণ করার লক্ষ্যেই এই আয়োজন।
অন্যান্য
দেশী দশের দশটি ফ্যাশন হাউজ পরিস্থিতির কারণে কো-ব্র্যান্ড করতে উদ্যোগী হয়েছে। যদিও এককভাবে ২০১৫ সালে কো-ব্র্যান্ড ইয়াং কে লঞ্চ করে কে ক্র্যাফট। আর ভাগ হওয়ার আগে রঙ একাধিক কো-ব্র্যান্ড করেছিল; ভাগ হওয়ার পর রঙ বাংলাদেশ হয় দেশী দশের সদস্য। তারাও ২০১৪ সালে শুরু করেই তিনটি কো-ব্র্যান্ড করে। এ প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে বাকিরা কো-ব্র্যান্ড করেছে। এই তালিকায় আছে বাংলার মেলার বাংলা হাট, সাদাকালোর বিয়ন্ড সাদাকালো, বিবিআনার বালিকা বেলা, দেশাল-এর এসেন্স অব দেশাল, নগরদোলার ব্লক টাচ নগরদোলা, নিপুণ-এর মাকু, অঞ্জন’স-এর আর্ট অব ব্লু ও মারজিন এবং সৃষ্টির প্রিন্ট ক্র্যাফট।
কো-ব্র্যান্ড করার কারণ ব্যাখ্যায় সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ জানান, প্রাথমিকভাবে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির দেশী দশে প্রতিটি ফ্যাশন হাউজ একটি করে কো-ব্র্যান্ড শুরু করেছে। এটি আসলে নিরীক্ষা। ক্রেতাদের হাতে দেশীয় ঘরানার পোশাকের বাইরে আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডি পোশাক তুলে দিতেই এই চেষ্টা।
তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বেশ আগে থেকেই কো-ব্র্যান্ড তৈরি করছে। এমনকি ক্রেতারাও তা গ্রহণ করছেন। আমাদের দেশে ধারণাটি এখনো নতুন। ক্রেতারা কীভাবে এটাকে গ্রহণ করবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়।
এর বাইরেও বিশ্বরঙ-এর কো-ব্র্যান্ড রয়েছে দুটি। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য শ্রদ্ধা ও তরুণদের জন্য ফেস রঙ। অভিজাত পাড়ার ফ্যাশন ব্র্যান্ড আনোখির বর্তমানে দুটি কো-ব্র্যান্ড। অনিকিনি ও শাপলা শালুক। টি-শার্টের জন্য একসময়ের জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ নিত্য উপহারের রয়েছে শঙ্খবার নামে একটি কো-ব্র্যান্ড।
কো-ব্র্যান্ড কালচার নতুন নয়। এই ধারা আন্তর্জাতিক বাংলাদেশে তাই অনুসৃত হচ্ছে। তবে কতটা মূলধারার চেয়ে আলাদা আর অনন্য হয়ে উঠছে, সেটাই বিবেচ্য।

ছবি: আশরাফ শাজাদ ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top