মনোজাল I আই হ্যাভ নাথিং টু ওয়্যার
বিশ্বজোড়া নারীদের আওড়ানো সবচেয়ে মামুলি বুলি। সর্বজনীন এমন অভিযোগের পেছনের সত্যতার খোঁজে রত্না রহিমা
কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে, পুরো আলমারি তোলপাড়। উদ্দেশ্য? কী পরা হবে। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, সেই বিশেষ অনুষ্ঠানকে বিশেষায়িত করে তোলার জন্য মনমতো কোনো পোশাকই আপনার পছন্দ হচ্ছে না। আর তখনই মনে হবে, হায় হায়, পরার মতো তো কিছুই নেই! আপনি একা নন। এই তালিকার নারীরা রয়েছেন বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর প্রত্যেক নারীরই কোনো না কোনো সময় কথাটি মনে হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বাক্য আওড়ানো নারীদের একটি সাধারণ অভিযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলমারিতে ভরপুর পোশাক থাকার পরেও। জরিপ বলছে যেকোনো উন্নত দেশে একজন নারীর গড়পড়তা ৯৫টি পোশাক থাকে, যেগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেক তারা কখনো ধরেও দেখেন না। তারপরেও কথাটি তাদের প্রায় মনে হয়। এর অর্থ হলো, একজন নারীর যখন পর্যাপ্তের চেয়ে বেশি পোশাক থাকে, তখনো তাদের পরার মতো কিছু খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সে তুলনায় আলমারিতে পোশাকের সংখ্যা কম। যেগুলো থাকে, সবই কিন্তু পছন্দ করে কেনা। তারপরেও পরার জন্য যখন বিশেষ কিছু খোঁজা হয়, দেখা যায়, কিছুই পছন্দ হচ্ছে না! কেন হয় এমন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে ‘পরার মতো কিছু নেই’ বলে নারীদের দাবি, এর নেপথ্যে অনেক কারণ থাকতে পারে। আলমারিতে এমন অনেক পোশাক থাকে, যা তারা কখনো পরেননি কিংবা ট্যাগটাও ছেঁড়া হয়নি; তবু অবস্থাবিশেষে প্রায় সব নারীরই কোনো না কোনো সময় এ কথাই মনে হয়। কেন?
ডিসিশন ফ্যাটিগ
একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, নারীরা তাদের আলমারি থেকে পোশাক নির্বাচন করার সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ক্লান্তি অনুভব করেন। গবেষণা অনুসারে, ডিসিশন ফ্যাটিগ একধরনের মানসিক ক্লান্তি, যা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ঘটে। অতএব, যখন একজন নারীকে পোশাক নির্বাচনের কাজটি করতে হয়, তখন তিনি হাল ছেড়ে দেন। আবার কেউ কেউ বারবার একই জিনিস পরতে পছন্দ করেন। যে পোশাকে একবার সুন্দর বোধ করেছেন, সেটিই তার বারবার পরতে মন চায়। অথচ তিনি নিজেও জানেন, পোশাকটি হয়তো এই অনুষ্ঠানে পরার উপযুক্ত নয়। তখন সিদ্ধান্তের অস্থিরতা তাকে এমন ভাবতে বাধ্য করে।
সমালোচিত হওয়ার ভয়
আরেকটি কারণ হলো অন্যদের কাছে সমালোচিত হওয়ার ভয়। তিনি মনে করতে পারেন, যা পরবেন, সেই পোশাক নিখুঁত হওয়া চাই, যাতে তাকে অসাধারণ লাগে। যদি তা না হয় কিংবা পোশাকের সামাজিক প্রত্যাশা পূরণ না হলে তাকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ তো আছেই! সবার সঙ্গে ছবি ভালো আসবে তো, আমাকে অন্যদের তুলনায় খারাপ লাগবে না তো ইত্যাদি নানা কিছু মাথায় ঘুরতে থাকে। সেখানেই জমে তার সিদ্ধান্তহীনতা। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। একটা পছন্দসই পোশাকের জন্য তিনি ক্রমাগত অনুসন্ধান করতে থাকেন, যা একসময় ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব
অনেক নারীই নিজ চেহারা সম্পর্কে অনিরাপদ বোধ করতে পারেন। ফলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তার পোশাক যথেষ্ট মানসম্মত নয়। কারণ, এতে তাকে ভালো দেখাচ্ছে না। ফলস্বরূপ, ‘নিখুঁত’ পোশাকের সন্ধান একটি অন্তহীন চক্রে পরিণত হয়। কারণ, নিজের যা আছে, তা নিয়ে কখনোই সম্পূর্ণ সন্তুষ্টবোধ করেন না তিনি।
সব কারণ মোটামুটি এই রকম। এবার তাহলে সমাধানের কথা বলা যাক। সেটিও বিশ্লেষকেরাই নানা রকম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করেছেন। যেমন তারা মনে করেন, নারীদের নিজ নিজ পছন্দের সঙ্গে স্বচ্ছন্দবোধ করার ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত। অন্যরা কী ভাববে, তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়। কোন পোশাকে তাকে সবচেয়ে ভালো লাগে, তা খুঁজে বের করে সেটিরই বিভিন্ন স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। তাতে অনেক রকম বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে প্রথমে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করা শ্রেয়।
কেন পরার মতো কিছু নেই
এই রকম মানসিক অবস্থা তৈরি হলে সেটিকে জাস্ট মজার ছলে না নিয়ে বরং বেশ ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা চাই। একজন নারীর আলমারি যখন নানা পোশাকে পরিপূর্ণ, কিন্তু সেগুলো তিনি পরতে পছন্দ করছেন না, সেই অবস্থাকে উপহাস করার কোনো মানে হয় না। বিশেষ করে যারা কিছুটা সৃজনশীল, তারা একই জিনিসপত্র বারবার দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাদের রুচি বদলে যায়; চোখ খোঁজে নতুন কিছু। স্পষ্টতই, পরিস্থিতিকে ভোগবাদী পরিবেশ আরও খারাপ করে তোলে। কারণ, এটি ক্রমাগত পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে এবং সবকিছুর সমাধান হিসেবে নতুন পণ্য কেনার পরামর্শ দেয়। এই পরিস্থিতিতে অবজ্ঞা কিংবা আত্মবিদ্বেষ কোনো সমাধান আনবে না। এই ধরনের মানুষ হলে সমস্যাটি মোকাবিলায় প্রথমে নিজের এই সত্য স্বীকার করে নেওয়া চাই। তারপর কল্পনাশক্তি দিয়ে কাজ করতে হবে। সেটি কীভাবে? নিজেকে একজন ভালো স্টাইলিস্ট হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। আলমারিতে আগে থেকেই আছে এমন জিনিসপত্র দিয়ে নতুন কিছু তৈরির জন্য নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে। নিশ্চিত করতে হবে আলমারির ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকা পুরোনো সবকিছু সম্পর্কে জানা আছে। কারণ, সেগুলোই হঠাৎ আবার প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। নিজের কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে সেগুলোকে নতুন করে সাজানো যেতে পারে। যদি এই ব্যবস্থা কাজ না করে, তাহলে ওয়্যারড্রোব আপডেট করার জন্য সাসটেইনেবল কৌশলগুলো সম্পর্কে চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময় করা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছ থেকে ধার নেওয়া।
শপিং স্টাইলের পরিবর্তন
যখন প্রচুর পোশাক থাকার পরেও নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান এলেই মনে হয় পরার জন্য উপযুক্ত কিছু নেই—এই অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। কারণ, আসলেই এটি একটি সমস্যা। এমনিতেই বলা হয়, বেশির ভাগ নারী পোশাকের ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয়ে অবসেশনে ভোগেন। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকে পোশাকের প্রতি যত্নবান হতে বাধ্য করা হয়। কারণ, চেহারার ওপর ভিত্তি করে আমাদের বিচার করার চল রয়েছে। সুতরাং এই অবস্থা সৃষ্টি হলে সেটি কোনো ব্যাপার নয় বলে ভান করা অনুচিত। দৃঢ় মনের নারীরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কেমন দেখাচ্ছে, তা ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তারা এটিও জানেন, বাইরের মানুষের কাছে ব্যাপারটি ম্যাটার করে। কারণ, মনে করা হয় উপযুক্ত পোশাক পরা একটি নির্দিষ্ট মৌলিক যোগ্যতার ইঙ্গিতবাহী, অন্যের চোখে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তাই এমন এক বা দুটি বিশেষ পোশাক সংগ্রহে রাখা যায়, যা প্রায় যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত।
তবে কখনো কখনো পরার মতো আসলেই তেমন কিছু পাওয়া যায় না নিজের সংগ্রহে। কারণ, আক্ষরিক অর্থেই এমন কিছু হয়তো কেনা হয়নি, যা বিশেষ আয়োজনে পরার উপযুক্ত। তাই পছন্দ হলেই অসাধারণ কিন্তু বিচ্ছিন্ন পোশাক কিনে লাভ নেই। এগুলো পরার সম্ভাবনা খুব কম। একবারই কেনার জন্য বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা যায়। কিন্তু কেনার সময় মনোযোগী ও কৌশলী হতে হবে। এমন পোশাক নির্বাচন করা চাই, যা ব্যক্তি চাহিদার পাশাপাশি অনুষ্ঠানের মেজাজের সঙ্গেও মানানসই।
ছবি: ইন্টারনেট
