টেকসহি I পাওয়ার অব ‘R’
ট্রেন্ড নয়, পরিণত হয়েছে জরুরতে। পুরোদস্তুর জীবনদর্শনে। যথার্থতা নয়, যেখানে গুরুত্ব পায় ব্যক্তি অভিপ্রায়
একটা নতুন পোশাক কেনা, নতুন গ্যাজেট ব্যবহার শুরু, কিংবা কফির জন্য ডিসপোজেবল কাপ নেওয়া—এমন ছোট ছোট সিদ্ধান্ত পরিবেশের ওপর রেখে যাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ, প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দ্রুত হ্রাস পৃথিবীর সামনে এক নতুন বাস্তবতা দাঁড় করিয়েছে। এই অবস্থায় ‘সাসটেইনেবল লাইফস্টাইল’ বা টেকসই জীবনধারা আর কেবল একটি ফ্যাশনেবল ধারণা নয়; এটি এখন টিকে থাকার অপরিহার্য দিকনির্দেশনা।
বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন পরিবেশবান্ধব পথে পা বাড়ানোর কথা ভাবছে, তখন প্রয়োজন এমন একটি সোজাসাপ্টা, প্রমাণিত ও বাস্তবমুখী কাঠামো—যেটি দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলোকে আরও সচেতনভাবে নিতে সহায়তা করবে। সেই প্রয়োজন থেকে এসেছে সাসটেইনেবিলিটির ছয়টি ‘আর’ (6 Rs): Rethink (পুনরায় ভাবা), Refuse (না বলা), Reduce (হ্রাস করা), Reuse (পুনরায় ব্যবহার), Repair (মেরামত), Recycle (পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা)।
এই ৬টি নীতি কেবল ভোগের ধরনকে বদলায় না; বরং সচেতনভাবে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শেখায়। ফ্যাশন, ফুড, টেকনোলজি, সৌন্দর্যচর্চা—সব ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো প্রয়োগযোগ্য।
রিথিংক
ভোগের ধরন বিশেষ করে ফ্যাশন বিশ্বে একটি অস্বাস্থ্যকর ও ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখনকার ফ্যাশন ট্রেন্ড মূলত ‘ফাস্ট ফ্যাশন’নির্ভর, যেখানে ক্রেতাদের বারবার অল্প দামে পোশাক কেনায় উৎসাহিত করা হয়। ফলে এমন অনেক পোশাক কেনা হয়, যেগুলো এক-দুবার পরার পর ফেলে দেওয়া হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি অনুযায়ী, বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্তত ৫০ শতাংশ এবং জৈব বৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে বস্তু, জ্বালানি ও খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে। এই দুর্যোগে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ, এর জন্য খরচ হয় বিপুল পরিমাণ পানি, রাসায়নিক ও শক্তি, যার প্রভাব পড়ে মাটি, বাতাস ও প্রাণিকুলের ওপর।
এই পরিস্থিতির উত্তরণে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো—ভাবনার পরিবর্তন। রিথিংক মানে শুধু নিজেকে প্রশ্ন করা নয়; বরং প্রয়োজনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা। একটি নতুন পোশাক কেনার আগে একবার ভাবতে পারেন—আপনি সত্যিই এটি ব্যবহার করবেন কি না। ব্যবহৃত ফোনটি কি সত্যিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, নাকি শুধু নতুন একটি মডেলের হাতছানিতে সেটি বদলাতে হচ্ছে? ছোট ছোট সিদ্ধান্ত থেকেই বড় পরিবর্তনের শুরু হয়।
ফ্যাশন টিপস
প্রতিবার শপিংয়ের আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে: ‘আমি কি আগে এটা ব্যবহার করিনি?’
বেসিক, টাইমলেস এবং উন্নত মানের পোশাকে বিনিয়োগ করা চাই।
কাপড় ও অ্যাকসেসরিজ কেনার আগে তার প্রোডাকশন সোর্স জেনে নিতে হবে।
রিফিউজ
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, জীবনে যে জিনিস সত্যিই প্রয়োজনীয় নয়, সেটি গ্রহণ না করাই পরিবেশ রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ। এই ছোট্ট ‘না’ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক বিশাল প্রভাব, যা শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং পুরো উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরও চাপ তৈরি করে। বিশেষ করে ফ্যাশন ও বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিনিয়ত এমন সব প্রলোভন হাজির হয়, যেগুলোর বেশির ভাগ অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষণস্থায়ী এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফাস্ট ফ্যাশনের আওতায় দ্রুত তৈরি হওয়া ট্রেন্ডি পোশাক, যেগুলো এক-দুবার পরার পরেই ছিঁড়ে যায় বা অচল হয়ে পড়ে, সেগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রতিরোধ করাই এই ধাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। তেমনিভাবে, বিউটি প্রোডাক্ট বাছাইয়ের সময়েও সতর্কতা জরুরি। অতি চকচকে ও বিলাসবহুল প্যাকেজিং, যেগুলো সাধারণত অতিরিক্ত প্লাস্টিকে মোড়ানো থাকে, সেগুলোকে ‘না’ বলা জরুরি। কারণ, এই একবারের ব্যবহারে মোড়কগুলোর অধিকাংশই যায় ল্যান্ডফিলে এবং বছরের পর বছর ধরে প্রকৃতিতে রয়ে যায়। অনেক সময় বিভিন্ন ব্র্যান্ড থেকে বিনা মূল্যে স্যাম্পল, ফ্লায়ার কিংবা প্রমোশনাল গিফট মেলে, যেগুলোর বেশির ভাগ অব্যবহৃত রয়ে যায়। এই অপ্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো সংগ্রহ না করাই ভালো; কারণ, এগুলো কেবল জঞ্জাল বাড়ায়। লাইফস্টাইলে কোনো ভ্যালু অ্যাড করে না।
স্টাইল হ্যাক
নিজের পছন্দের ব্র্যান্ডকে তাদের পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায়। ভোক্তার বিভিন্ন প্রশ্নই ভবিষ্যতের পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
এমন ব্র্যান্ড বেছে নেওয়া যায়, যারা তাদের প্রোডাকশনে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার এবং প্রোডাক্টের পূর্ণ ট্রেসিবিলিটি বা উৎসের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।
রিডিউস
এর মানে নিজেকে কিছু থেকে বঞ্চিত করা নয়; বরং ভোগের ওপর একধরনের সচেতন নিয়ন্ত্রণ রাখা। আজকালকার ব্যস্ত জীবনে দ্রুতগতির স্টাইলিংয়ের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতায়—কীভাবে কম কিনে বেশি ব্যবহার করা যায়।
ফ্যাশনের ক্ষেত্রে রিডিউস মানে হলো ট্রেন্ডের পেছনে না ছুটে এমন পোশাকে বিনিয়োগ করা, যা বহু বছর টিকে থাকবে এবং যেটি বিভিন্নভাবে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে পরা যায়। যেমন একটি সিম্পল লিনেন শার্ট বা ক্ল্যাসিক কাটের ব্লেজার, যা সময়ের সঙ্গে কখনো পুরোনো হয় না। এর মাধ্যমে শুধু অর্থ সাশ্রয় হয় না; বরং টেক্সটাইল শিল্পের অতিরিক্ত উৎপাদনের ওপরও চাপ কমে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় অ্যাকসেসরিজ বা মেকআপ প্রোডাক্ট কেনা থেকেও বিরত থাকা জরুরি।
স্টাইল হ্যাক
কাপড় বা মেকআপ প্রোডাক্ট কেনার সময় নিজের ওয়ারড্রোব স্ক্যান করে নেওয়া যায়। যা আছে তা থেকেই নতুন কম্বিনেশন তৈরির চেষ্টা ভালো কাজে দেবে। সৃজনশীলতা ও পরিবেশ—দুটিই উপকৃত হবে!
‘উইশলিস্ট’ ব্যবহার করা। কোনো পোশাক বা প্রোডাক্ট পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে না কিনে তা একটি তালিকায় যোগ হতে পারে। এক-দুই সপ্তাহ পরে যদি সেটি তখনো প্রয়োজনীয় মনে হয়, তখনই বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো।
রিইউজ
পোশাকের সবচেয়ে সাসটেইনেবল ব্যবহার হলো—এরই মধ্যে ওয়্যারড্রোবে থাকা পোশাক যতটা সম্ভব বেশিবার ব্যবহার করা যায়। রিইউজ বা পুনর্ব্যবহার শব্দটি অনেকে পুরাতনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু বাস্তবে এটি হলো সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। নতুন কিছু না কিনেও পুরোনোকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরাই এখন সাসটেইনেবল ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ। যেমন ব্যবহৃত জিনসের প্যান্টকে একটু কাটাকাটি করে বানিয়ে নেওয়া যায় ট্রেন্ডি ডেনিম স্কার্ট। শুধু পরিবেশ নয়, টাকাও বাঁচল এবং স্টাইলেও থাকা গেল ইউনিক! এমনকি গিফট দেওয়ার সময় র্যাপিং পেপারের বদলে ব্যবহার করা যায় পুরোনো স্কার্ফ, ম্যাগাজিন পেজ বা খবরের কাগজ। দেখতে যেমন ইউনিক, তেমনি একেবারেই জিরো ওয়েস্ট। পুরোনো পোশাক বা অ্যাকসেসরিজ থেকে তৈরি হতে পারে নতুন হোম ডেকর—যেমন প্যাচওয়ার্ক কুশন, রানার কিংবা শিশুর জন্য নরম ব্ল্যাঙ্কেট।
স্টাইল হ্যাক
ভিজ্যুয়াল অনুপ্রেরণা চাইলে তবে পিন্টারেস্ট বা ইনস্টাগ্রামে #UpcycledFashion বা #ReuseIdeas লিখে সার্চ করা যায়। ব্যস! অসাধারণ সব আইডিয়া দেখে মাথা ঘুরে যাবে!
রিপেয়ার
জামার বোতাম ছিঁড়ে গেছে, অথবা ব্যাগের চেইন আর কাজ করছে না—তাই বলে কি পুরো জিনিসটাই ফেলে দেওয়া উচিত? মোটেই নয়। বর্তমান যুগে মেরামত করা মানেই শুধু অর্থনৈতিক সাশ্রয় নয়, এটি একটি শক্তিশালী পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত। ফ্যাশন জগতে ছোট ছোট রিপেয়ারও অনেক বড় ভূমিকা রাখে। নিজের সেলাই মেশিনে একটু সময় ব্যয় করে জামার হেম ঠিক করে নেওয়া কিংবা ফাটা জিনসে কৌশলে প্যাচ লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে একদম নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট। পুরোনো জুতা পলিশ বা রিপেয়ার করে নতুন লুক দেওয়া, কিংবা চেইন লাগিয়ে পুরোনো ব্যাগকে আবার ব্যবহারযোগ্য করে তোলাও এই চর্চার অংশ।
স্টাইল হ্যাক
নিজে মেরামত করতে না পারলে স্থানীয় কোনো দর্জি, জুতা মেরামতের দোকান বা ছোট ওয়ার্কশপের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
রিসাইকেল
যখন কোনো কিছু আর মেরামত করা যায় না, পুনরায় ব্যবহারও অসম্ভব, তখনই আসে রিসাইকেল করার পালা। রিসাইকেল অর্থ এমনভাবে উপাদানগুলোকে পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করা, যেন সেগুলো নতুন কোনো রূপে ফিরে আসতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি ‘সাসটেইনেবিলিটি’-এর শেষ ধাপ হওয়া উচিত; প্রথম নয়। কারণ, রিসাইকেল প্রক্রিয়ায়ও জ্বালানি ও প্রযুক্তির ব্যবহার হয়, যার একটি পরিবেশগত মূল্য আছে।
ফ্যাশনের জগতে এমন অনেক উপকরণ থাকে, যেগুলো সহজে রিসাইকেল করা যায়—যেমন পুরোনো জামাকাপড়, ব্যবহৃত অ্যাকসেসরিজ বা ক্ষতিগ্রস্ত জুতা। এগুলো আশপাশে থাকা ট্রাস্টেড টেক্সটাইল রিসাইক্লিং সেন্টারে জমা দেওয়া যেতে পারে। একইভাবে খালি হয়ে যাওয়া বিউটি প্রোডাক্টের বোতল, মেকআপ টিউব অথবা কাচের পাত্র পাঠানো যায় নির্দিষ্ট রিসাইকেল প্রোগ্রামে। অনেক ব্র্যান্ড এখন এসব রিসাইকেলযোগ্য প্যাকেজ ফেরত দিলে পুরস্কার বা ডিসকাউন্ট অফার করছে—যেমন Lush, MAC বা Kiehl’s -এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্টাইল হ্যাক
নতুন করে কেনা বা ফেলে দেওয়ার আগেই গুগলে খুঁজে দেখা যায় কোথায় কাপড় রিসাইকেল হচ্ছে।
সাসটেইনেবিলিটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, বরং করপোরেট জগতেও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সচেতন ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব পণ্য ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেন, যা ব্র্যান্ডগুলোর দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এখনই তাদের ব্যবসায়িক মডেলে ৬টি R অন্তর্ভুক্ত করছে। Rethink -এর মাধ্যমে প্রোডাক্ট ডিজাইন পুনর্বিবেচনা করে সার্কুলার মডেলে যাওয়া, Refuse-এর মাধ্যমে পরিবেশদূষণকারী উপকরণ বর্জন, Reduce-এর মাধ্যমে উৎপাদনের সময় পানি, শক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার কমিয়ে আনা যেতে পারে। একইভাবে Reuse নীতিতে অফ-কাট ফ্যাব্রিক দিয়ে নতুন প্রোডাক্ট তৈরি, Repair-এ রিপেয়ার সার্ভিস চালু কিংবা DIY গাইড সরবরাহ এবং Recycle-এর মাধ্যমে রিসাইক্লিং প্রোগ্রাম চালু করে আরও টেকসই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
শিরীন অন্যা
মডেল: আরনিরা, ফারিণ, ইলিয়াস ও নিধি
ওয়্যারড্রোব: চমন চৌধুরী, বেলওয়ারি বাই ব্লুচিজ ও তান
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল
