টেকসহি I সংকটে রঞ্জকশিল্প
অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ায় ম্লান হতে শুরু করেছে প্রাকৃতিক রঞ্জকের ভাঁড়ার। পাল্টে যাচ্ছে বুনন আর বয়নের সঙ্গে এর সর্বজনীন সম্পৃক্ততা। যা রক্ষায় যথার্থ গবেষণা ও অভিযোজন এখন আর ঐচ্ছিক নয়; হয়ে উঠেছে অপরিহার্য
গেল কয়েক মাসে আবহাওয়ার বৈরী প্রভাবে নাস্তানাবুদ পুরো বিশ্ব। বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রাও ছাড়িয়েছে রেকর্ড। প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে ছারখার করে দিতে শুরু করেছে পৃথিবী। বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত তাপমাত্রার দরুন মানুষের মৃত্যুর খবরও বেড়েছে। অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার প্রভাব বহুমুখী। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আর প্রতিদিনকার কার্যক্রমে ব্যাঘাত তো ঘটায়ই, তবে কারিগরি খাতে এর প্রভাব একদমই আলাদা। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশের ক্র্যাফট সেক্টর। কারণ, এগুলো সরাসরি প্রকৃতিজাত উপাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু কি উপাদান, উৎস থেকে শুরু করে কারিগরদের স্বাস্থ্য নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয় এ ক্ষেত্রে। কারণ, কারুশিল্প খাতের অনেককে কাজ করতে হয় পল্লি পরিবেশে, কারখানার ভেতর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় নয়।
এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে প্রাচীন সব কারুশিল্প কৌশল। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ন্যাচারাল ডাইং। সাম্প্রতিক বছরগুলোকে বিশ্বব্যাপী এর পুনরুত্থান চোখে পড়ার মতো। কারণ, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং উদীয়মান ডিজাইন লেবেলগুলো ভোক্তাদের সচেতন ফ্যাশন-ভাবনা কাজে লাগিয়ে রং নিয়ে নিরীক্ষা এবং জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারে অভিনব সব উদ্ভাবনে মজে উঠেছে। এ ছাড়া কেমিক্যাল ডাই ব্যবহারে বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি হয়, ন্যাচারাল ডাইংয়ে সেই সম্ভাবনা শূন্য। শুধু তা-ই নয়, দারুণ প্রকৃতিবান্ধব এই পদ্ধতি। তাই এটি তৈরির সঙ্গে জড়িতদের যেমন ক্ষতি হয় না, তেমনি পরিধানকারীদের ত্বকের জন্যও কোমল। ফলাফল—ন্যাচারাল ডাইংয়ে এত ঝোঁক।
কিন্তু সাম্প্রতিক ক্লাইমেট ক্রাইসিস যুগপুরোনো সুন্দর, সহজ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বাড়াতে শুরু করেছে জটিলতা। ট্র্যাডিশনাল সেটআপে ডাইংয়ের প্রক্রিয়ায় সময়টা তুলনামূলক বেশি প্রয়োজন হয়। ডাই বাথ, ড্রাইং, মরডানটিংয়ের মতো কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়া সারতে হয় বলে। পুরো প্রক্রিয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন প্রাকৃতিক উপাদানের উৎস, পানির পিএইচ লেভেল। তাই আবহাওয়ার সামান্য তারতম্য ক্রাফট ইকোসিস্টেমকে অস্থিতিশীল করে তুলতে যথেষ্ট।
অ্যালার্মিং আউটকাম
ন্যাচারাল ডাইং বরাবরই ভারসাম্যে নির্ভরশীল—পানি এবং ভূমির, সূর্য আর বাতাসের, ঋতুর আর ফসলের। কিন্তু বর্তমানে সেই ভারসাম্য বিগড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক। ন্যাচারাল ডাই দিয়ে ডাবু হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টিংয়ের জন্য বিখ্যাত রাজস্থান। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত কাদা অথবা ন্যাচারাল ক্লে মিক্স ব্যবহার করা হয়, ভেজিটেবল ডাইয়ের রং পোক্ত করার জন্য। ভারতের শুকনা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত রাজস্থানেই শুধু কাজটা হয়। কিন্তু গেল কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির কারণে ভেস্তে গেছে সেই মহাযজ্ঞ। বাড়তি বৃষ্টির ফলে কাপড় বাড়তি আর্দ্রতা ধরে রাখতে শুরু করে, ন্যাচারাল ডাই ছড়িয়ে যায়; যা পুরো ব্লক প্রিন্টিং প্রক্রিয়াকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে। আর ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কাদা মাটি সহজে শুকায় না, ফলে ব্লক প্রিন্টিংও শুকাতে চায় না একদমই। রঙের ঘনত্বে সমস্যা হয়, সূক্ষ্ম নকশা হয়ে যায় এবড়োখেবড়ো। এতে বোঝা যায়, জলবায়ুর এমন পরিবর্তন কাজের ধরনকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে ফেলে। এক দিনের বৃষ্টি কারিগরদের সপ্তাহখানেকের কাজ বাড়িয়ে দেয়। আবার অন্ধ্র প্রদেশের কথা ধরা যাক, যেখানে ন্যাচারাল ডাই ব্যবহারে কলমকারি আর্টিসানরা তৈরি করেন একেকটি শিল্প। সেখানে ক্রমবর্ধমান তাপ আর আর্দ্রতার দরুন সৃষ্টি হয় পানিশূন্যতা থেকে শুরু করে হিট স্ট্রোকের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি। এতে পুরো প্রক্রিয়ার গতি মন্থর তো হয়ই, কারিগরি দক্ষতাও কমতে শুরু করে।
ঝুঁকিতে প্রাকৃতিক উপাদান
দক্ষতার পাশাপাশি পানির মান, কৃষি চক্র আর পরিবেশগত ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে ন্যাচারাল ডাই। ইন্ডিগো, র্যাক আর ভেজিটেবল ডাইয়ের জন্য প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট পিএইচ লেভেল, অক্সিডেশন আর পানির প্রবাহ। ডায়িংয়ের সঙ্গে জড়িত ডায়ারদের মত, পানির টিডিএসের (টোটাল ডিজলভ সলিড) মাত্রায় সামান্য হেরফের হলেই পরিবর্তিত হয়ে যায় রং। কলমকারির ক্ষেত্রে কাপড় ধোয়ার জন্য প্রয়োজন হয় নদীর প্রবাহিত পানির ধারা। বন্যা বা খরা—দুটোই এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। হঠাৎ বৃষ্টি অক্সিডেন্টকে তরল করে দেয়, আবার খরায় শুকিয়ে যায় ডাইয়ে ব্যবহৃত গাছগাছড়ার নির্যাস। ঝুঁকিতে ফেলে দেয় যুগপুরোনো প্রক্রিয়ার কার্যক্রম।
গবেষণা ও অভিযোজন
তবে আশার কথা হচ্ছে, জলবায়ু সংকট ঐতিহ্যবাহী কৌশলগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুললেও উদ্ভাবনের নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বায়োটেক ইন্টারভিশনের ফলে এখন তৈরি হচ্ছে সাসটেইনেবল কালার এক্সট্রাক্ট, ব্যবহৃত হচ্ছে মাইক্রোবায়োলজি সমর্থিত সব পদ্ধতি। ফর্মুলার মান নির্ধারণ, পিএইচ স্তর নিয়ন্ত্রণ আর অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াগুলোকে পদ্ধতিগতকরণের ক্ষেত্রে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে ডিজাইনাররা ও ব্র্যান্ডগুলো। লক্ষ্য একটাই—ঋতু পরিবর্তন সত্ত্বেও স্থিতিস্থাপকতা আর রঙের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের এই অংশীদারত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর অভিযোজন ছাড়া এর রং ম্লান হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সঠিক চর্চায় এই শিল্প বিকশিত হয়ে সৃষ্টি হতে পারে সাসটেইনেবল, স্কেলেবল আর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত শিল্প।
জাহেরা শিরীন
মডেল: তানজিদা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল
