ফুড বেনিফিট I জুকিনি
কতোভাবেই না খাওয়া হয় এটি, বিশ্বের নানা প্রান্তে। শরীরের যত্নে আর রূপচর্চায়ও এর অবদান এড়ানোর উপায় নেই
জুকিনি। রসনাতত্ত্বে এটি সবজি হিসেবে গণ্য। তবে উদ্ভিদবিদ্যায় বিবেচিত হয় ফল বলে। এর আঁতুড়ঘর উত্তর ইতালিতে। উনিশ শতকে এটি মানুষের খাদ্যতালিকায় ঠাঁই পায়। ধীরে ধীরে আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অংশেও বিস্তার লাভ করে। ইতালিয়ানরাই এ সবজি আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, সুইডেন ও জার্মানিতে এটি জুকিনি বলেই পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় এর নাম ‘বেবি মারো’। বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে পুষ্টিমানে ভরপুর ধুন্দলজাতীয় এ সবজি।
জুকিনি চার ইঞ্চি লম্বা হলে খাওয়ার উপযোগী হয়। এর খোসা খুব পাতলা। গাঢ় বা হালকা সবুজ রঙের হতে পারে এ সবজি। সংকর জাতীয় জুকিনি হলুদ অথবা কমলা রঙের হয়। পরিপক্ব একটি ফল এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। জুকিনি যত লম্বা হয়, তাতে আঁশের পরিমাণ তত বাড়ে। কচি অবস্থায় এর স্বাদ কিছুটা মিষ্টি।
জুকিনি মূলত রান্না করে খাওয়ার চল। এর রন্ধনপ্রক্রিয়ায় রয়েছে বৈচিত্র্য। ভাপে, সেদ্ধ করে, গ্রিল কিংবা স্টাফ করে, বেক, বারবিকিউ কিংবা ভেজে জুকিনি দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি করা সম্ভব। অনেকেই রুটির মধ্যে পুরে বেক করে খায়। কুমড়া ফুলের মতো জুকিনির ফুলও ভেজে খাওয়া যায়। মাখন কিংবা অলিভ অয়েল দিয়ে খাওয়া যায়। ভেজিটেবল অয়েল দিয়েও রান্না হতে পারে। পদ বুঝে এতে মসলাও ব্যবহৃত হয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম জুকিনিতে আছে ১৭ গ্রাম ক্যালরি, ০.৩ গ্রাম ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.১ গ্রাম, পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.১ গ্রাম, সোডিয়াম ৮ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৬১ মিলিগ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৩.১ গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার ১ গ্রাম। চিনি ১ গ্রাম, প্রোটিন ১.২ গ্রাম, ভিটামিন এ ৪ শতাংশ, ভিটামিন সি ২৯ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ১ শতাংশ, লৌহ ২ শতাংশ, ভিটামিন বি৬ ১০ শতাংশ এবং ম্যাগনেসিয়াম ৪ শতাংশ। এসব উপাদান আমাদের শরীরের নানাবিধ অসুখ সারাইয়ে কাজ করে।
হজমে চমকপ্রদ ভূমিকা রাখে জুকিনি। এতে জলীয় অংশ বেশি। যথেষ্ট ফাইবার ও ইলেকট্রোলাইট থাকায় এটি হজমপ্রক্রিয়ায় পাচন সহায়ক। নিয়মিত জুকিনি খেলে আলসার ও কোলন ক্যানসার থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। এ সবজিতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি। এ উপাদানগুলো শরীর থেকে ফ্রি র্যাডিক্যাল দূর করে। রক্তে শর্করার মাত্রা কমায় বলে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে এটি অসামান্য ভূমিকা রাখে। জুকিনি রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন ৩০ গ্রাম ফাইবার থাকলে ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। জুকিনি সেই পরিমাণ ফাইবার জোগান দেয়। শরীরে রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখার পাশাপাশি হৃদপি- সুস্থ রাখে। এতে কম মাত্রায় সোডিয়াম ও ফ্যাট রয়েছে। অন্যদিকে উচ্চমাত্রার পটাশিয়াম আছে। জুকিনির এই রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য শরীরের রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখে। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে এই সবজি। একে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট, ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন, ম্যাঙ্গানিজ এবং লুটিনের আধার বলা চলে।
চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে এ সবজি ব্যবহৃত হতে পারে। স্লাইস করা জুকিনি চোখের উপর ৩০ মিনিট রেখে দিতে হবে। নিয়মিত এটি করলে চোখের নিচের কালো দাগ দূর হবে। এতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন বি, ফোলেট, রিবোফ্লাভিন, ও বি৬ থাকে। এ উপাদানগুলো শরীরে শক্তি জোগানোর পাশাপাশি মন প্রফুল্ল রাখে। মস্তিষ্কের উন্নতিতেও কাজে লাগে এ উপাদানগুলো।
আগেই বলা হয়েছে, জুকিনিতে পানি ও ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ক্যালরির পরিমাণ কম। ফলে এটি ওজন কমাতে বিশেষ কার্যকর। জুকিনি অনেকক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুধা দমিয়ে রাখে। ফলে অন্যান্য খাবার কম খাওয়া হয়। এতে ডায়েট হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে শরীরের ওজন কমে। থাইরয়েড ও অ্যাড্রেনাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে জুকিনি। এর খোসায় যথেষ্ট পলিফেনল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই পলিফেনল থাইরয়েড ও অ্যাড্রেনালের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি ইনসুলিনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। জুকিনিতে বিদ্যমান গ্লুটাথায়ওন পার-অক্সাইড ও সুপারোক্সাইড শরীরের প্রদাহ কমায়। এ জন্য খোসাসহ জুকিনি খেতে হবে।
বিভিন্ন দেশে জুকিনি খাওয়ার পদ্ধতি বিভিন্ন। বুলগেরিয়ায় এটি ভেজে খাওয়া হয়। ভাজা জুকিনি, দই ও রসুন দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিশ্রণ খাবারের চল সেখানে রয়েছে। আভেন বেক জুকিনিও বুলগেরিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। ডিম, দই ও আটার মিশ্রণে জুকিনি ডুবিয়ে বেক করে সে দেশের মানুষ। গ্রিসেও জুকিনি ভেজে খাওয়া হয়ে থাকে। মাংসের কিমা কিংবা ভাতের সঙ্গেও এটি খাওয়া হয়। এ ছাড়া গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে এর ফুল পনির দিয়ে স্টাফ করে খাওয়ার চল আছে। মিসরীয়রা এটি টমেটো সস, পেঁয়াজ ও রসুন দিয়ে রান্না করে খেয়ে থাকে। ফ্রান্সের মুখরোচক পদ রাতাতুলের মূল সবজি হচ্ছে জুকিনি। এ ছাড়া ফরাসি রসনায় ‘স্টাফড জুকিনি’ নামের একটি পদ রয়েছে।
ইতালিতে জুকিনির হরেক রকম পদ মেলে। মেক্সিকোতে স্যুপের সঙ্গে কিংবা কুয়েসাডিলাস নামের একটি পদের পুর হিসেবে খাওয়া হয় জুকিনি। রাশিয়া ও ইউক্রেনে এ সবজিতে আটা মেখে ভেজিটেবল অয়েলে ভেজে খাওয়া হয়। তুরস্কের জনপ্রিয় রসনা মিউকভার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় জুকিনি। এ ছাড়া থাই ও ভিয়েতনামের রেসিপির স্যালাডে জুকিনির উপস্থিতি দেখা যায়।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট