বিশেষ ফিচার I চা-শিল্পে নারী
সমাজ-বাণিজ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পৃথিবীজুড়ে জনপ্রিয়তম ও সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়র নাম ‘চা’। জাদুপানীয় ছাড়া একটি দিন সত্যিই অকল্পনীয়। প্রিয় পাঠক, এই লেখা পাঠের আগে তাই হাতে এক কাপ চা তুলে নিন দয়া করে। কারণ, আহমাদ শামীম আপনাকে নিয়ে যাচ্ছেন চায়ের দুনিয়ার এক অনালোকিত ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে!
ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে চা-শিল্পের বিস্তারে নারীদের অবদান কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে চায়ের প্রভাবÑ এই লেখার মূল বিষয়। ভাবছেন সামাজিক ও বাণিজ্যিকভাবে চা-শিল্পের বিস্তারে নারীরা কীভাবে অবদান রেখেছে, আবার চা কীভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন করেছে? এসবের আগে চলুন চায়ের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিস্তারের ধারাবাহিকতা অল্প কথায় জেনে নিই।
ঐতিহাসিকভাবে বলা হয়, চায়ের বাড়ি চীন বা চীনেই চায়ের জন্ম। সেটাও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনের প্রাচীনতম রাজ্য শ্যাং ডাইনেস্টির আমলে বর্তমান ইউনান প্রদেশ থেকে। চায়ের ইতিহাস যদিও কয়েক হাজার বছর পুরোনো এবং জটিল গোলকধাঁধার আবর্তে ঘেরা। তবু সেই সময় চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ বিশেষ এই পানীয় ওষুধ ও জীবনীবর্ধক হিসেবে পান করতেন। এর স্বাদ, সুখ্যাতি ও গুণের কারণে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে চীন থেকে জাপান, জাপান থেকে কোরিয়া, কোরিয়া থেকে ভিয়েতনাম- এভাবে ধীরে ধীরে চা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় এশিয়া মহাদেশজুড়ে। চীনের মানচিত্র ছাপিয়ে চা চাষাবাদ শুরু হয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয়। সেই সঙ্গে চায়ের সংগ্রহ ও সংরক্ষণেও আসে নতুনত্ব। তবে চা ইউরোপে পরিচিতি পেতে সময় লেগে যায়। ১৫৫৫ সালে ইতালিয়ান পর্যটক জিওভান্নি বাতিস্তা রামুসিও তার ‘ভয়েজেস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ বইয়ের মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের কাছে চায়ের বার্তা পৌঁছে দেন। ১৫৬০ সালে পর্তুগিজ মিশনারি গ্যাসপার দ্য ক্রজ বিশদভাবে চায়ের কথা লেখেন তার চীন ভ্রমণের ট্রাভেলগে।
বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপে চায়ের বিস্তার ঘটে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের সংগঠন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। ১৬০৯ সালের দিকে তারা জাপানের হিরাদো থেকে বর্তমান নেদারল্যান্ডসে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চা রপ্তানি করে। বলা চলে, ওলন্দাজরাই ফ্যাশনেবল ড্রিংক হিসেবে চাকে ফ্রান্স, জার্মানি ও আমেরিকায় পৌঁছে দেয়। যদিও পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে চা-বাণিজ্য দখল করে নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এভাবেই চা চীনের একটি প্রদেশ থেকে কালের পরিক্রমায় ছড়িয়ে পড়ে বিশ^ব্যাপী।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা-বাণিজ্যে নাম লেখালেও ইংল্যান্ডে চায়ের কদর পেতে কিছুটা বরং দেরি হয়ে যায়। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের জীবনাচরণে চা জনপ্রিয়তা লাভ করে একজন নারীর কল্যাণেই। তিনি হলেন ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের (১৬৬০-১৬৮৫) স্ত্রী রানি ক্যাথরিন অব ব্রাগাঞ্জা (১৬৬২-১৬৮৫)। ক্যাথরিন ছিলেন পর্তুগালের রাজা জন অষ্টম ডিউকের মেয়ে। দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে বিয়ের পর ইংল্যান্ডে এসে কুইন কনসোর্ট অব ইংল্যান্ডের সদস্য হয়ে রানির খেতাব লাভ করেন তিনি। পর্তুগিজদের মধ্যে চায়ের প্রচলন ঘটে অনেক আগেই। ফলে ক্যাথরিন ইংল্যান্ডে আসার সময় চায়ের অভ্যাসটাও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। চা তিনি এতই ভালোবাসতেন যে ব্রিটিশ রয়্যাল কোর্টে যাওয়ার সময়ও তিনি চায়ের পেয়ালা সঙ্গে রাখতেন এবং রাজকার্য চলাকালেই চা পান করতেন। রানির পছন্দ যখন চা, তখন কী আর করা, ব্যাপকভাবে চা আমদানি শুরু করলো ইংল্যান্ড। ফলে চা শুধু রাজদরবারে সীমাবদ্ধ না থেকে জনসাধারণের মাঝেও বিস্তার লাভ করে অল্প সময়ের ব্যবধানে। বলা বাহুল্য, ক্যাথরিন তথা একজন নারীই ইংল্যান্ডের মানুষের চা পানের অভ্যেস তৈরি করে দেন।
তৎকালীন ইউরোপের আরেক প্রভাবশালী দেশ তথা রাজত্ব ফ্রান্সে চায়ের প্রচলন ঘটে ১৬৩৬ সালের দিকে, ইংল্যান্ডে চায়ের প্রচলন ঘটার প্রায় পঁচিশ বছর আগে ওলন্দাজদের হাত ধরে। ফরাসিদের মধ্যে চা জনপ্রিয় করে তুলতেও একজন নারী রেখেছেন ভূমিকা। তিনি তৎকালীন ফরাসি যুবরাজ (পরবর্তী সময়ে সম্রাট) ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী রানি ম্যারি অ্যান্তিনেত। তাদের দুজনেরই ভীষণ প্রিয় ছিল চা। সে সময় চলছিল ‘দ্য সান কিং’ হিসেবে খ্যাত ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্ব। গেঁটে বাতের উপশম হবে ভেবে তিনি প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ কাপের মতো চা পান করতেন! সম্রাটের অনুসরণে তখনকার দিনের ফরাসি উচ্চবিত্ত অভিজাত সমাজে চা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইউরোপের মানুষের কাছে চায়ের লিকারে দুধ মিশিয়ে ‘মিল্ক টি’ বা দুধ চায়ের পরিচিতিও ঘটে একজন ফরাসি নারীর হাত ধরে। তার নাম ম্যাডাম দে লা সাবলিরে। ১৬৮০ সালে নানান গুণের অধিকারী এই নারী তার নিজ উদ্যোগে গড়ে ওঠা সে সময়কার বিখ্যাত আড্ডাখানা ‘প্যারিস স্যালুন’-এ চায়ের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে আগত অতিথিদের পরিবেশন করেন। চায়ের স্বাদে নতুনত্ব আসায় এটা দ্রুতই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে যায়।
রাশিয়ান সাম্রাজ্যে চায়ের বিস্তৃতি ঘটানোর মূল কারিগরও কিন্তু একজন নারী। রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ পেত্রনোভা বা এলিজাবেথ অব রাশিয়া। তার শাসনামল ছিল ১৭৪১ থেকে ১৭৬২ সাল পর্যন্ত, বেশ কঠোর হাতেই তিনি সামলেছেন রাজকার্য। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ স্থাপনে রাশিয়ার চেষ্টা ছিল এলিজাবেথেরও প্রায় এক শ বছর আগে থেকে। এলিজাবেথ পেত্রনোভা যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তখন তার বৈদেশিক বাণিজ্যনীতির কারণে এই পথ খুলে যায়। অবশেষে প্রাথমিকভাবে চীন থেকে রাশিয়ায় আসে চা। অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ার মানুষও বেশ সাদরেই গ্রহণ করে নেয় চা নামের এই অতুলনীয় পানীয়কে।
ঐতিহাসিকভাবে চা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রথম সারির নারীর কথা বলবো এবার। নারী চা ব্যবসায়ীদের তালিকায় প্রথমেই চলে আসে ইংল্যান্ডের ম্যারি তুকেসের কথা। ১৬৯৫ সালে ইয়র্কশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র আটাশ বছর বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুতে বড় সন্তান হিসেবে ভাইবোনসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব চাপে তার কাঁধে। আঠারো শতকে যখন নারী স্বাধীনতার বালাই ছিল না এমনকি নারীদের নিজ নামে কোনো সম্পত্তি রাখারও অধিকার ছিল না, সেই সময় ১৭২৫ সালে আয়ের পথ হিসেবে ম্যারি ইয়র্কশায়ারের ওয়ালম্গেট এলাকায় একটি মুদিদোকান দেন। দোকানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি চা বিক্রি শুরু করেন। তার দোকানটি জনপ্রিয়তাও পায়। কিন্তু বাদ সাধে সেখানকার আইন। ইয়র্কশায়ারের ‘সোসাইটি অব মার্চেন্ট অ্যাডভেঞ্চার’-এর সদস্য ব্যতীত ব্যবসা করার অনুমতি ছিল না কারও তখন। ব্যবসার ছাড়পত্র নেই তার ওপর ব্যবসা করছেন একজন নারী, বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি কেউ। নানামুখী হুমকির পাশাপাশি জেল-জরিমানার শাস্তি বরণ করতে হয় তাকে। এসবের মধ্য দিয়েও আট বছর তিনি দোকান চালিয়ে যান। এবং অবশেষে জরিমানা দিয়ে ব্যবসার অনুমতি পান। ইতিমধ্যে ম্যারির চা ব্যবসা বেশ প্রসার লাভ করে। চায়ের সঙ্গে চকলেট বানিয়েও বিক্রি করতে থাকেন। তার প্রতিষ্ঠানের চা ও চকলেটের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ইয়র্কশায়ারে তাকে অনুসরণ করে অনেকেই চকলেট ব্যবসায় নাম লেখান পরবর্তী সময়ে। ১৭৫২ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সংগ্রামী এই নারী।
ম্যারি তুকেসের সাফল্যের কয়েক দশক পর চা ব্যবসায় সাফল্য দেখান ইংল্যান্ডের আরেক নারী ম্যারি লিটল টিউইনিং। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের প্রাচীনতম এবং বর্তমান সময়ের অন্যতম চা আমদানি-রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিউইনিংসের প্রতিষ্ঠাতা থমাস টিউইনিংয়ের ছেলে ড্যানিয়েল টিউইনিংয়ের স্ত্রী। সাধারণ ব্রিটিশদের কাছে চা সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করে তুলতে টিউইনিংসের ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হয়। ১৭০৬ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি বাপ-বেটা থমাস ও ড্যানিয়েল টিউইনিংয়ের কল্যাণে বেশ বড় আকার ধারণ করে। ১৭৬২ সালে ড্যানিয়েল টিউইনিংয়ের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন ম্যারি টিউইনিং। ইংল্যান্ড তথা পুরো ইউরোপেই চা ব্যবসা যখন তুঙ্গে, ওই বিরুদ্ধ সময়ে ম্যারি টিউইনিং ১৭৮৩ পর্যন্ত টানা ২১ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিউইনিংসের ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালন করে যান।
আঠারো শতকে যখন ইউরোপ তথা ব্রিটেনে ম্যারি তুকেস আর ম্যারি টিউইনিং চা ব্যবসায় সফল, তখন উনিশ শতকের মাঝামাঝি এশিয়া তথা জাপানের নারী ব্যবসায়ী আওরা কেই বিরাট বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন। জাপান থেকে চা প্রথম ইউরোপে রপ্তানি হয়। তবু বহির্বিশে^র সঙ্গে চা-বাণিজ্যে জাপান তেমন আগ্রহী হয়নি। স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকারের চা-ই নিজ দায়িত্বে কিনে নিয়ে যেত বাহিরের ব্যবসায়ীরা। চা উৎপাদন ও রপ্তানিকে বাণিজ্যিক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন আওরা কেই। জাপানের নাগাসাকির এক ধনাঢ্য তেল ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে আওরা। সে হিসেবে ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসায়িক আবহে বড় হয়ে ওঠেন। নিজে নিজে কিছু করতে চান বলেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৮৫৩ সালে তিনি জাপানে ব্যবসার কাজে আসা এক ওলন্দাজ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে স্থানীয় বিশেষায়িত ‘উরেসিনো-চা’ তথা ‘গ্রিন টি’র কিছু নমুনা ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পাঠান। এর তিন বছর পর এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী কয়েক টন গ্রিন টির অর্ডার দেন। এভাবে অল্প দিনের মধ্যেই তার কাছে মোট ৭২ টন চায়ের অর্ডার আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। নাগাসাকির কেইউশু প্রদেশের সব চাষি মিলে যেখানে একবারে ৬ টনের বেশি চা উৎপাদন করতে পারে না, সেখানে এত বড় অর্ডার সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায় পড়ে যান আওরা কেই। হঠাৎ করেই গ্রিন টির কদর বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ চাষিরা উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি চা ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে সেখানে। চায়ের উৎপাদন ও বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হবার ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মুক্তবাণিজ্যে নাম লেখায় জাপান। আর এর পেছনের প্রধান ব্যক্তিটি কিন্তু এই আওরা কেই।
আঠারো শতকে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে কয়েক দশকের আমেরিকান রেভল্যুশনে চায়ের প্রভাব ছিল দীর্ঘমেয়াদি। ব্রিটিশদের টি-অ্যাক্ট আইন ও নানাবিধ অন্যায্য বাণিজ্যিক কর আরোপের প্রতিবাদে ১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৯২ হাজার টন চা-পাতা ধ্বংস করে দেয় বোস্টনের কিছু প্রতিবাদী মানুষ। যা ইতিহাসে ‘বোস্টন টি-পার্টি’নামে পরিচিত। এ ঘটনা আমেরিকানদের মধ্যে বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের মাধ্যমে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল। সামাজিকভাবে নারীদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনার উন্মেষ ছিল আমেরিকান রেভল্যুশনের গুরুত্ববহ এক ঘটনা। ওই সময়কার এক নারী অ্যাকটিভিস্ট পেনিলোপি বার্কার। ছিলেন আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার এডিটনের বাসিন্দা। ব্রিটিশ পণ্য বর্জনে নারীদের সচেতনতার জন্য তাদের একত্র করতে তিনি ক্ষুদ্র পরিসরে একটি সভার আয়োজন করেন। ১৭৭৪ সালের অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখে ওই সভা ‘এডিটন টি পার্টি’ নামে পরিচিত। মোট ৫১ জন নারী ওই সভায় উপস্থিত ছিল। পেনিলোপি বার্কার সবার স্বাক্ষরসংবলিত প্রতিবাদলিপি ও দাবি ব্রিটেনে রাজদরবারে পাঠিয়ে দেন। সেই সময়কার পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের এই যৌথ প্রতিবাদ পুরো আমেরিকা ও ব্রিটেনে বেশ আলোড়ন তোলে। মার্কিনদের কাছে পেনিলোপি হয়ে ওঠেন আলোচিত আর ব্রিটিশরা তাকে নিয়ে করে ব্যঙ্গ।
আমেরিকান বিপ্লবে চায়ের নিয়ে পেনিলোপি বার্কারের দেখানো পথে আমেরিকায় নারী স্বাধীনতা, সম-অধিকার সর্বোপরি নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে প্রায় একক আন্দোলন চালিয়ে যান এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানটন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শুরু হয় তার এই প্রচেষ্টা। নারী স্বাধীনতার পক্ষে নারীদের সচেতনতায় তিনি নারীদের নিয়ে উন্মুক্তভাবে চা-চক্র আয়োজন করতেন। সমাজে নারীদের অবস্থান, অধিকার, ভোটাধিকারসহ নানান বিষয়ে তিনি কথা বলতেন। একটা সময় এমন হয়, এলিজাবেথ স্ট্যানটনকে তার তিন পায়ার চাকাওয়ালা চায়ের টেবিলের মাধ্যমে সিম্বলাইজ করা হতো।
সামাজিকভাবে চায়ের কদর বাড়িয়ে তুলতে আরেকজন নারীর নাম উল্লেখ করতেই হয়। তিনি হলেন অ্যানা মারিয়া রাসেল, ডাচেস অব বেডফোর্ড। রানি ভিক্টোরিয়ার ঘনিষ্ঠজন আনা মারিয়া, ব্রিটেনের মানুষদের খাদ্যাভ্যাসে দারুণ পরিবর্তন আনে ‘আফটারনুন টি’ তথা বিকেলের নাশতা প্রথা চালু করার মাধ্যমে। লাঞ্চ ও ডিনারের মধ্যভাগে বিকেলের সময় কিছু খাবার তেমন চল ছিল না। কেক কিংবা হালকা নাশতাসহ চায়ের মাধ্যমে ‘আফটারনুন টি’তথা বিকেলের নাশতা চালু করেন। ব্রিটিশ সমাজে তো বটেই, ধীরে ধীরে এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ^জুড়ে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্কটিশ নারী ক্যাথরিন কারন্সটন বা মিস কারন্সটন স্বল্প পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে সাধারণের চা খাওয়ার বাসনা মেটাতে একটি টি-রুম কিংবা চায়ের দোকান স্থাপন করেন। ১৮৭৮ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আরগাইল স্ট্রিটে ‘মিস কারন্সটন’স টি রুমস’নামের এই চা-ঘর অল্প সময়ের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে। প্রচলিত রেস্টুরেন্ট ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি স্বল্পমূল্যে চায়ের সঙ্গে নাশতার ব্যবস্থাও রাখেন। যা ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। স্কটিশদের মধ্যে চায়ের নেশা ধরাতে ক্যাথরিনের এই সাফল্যের সত্যিই কোনো জুড়ি ছিল না।
একবিংশ শতাব্দীর এক নারীর সাফল্যগাথার মাধ্যমে শেষ করতে চাই এই লেখা। চায়ের মতোই বিশেষ এক ধরনের পানীয় রয়বস। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভেষজগুণসম্পন্ন চা বোটানিস্টগণ আবিষ্কার করেন ১৭৭২ সালের দিকে। সেই সময় থেকে আফ্রিকান অধিবাসীরা রয়বস চা শুধুই চা হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডা. অ্যানিকিউ থেরন রয়বস চায়ের ঔষধিগুণ আবিষ্কার করেন অনেকটা নাটকীয়ভাবে। অ্যালার্জিক রোগে আক্রান্ত ছিল থেরনের ছোট্ট মেয়েটি। কোনো খাবারই খেতে পারতো না সে, এমনকি মায়ের দুধও না! ১৯৬৮ সালের এক সকালে ডা. অ্যানিকিউ থেরন এক বোতল গরম রয়বস চা দিয়ে তার মেয়েকে শেক দিচ্ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি আশ্চর্য একটি বিষয় লক্ষ করলেন যে তার মেয়ের অ্যালার্জিক চুলকানি কমে আসছিল। পরবর্তীকালে তিনি আবারও এমনটা করলেন, দেখলেন মেয়ের অ্যালার্জি অনেকটা কমে এসেছে। রয়বসের অ্যান্টি-অ্যালার্জিক জাদুকরি গুণ তিনি নানাজনকে বলেন। কিন্তু কেউ তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে তিনি অ্যালার্জি, অ্যাজমায় আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের খুঁজে বের করে রয়বস ব্যবহার করতে বলেন। তারাও সুফল পান। ধীরে ধীরে রয়বস চা বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অ্যালার্জিক রোগীদের কাছে। ডা. অ্যানিকিউ থেরন ১৯৭৪ সালে তার আবিষ্কার নিয়ে ‘অ্যালার্জিস: অ্যান অ্যামেজিং ডিসকভারি’শিরোনামে একটি বই লেখেন, এই বইয়ের মাধ্যমে রয়বস পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর ডা. অ্যানিকিউ থেরনকে আখ্যায়িত করা হয় ‘মাদার অব রয়বস’ মে।
সতেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বিশ^জুড়ে চা-বিপ্লবে নারীদের অসামান্য অবদানের কথা হয়তো অনেকটা অগোচরেই থেকে যাবে কালে কালে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবেন এসব সাহসী নারী। যেসব নারীর সংগ্রাম পৃথিবীকে করে তুলেছে সুন্দর ও বাসযোগ্য, তাদের সবার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
ছবি: ইন্টারনেট