ফুড বেনিফিট I কাঁঠালকথা
কাঁচা, পাকা, বিচি কিংবা শিকড়- ফলটির সবই সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেয়। পথ্যও বটে। রূপচর্চার কাজে লাগে
ইংরেজরা এই উপমহাদেশের বনবাদাড়ে এক প্রকার ফল দেখেছিল। তা শিয়ালে খাচ্ছিল বলে নাম দিয়েছিল ‘জ্যাকফ্রুট’। জ্যাকেল থেকে জ্যাক। আমরা যেটাকে কাঁঠাল বলি। এর আদিনিবাস বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চল। এখন ব্রাজিল ও জ্যামাইকাতেও জন্মায়। বড়সড় এ ফলের কোষগুলো পুষ্টিগুণে ঠাসা।
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালে আছে কার্বোহাইড্রেট ২৪ গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার ২ গ্রাম, প্রোটিন ১ গ্রাম, ভিটামিন এ ২১৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬.৭ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ৩৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০৩ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম এবং জলীয় অংশ ৮৮ গ্রাম। এসব উপাদান মানুষের শরীরের নানাবিধ বালাই সারায়। রক্তস্বল্পতা দূর করে। ফলটির খনিজ উপাদান রক্ত বাড়াতেও সক্ষম। কাঁঠালে থাকা ভিটামিন সি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বাধা দেয়। পাশাপাশি রক্তের শ্বেতকণিকার কার্যক্ষমতা বাড়ায়। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা দৃঢ় হয়। চোখের সুরক্ষা দেয় কাঁঠাল। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ হওয়ায় রাতকানা রোগের বিরুদ্ধে লড়তে পারে ফলটি। এটি খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রেটিনার ক্ষতি প্রতিহত করে। অক্ষিপটের সুরক্ষাও দেয়। কাঁঠালে থাকা ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে। অস্টিওপোরোসিস নামের হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ প্রতিরোধে ফলটি বেশ উপকারী। ফ্লুর সমস্যা দূর করতে এটি পথ্যের মতো কাজ করে। মানুষের শরীরকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলস থেকে বাঁচায়। পাশাপাশি সর্দি-কাশিও হটায়।
ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রমতে, পাকা কাঁঠালে গর্ভবতী মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটে। এটি খেলে ভ্রুণের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত হয়। মায়ের বুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধের জোগান দিতে পারে পাকা কাঁঠাল। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। পটাশিয়ামের উৎস হওয়ায় তা ব্লাড প্রেশার কমায়। ফলটির সবচেয়ে উপকারী দিক হলো, এটি ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। এর ডায়েটারি ফাইবার মলাশয় থেকে বিষাক্ত উপকরণ বের করে দেয়। ফলে অঙ্গটি সুরক্ষিত থাকে। এ কারণে মলাশয় ক্যানসার হতে পারে না। এতে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টগুলো ক্যানসার প্রতিরোধক। কোলন ক্যানসার ছাড়াও ফুসফুস, মুখ গহ্বর, প্রোস্টেট, ব্রেস্ট ও প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার প্রতিরোধ করে। নিয়ন্ত্রণে রাখে থাইরয়েড। কপারের উত্তম উৎস হওয়ায় কাঁঠাল থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ ধরনের সমস্যা থাকলে কড়া ওষুধ খাওয়ার আগে কাঁঠাল খাওয়া যেতে পারে। আরও কিছু উপকারী গুণ রয়েছে এ ফলের। যেমন টেনশন ও নার্ভাসনেস কমাতে পারে। বদহজম দূর করে। শর্করার পরিমাণ কম হওয়ায় ফলটি খেলে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে না। এর ভিটামিন বি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। আঁশসমৃদ্ধ হওয়ায় কাঁঠাল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
শরীরের অভ্যন্তরীণ বালাইনাশ ছাড়াও রূপচর্চায় কাজে লাগে ফলটি। কাঁঠাল খেলে ত্বকের বলিরেখা কমে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। এতে বয়সের ছাপ পড়ে না। চেহারায় লাবণ্য ধরে রাখতে কাঁঠাল খাওয়া যেতে পারে। ফলটির জলীয় অংশ ত্বককে আর্দ্র রাখে। চামড়া নমনীয় থাকে। ত্বকচর্চায় কাজে আসে এ ফলের বীজ। বলিরেখা দূর করতে তা কার্যকর। কোল্ড ক্রিমের সঙ্গে কাঁঠালের বীজের চূর্ণ মিশিয়ে ত্বকে মাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এটি চামড়াকে সজীব ও তাজা রাখে। ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে কাঁঠালের দুটি বীজ দুধ ও মধুতে ভিজিয়ে তা দিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে মাখা যেতে পারে। বীজের এ ধরনের পেস্ট ত্বকের নানা রকম রোগও সারায়। চুলচর্চায়ও কাজে লাগে। বীজে ভিটামিন এ থাকে। তাই এটি খেলে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চুলের আগা ফেটে যাওয়া সমস্যারও প্রতিকার মেলে। কাঁঠালের বীজের আরও অনেক গুণ আছে। এর পুষ্টিমানও ব্যাপক।
কাঁঠালের প্রতি ১০০ গ্রাম বীজে শক্তি পাওয়া যায় ৯৮ ক্যালরি। এতে কার্বোহাইড্রেট আছে ৩৮.৪ গ্রাম, প্রোটিন ৬.৬ গ্রাম, চর্বি ০.৪ গ্রাম, ফাইবার ১.৫ গ্রাম, ফসফরাস ০.১৩ থেকে ০.২৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.০৫ থেকে ০.৫৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৪.০৭ মিলিগ্রাম, আয়রন ১.২ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ২ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া মেলে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি, নায়াসিন, থায়ামিন, লিগন্যান, আইসোফ্ল্যাভোন এবং স্যাপোনিনের মতো ফাইটো কেমিক্যালস। উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য দরকারি। কাঁঠালের বীজ খেলে বিভিন্ন রোগ সারে। প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসে ঠাসা বলে এটি মানসিক চাপ কমায়। নিয়মিত খেলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়ে। ফলে মগজ ও হার্ট সুস্থ থাকে। হিমোগ্লোবিন তৈরির উপাদানও আছে কাঁঠালের বীজে। এ কারণে তা রক্তস্বল্পতা দূর করতে পারঙ্গম। বীজ রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে খেলে বদহজমের সমস্যা দূর হয়। প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও সেরে যায়। পাশাপাশি কোলনের কর্মক্ষমতাও বাড়ে। এর বীজ মাছ-মাংসের মতোই প্রোটিনের ঘাটতি মেটায়। বর্ষাকালীন অণুজীব সংক্রমণের কবল থেকে সুরক্ষিত থাকতে চাইলে খাওয়া যেতে পারে কাঁঠালের বীজ। এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এলিমেন্ট জীবাণু দূরে রাখে। নানাবিধ ফুড-বন এবং ওয়াটার-বন ডিজিজ প্রতিরোধ করে। কাঁঠালের মতোই এর বীজ দৃষ্টিশক্তির সুরক্ষা দেয়। হাড়ও মজবুত করে। অস্থিক্ষয়জনিত রোগ সারায়। এ কাজ করে বীজে থাকা ম্যাগনেশিয়াম উপাদান। তা ছাড়া এর লিগন্যানস, স্যাপোনিনস, আইসোফ্ল্যাভোনস ও ফাইট্রোনিউট্রিয়েন্টস ক্যানসার প্রতিরোধী।
কাঁঠালের কোষ এবং বীজ ছাড়াও এ গাছের শিকড় কিছু রোগের পথ্য। আয়ুর্বেদ অনুসারে এর মূলের চূর্ণ খেলে যৌনক্ষমতা বাড়ে। শরীরের অ্যালকোহলের প্রভাব দূর করতেও খাওয়া যেতে পারে এটি। শিকড় সেদ্ধ করে খেলে হাঁপানি নিরাময় হয়। চর্মরোগের সমস্যা সমাধানেও তা কার্যকর। এ ছাড়া জ্বর ও ডায়রিয়া নিরাময় করতে পারে।
এত উপকারী হওয়ার পরও কাঁঠাল খাওয়ায় কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এতে প্রচুর আমিষ থাকে, যা কিছু ক্ষেত্রে বদহজম ঘটাতে পারে। এ ফল খাওয়ার বিষয়ে ডায়াবেটিসের রোগীদের বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
❙ ফুড ডেস্ক