ফুড বেনিফিট I চায়ের চুমুকে চমক
স্নায়ুর উদ্দীপক। ঔষধি গুণে ভরা। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়
চৈনিক মনীষী লাওৎসে ‘চা’কে বলেছেন মহৌষধ। যদিও বেশির ভাগ উদ্ভিদেই ঔষধি গুণ মেলে। কিন্তু প্রাচীন ভেষজ অন্বেষকদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছিল চা। এটি পানের সুফল সম্পর্কে আলোচনা করলেই কারণ জানা যাবে। চা অনেক উপকারী উপাদান বহন করে। তবে অন্তত আমাদের দেশে শুধু লিকার জ্বাল দিয়ে খুব কম মানুষই পান করে। অন্তত আদাটা মেশায়। তা ছাড়া বিভিন্ন মসলারও যোগ হয়। দুধ-চা তো আছেই। অতিরিক্ত উপাদান যোগে এতে বাড়তি গুণাগুণ মেলে; যা শরীরের বিভিন্ন রোগের দাওয়াই হিসেবে কাজ করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে চা পানের পরামর্শও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত আছে। তবে সর্দি, কাশি, মাথা ও গলাব্যথা ইত্যাদি সমস্যায় এর ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ে।
লিকার চায়ের কথাই বলা যাক। এতে থাকা ট্যানিন উপাদান ফ্লু, ঠান্ডা ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। উপাদানটি অন্ত্রের প্রদাহনাশী। গ্যাস্ট্রিকের বিরুদ্ধেও কাজ করে। হজমপ্রক্রিয়ার যথাযথ সুরক্ষা দেয়। ফলে শরীরে বাড়তি মেদ জমতে পারে না। এতে স্থূল হওয়ার আশঙ্কা কমে। দেহকোষ থেকে ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন নিঃসৃত করার ক্ষমতা থাকে এতে; যা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে লিকার চা ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য পথ্য। এতে হৃদ্বান্ধব কিছু এনজাইম থাকে; যা রক্তের সরবরাহ বাড়িয়ে হৃৎপি- সুস্থ রাখে। এটি কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা প্রতিরোধ করে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ক্ষতিকর কোলেস্টেরল জারিত হতে বাধা দেয়। এসব কারণেই হার্টের সুস্থতা নিশ্চিত হয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ক্যানসারও সারে; বিশেষ করে রেকটাল, জরায়ু, ফুসফুস ও ব্লাডার, প্রোস্টেট, পাকস্থলী ও মুখের ক্যানসার। লিকার চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এসব জটিল রোগের সঙ্গে লড়াই করে। এটি ইউ-ভি রেডিয়েশনের ঢাল হিসেবে কাজ করে। ফলে ত্বকের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা কমে। এর
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দাঁতের ক্ষয় সৃষ্টিকারী জীবাণু নাশ করে। ফ্লোরাইড থাকায় মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। চা ক্লান্তি দূর করে। মূলত এই পানীয়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে তোলে। ফলে নার্ভ শান্ত হয়; শরীরে চাঙাভাব আসে। লিকার চা পানে হাড়ও মজবুত হয়। এর ফাইটো কেমিক্যালস অস্থিকে শক্ত করে। এতে আর্থ্রাইটিসের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিডনি রোগের জন্যও উপকারী লিকার চা। এর সঙ্গে আদা যোগ করলে তা আরও উপাদেয় হয়ে ওঠে। আদা নিজেই অনেক উপকারী। লিকারের সঙ্গে মিশে তা বাড়তি কিছু সুবিধা দেয়।
লিকার চায়ে পাওয়া সব ধরনের উপকারই আদাসহযোগে মেলে। বাড়তি উপকারিতা হচ্ছে, এটি পানে বমি ভাব কাটে। গা গুলিয়ে বমি আসা বলতে যা বোঝায়, আদা-চা পানে সেটি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। গরম-গরম পান করলে গলাব্যথা সারে। মাসল পেইন উপশমেও কার্যকর। এমনকি এর অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি পিরিয়ডের ব্যথাও কমায়। শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার প্রতিকারে পান করা যেতে পারে এই পানীয়। মুখের রুচি বাড়ায় আদা-চা। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পরিপাকতন্ত্রে উৎপন্ন গ্যাস বের করে দেয়। পেটে হজম না হওয়া খাবারও অপসারণ করে। তা ছাড়া দেহের অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান হটায়। শীত মৌসুমে শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্রশান্তি দেয় আদা-চা।
স্বাস্থ্যকর চা বলতে ‘গ্রিন টি’র উল্লেখ করতেই হয়। সবুজ চায়ে প্রায় সব ঔষধি গুণ মিলবে। এই চা ব্রেস্ট ও গলব্লাডার ক্যানসার সারায়, স্ট্রোকের ঝুঁঁকি কমায়, শরীরের বাড়তি মেদ ঝরায়, মস্তিষ্ক সুস্থ রাখে, দাঁত ভালো রাখার পাশাপাশি মুখের দুর্গন্ধ দূর করে, কোলেস্টেরল কমায়, রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কিডনি রোগের জন্যও এটি পথ্য। তবে গ্রিন টি পানে দুটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়- চোখের সুরক্ষা এবং অ্যালার্জি থেকে মুক্তি। এই চা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চোখের টিস্যুগুলোতে প্রবেশ করতে সক্ষম, যা ছানিসৃষ্ট অন্ধত্ব প্রতিরোধ করে। এটি অ্যান্টি-অ্যালার্জিক। এ ছাড়া এতে আছে পলিফেনল, যা অ্যালার্জিসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো থেকে নিস্তার দেয়। পোকামাকড় কামড়ালে ওই স্থান যদি চুলকায় ও ফুলে যায়, তাহলে আক্রান্ত ত্বক গ্রিন টি দিয়ে ঢেকে দিলে আরামবোধ হয়। রক্তপাত বন্ধেও এই চা লাগানো যেতে পারে।
ত্বকের বাহ্যিক সুরক্ষাও দেয় চা। চামড়ার দাগ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে পারে নিয়মিত আদা-চা পানে। এটি ত্বকে নতুন কোষ তৈরির মাধ্যমে কাজ করে। চুলও ঝলমলে হয়। একই কাজ করে গ্রিন টি। ব্রণ সারায়, ত্বক ফাটা সমস্যা দূর করে। এটি পানে খুশকিও পালায়।
চা পানের ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু কুফলও আছে। সময় বুঝে পান করা ভালো। নয়তো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে। সকাল ও দুপুরে খাওয়ার পর অনেকে চা পানে অভ্যস্ত। কিন্তু এটি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এমনকি খাদ্য গ্রহণের আগে আগেও চা পান অনুচিত। এতে হজমের সমস্যা হতে পারে। খাবার খাওয়ার অন্তত আধা ঘণ্টা পর চা পানে সমস্যা নেই। এক ঘণ্টা পর হলে আরও ভালো। চায়ের আছে আয়রন শোষণের ক্ষমতা। এই পানীয়ে পলিফেনন জেস্টানিন উপাদান আছে, যা আয়রনের সঙ্গে মিশে শরীর থেকে তা বের করে দেয়। এতে দেহে লৌহের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া থায়ামিন ও ভিটামিন বি শুষে নেয় চা। ফলে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। চায়ে থাকা অ্যাসিডাম টেনিকামস ওজেসথিয়োফিলিনস উপাদান কিছু ক্ষেত্রে হজমপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে। গ্রিন টি পানেও কিছু বিধিনিষেধ আছে। গর্ভবতী, ইনসোমনিয়া ও রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের তা পান করা থেকে বিরত থাকা ভালো।
চা পান বিষয়ে কিছু ভুল তথ্যও লোকসমাজে প্রচলিত। যেমন এই পানীয় পানে ত্বক কালো হয়ে যায়। এটি ভুল ধারণা। ত্বকের রঙের তারতম্য ঘটে ম্যালানোসাইট কোষের সক্রিয়তার ওপর। চায়ের ওপর নয়। যাহোক, এখানে মোটে দু-একটি চায়ের উপকারিতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই তরলের প্রকরণ আরও বড়। ফলে উপকারিতার ফিরিস্তিও দীর্ঘ। যেমন রোজ টি, ল্যাভেন্ডার টি, মধু-চা, পাট-চা, মসলা-চা, লেবু-চা, দুধ-চা ইত্যাদি চায়ের গুণাগুণ অসংখ্য।
❙ ফুড ডেস্ক