skip to Main Content

ফিচার I সংগীতচিকিৎসা

বিনোদন তো বটেই, মনোদৈহিক অসুখ সারানোর কাজেও লাগে। অনেক চিকিৎসকই আজকাল রোগ নিরাময়ের জন্য এটির প্রয়োগ করছেন

সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমায় দেখা যায়, গুপী ও বাঘা গান শুনিয়ে লোকেদের সম্মোহিত করে দেয়। বাস্তবে এমনটা না হলেও এখন মানবস্নায়ুতে সংগীতের প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। চিকিৎসাপদ্ধতিতে তো মিউজিক থেরাপি নামে একপ্রকার নিরাময় কৌশলও বেরিয়েছে। তবে তা নতুন কিছু নয়। সভ্যতার শুরুতে ভারতবর্ষ, মিসর, গ্রিস, চীন ও রোমে সুরের মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা হতো। প্রাচীন গ্রিসে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা কমানোর জন্য, ভালো ঘুমের প্রত্যাশায় এবং ব্যথানাশে এর ব্যবহার ছিল। সংগীতের এমন উপযোগিতা সঠিক কি বেঠিক, সেটির বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতির অপেক্ষায় অনেক দিন মিউজিক থেরাপি ব্যবহৃত হতো না। কিন্তু এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে, সংগীতের প্রাথমিক কাজই হলো মস্তিষ্কে সাড়া তৈরি করা। মগজের আনন্দ-অনুভূতির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ডোপামিন। গান শুনলে এই হরমোন নিঃসৃত হয়। ফলে মস্তিষ্কে জৈব রাসায়নিক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সেটিই কাজে লাগিয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্র।
শব্দতরঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা মগজকে আলাদাভাবে প্রভাবিত করে। বিটা তরঙ্গ, অর্থাৎ ১৪-৪০ হার্টজের সংগীত মস্তিষ্ককে চাঙা করে। ফলে দৈনন্দিন কাজের ক্লান্তি দূর হয়। পপ ও রক ঘরানার গানগুলো এ কম্পাঙ্কের হয়ে থাকে। ৮-১৪ হার্টজের সংগীতগুলো মূলত আলফা তরঙ্গের, যা মনে প্রশান্তি জাগায়। কান্ট্রি সং, ব্লুজ ও ফোক গানগুলো এই কম্পাঙ্কের মধ্যে পড়ে। থিটা তরঙ্গের মিউজিক মেডিটেশনের জন্য উপযোগী। এগুলো ৪-৮ হার্টজের। এর চেয়ে কম হার্টজের গানগুলো ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হালের বিভিন্ন গবেষণায় এর গুণগত দিকের হদিস মিলেছে। দৈনিক ২৫ মিনিট করে মিউজিক শুনলে পিঠ ও মেরুদন্ডের ব্যথায় উপশম দেয়। এখন এটা নানাভাবে প্রমাণিত। গোটা বিশ্বে এ নিয়ে ১১টি পৃথক গবেষণা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, শরীরে আঘাত লাগা রোগীদের মধ্যে যারা মৃদুলয়ের সংগীত শোনেন, তারা মিউজিক না শোনা রোগীদের চেয়ে কম ব্যথা অনুভব করেন।
সংগীতের একটি রাগের নাম ‘দরবারি কানাড়া’। এটি শ্রবণে শরীরে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ব্যথা দূর করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চিকিৎসকেরা আহত সেনাদের ব্যথা কমাতে মৃদুলয়ের মিউজিক ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছিলেন। তখন থেকেই একদল গবেষক এ বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। এখন ভয়ানকভাবে আহত রোগীর কানে হেডফোন লাগিয়ে মৃদুলয়ে সেতার ও সরোদ শুনিয়ে তার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল পর্যায়ে এনে সার্জারি করা হয়। এতে রোগীর কষ্ট কমে। তবে ব্যথার ওষুধ যে একদমই লাগে না, তা কিন্তু নয়।
গানের একটি উপাদান হলো ‘লয়’। যা একক সময়ে তালের পরিমাপক। হৃৎস্পন্দনের ওপর লয়ের প্রভাব আছে। এ বিষয়ে ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে একটি গবেষণা হয়েছিল। দেখা গেছে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী রোগীরা যদি দৈনিক ন্যূনতম ৩০ মিনিট মৃদুলয়ের মিউজিক শোনেন, তাদের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের গতি কম হয়। তা ছাড়া রোগজনিত কষ্ট কমে। হার্ট অ্যাটাকের পর প্রতিদিন ২০ মিনিট ধরে ধীরলয়ের গান শুনলে উদ্বেগ কমে। রক্তনালির ব্লক হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। হংকংয়ে হওয়া একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২৫ মিনিট ধরে টানা চার সপ্তাহ মন প্রফুল্ল করার মিউজিক শুনলে সিস্টোলিক রক্তচাপ ১২ মিমি পারদ চাপ ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৫ মিমি পারদ চাপ পর্যন্ত কমে। শ্রুতিমধুর সুর শ্রবণে নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ বেড়ে কষ্ট লাঘব হতে পারে। আজকাল মিউজিক থেরাপি দিয়ে রোগীর নাড়ির গতি, হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। তবে মিউজিক থেরাপি এখন পর্যন্ত কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসাপদ্ধতি নয়। এটি নিরাময় সহায়ক উপায় মাত্র।
আলঝেইমারস সারাইয়েও মিউজিকের ভূমিকা আছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০০৯ সালে একটি গবেষণা হয়েছিল। অধ্যাপক পিটার জ্যানাটা পরিচালিত সেই গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষের মস্তিষ্কের একটি অংশ মিউজিকের মাধ্যমে সরাসরি প্রভাবিত হতে পারে। আলঝেইমারসে আক্রান্ত রোগীর অতীত আবেগের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারে সংগীত। মস্তিষ্কের কথা বলার অংশকেও তা উজ্জীবিত করতে সক্ষম। স্ট্রোক হওয়া মানুষের যদি কথা বলার ক্ষমতা চলে যায়, তাহলে সুমধুর সংগীত নিয়মিত শোনালে সেই সমস্যা দূর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এখানে সাবেক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য গ্যাব্রিয়েল জিফোর্ডসের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১১ সালে তিনি মাথায় গুলি লেগে আহত হন। এতে তার মস্তিষ্কের ভাষা ও স্মৃতিরক্ষক স্নায়ুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কথা বলার ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে তিনি সুস্থ হন। পুনরায় কথা বলার সক্ষমতা ফিরে পান।
সিজোফ্রেনিয়া, অ্যামনেশিয়া, ডিমেনশিয়া রোগের ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপি উপকারী। গর্ভবতীরা নিয়মিত গান শুনলে শিশুর মগজের বিকাশ ভালো হয়। হালের চিকিৎসায় অর্থোপেডিক রোগীদের সার্জারির আগে ও পরে গান শুনিয়ে ব্যথা কমানো হয়। গুরুতর রোগীকে নিয়মমাফিক কিছু মিউজিক শুনিয়ে দেখা গেছে, খুব দ্রুতই তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবিউলিনের সংখ্যা বাড়ে। কোভিড-১৯ নিরাময়-পরবর্তী সুস্থতায় সংগীত ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আইসোলেশনে থাকা রোগীদের জন্যও মিউজিক চিকিৎসা সহায়ক হচ্ছে।
ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি মেডিসিন ২০১৩ সালে দাবি করে, সংগীত শিশুদের শ্রবণশক্তি বাড়ায়। এ ছাড়া মানুষের মনস্তত্ত্বে মিউজিকের আরও কিছু উপযোগিতা আছে। যেমন তা মনোযোগ বৃদ্ধি করে। গানের আলফা ও থিটা তরঙ্গই মস্তিষ্কে এই ইতিবাচক সক্ষমতা গড়ে তোলে। মিউজিকের ছন্দ ও তাল মানুষের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে আনতে সহায়ক। কোনো বিষয়ে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করার প্রবণতা তৈরি হয়। নিয়মিত গান শুনলে স্মৃতিশক্তিও বাড়ে। মানুষের সিন্যাপসিস শক্তিশালী করে। এ কারণে দীর্ঘকালীন স্মৃতিশক্তি ধরে রাখার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নতুন স্মৃতি ধরে রাখতেও সংগীতের ভূমিকা আছে। মিউজিক মানুষের মগজে কর্টিসেলের মাত্রা কমাতে পারে। এতে স্নায়বিক চাপ কমে। ফলে জটিল তথ্য বোঝার ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়ে।
চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে মিউজিক থেরাপির প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশে তো নয়ই। জানালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর হারিসুল হক। তিনি বলেন, ‘তুরস্কের কোনো কোনো হাসপাতালে মিউজিক থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এটা আসলে মূল চিকিৎসার সহায়ক একটি পদ্ধতি। সংবেদনশীল, অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটা কিছুটা কার্যকর।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে হারিসুল হক জানান, প্রতিদিন তিনি কাজে যাওয়ার আগে অন্তত পনেরো মিনিট সংগীত শোনেন। এতে অনুপ্রেরণা পান এবং সারা দিনের নানান ব্যস্ততার মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করেন।

 লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top