সাক্ষাৎকার I বিটবক্স বাংলাদেশে
বিটবক্সিং শুরু হয়েছিল আশির দশকের প্রথম দিকে, যুক্তরাষ্ট্রে। হিপহপের পঞ্চম এলিমেন্ট হিসেবে। তবে এখন পৃথিবীতে এটি আলাদা সংগীতমাধ্যম রূপে গণ্য। ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে গানের যেকোনো জনরায় ব্যবহার করা যায়। আবার পুরো সংগীতও পুনঃসৃজনও সম্ভব। এমনকি এর ব্যবহার বিজ্ঞাপন, স্পিচ থেরাপি, মানসিক সেবা- অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে।
বাংলাদেশে বিটবক্সিং নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ‘বিটবক্স বাংলাদেশ’ নামের সংগঠন। এর অন্যতম উদ্যোক্তা মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত। স্টেজ নাম বিটবাক্সো। ক্যানভাসের সঙ্গে কথা বলেছেন বিটবক্সিং ও নিজের কাজ নিয়ে।
ক্যানভাস: শুরুর গল্পটা বলুন?
মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত: মধ্য নব্বইয়ে শুরু বিটবক্সিংয়ের দিকে যাত্রা। তখন সৌদি আরবে থাকতাম, মিডল স্কুলে পড়ি। পুলিশ একাডেমিতে মাইকেল উইন্সলোকে দেখেছিলাম, আবার ববি ম্যাকফেরিনের ‘ডোন্ট ওরি বি হ্যাপি’ শুনেছিলাম। বেশি শুনতাম মাইকেল জ্যাকসন। মনে হতো বিটস ও কম্পোজিশনের লেয়ারে আলাদা কিছু মানুষের তৈরি সাউন্ড পাওয়া যাচ্ছে। খুব একটা না বুঝলেও এই তিনজন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মুখ দিয়ে বিটসের আওয়াজ করতাম। তবে আশপাশে এমন কেউ ছিল না যাদের কাছ থেকে এটা জানতে বা শিখতে পারি। কিছুদিন তবলা শিখেছিলাম। তবলার বোলের সঙ্গে মিক্স করে প্রথম দিকে মাইকেল জ্যাকসনের গানের মিমিক করতাম। এভাবে নিজে নিজে প্র্যাকটিস করে একপর্যায়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ২০০৪-এর পর আবার শুরু করলাম। এক ছোট ভাই ডিজে রাফ বলল, ‘কাঁটাতারের বেড়া’ নামের একটা অ্যালবাম করবে। যেটা ছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মিক্সড হিপহপ অ্যালবাম। সেই অ্যালবামের মাধ্যমেই প্রথম কোন বিটবক্সিং এর রেকর্ডিং বের হয়ে এদেশে। এরপর আমি বেশ কিছু প্রগ্রেসিভ রক/মেটাল ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছি। বেশ কিছু গানের আনপ্লাগড ভার্সনেও বিটবক্সিং করি সে সময়। ২০০৮ এর শুরুর দিকে বোম্বে রকার্স ও আরাশ ঢাকায় প্রোগ্রাম করে যেখানে আমি ও বোম্বে রকার্স-এর রেহাল বিটবক্সিং করি। এরপর আমি ওল্ড স্কুল ব্যান্ডে জয়েন করি। তাদের প্রথম অরিজিনাল গান “ব্যাঙ্গ”-তে বিটবক্সিং ও একাপেলা ব্যবহার করা হয়। এরপর গিটারিস্ট হিসেবে জয়েন করি আমার বর্তমান ব্যান্ড ব্লান্ডারওয়্যারে। ব্যান্ডের ‘গৌড়’ নামের একটা গানে বিটবক্সিং ব্যবহৃত হয়। এভয়েডরাফা ব্যান্ডেও আমি প্রায় দুই বছর ছিলাম, যাদের অ্যালবামেও বিটবক্সিং আছে। তাদের সঙ্গে একটা ট্যুরের সময়ে রাফা এবং পাভেল আমাকে পরামর্শ দেয় একটা ফেসবুক পেজ করার। তখন বিটবাক্সো নামটা মাথায় আসে।
ক্যানভাস: মিউজিকের স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বাংলাদেশে বিটবক্সিংয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত: বিটবক্সিং বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ভিন্ন রূপে আগে থেকেই ছিল। যদিও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে নয়। এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ফুয়াদ আল মুক্তাদির, রাফা, শুভ্র রাহা, প্রীতম, নাগিব হক, নাফিজ, মিথুন প্রমুখ। কেউ কেউ তাদের কম্পোজিশনে নানা সময়ে বিটবক্সিং ব্যবহার করেছেন। এটাকে আরও পরিচিত এবং এর সম্ভাবনাকে মানুষের সামনে নিয়ে আসার ইচ্ছা থেকেই বিটবক্স বাংলাদেশ-এর শুরু। এ দেশে এখন এমন বিটবক্সার আছেন যারা একাধারে গাইতে, গিটার বাজাতে এবং বিটবক্সিং করতে পারেন। বিটমোস্ফিয়ার নামে একটি গ্রুপ স্টেজে বিটবক্সিং করে।
ক্যানভাস: ‘বিটবক্স বাংলাদেশ’-এ আপনার সম্পৃক্ততা বিষয়ে জানতে চাই।
মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত: ২০১৪ সালের শেষ দিকে রনেশ বিশ্বাসের (স্টেজ নাম হ্যান-এক্স) সঙ্গে পরিচয় হয় একটা ইভেন্টে। সেখানে বেশ কিছু বিটবক্সারকে পাই। সবাই মিলে বিভিন্ন প্রজেক্ট করতে ইচ্ছুক ছিলাম। রনেশ একদিন প্রস্তাব দিল- আমরা অফিশিয়ালি বিটবক্সারদের একটা কমিউনিটি করতে পারি। পরে দুজন মিলেই বিটবক্স বাংলাদেশ শুরু করি। ২০১৫ সালে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খোলা হয়। বাংলাতে বিটবক্সিংয়ের টিউটোরিয়াল প্রকাশ করি। ব্যাটলবক্স বিডি নামে অফিশিয়াল বিটবক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ কনটেস্ট আয়োজিত হয়। ফলে গ্লোবাল কমিউনিটিতে বাংলাদেশে বিটবক্সিংয়ের স্বীকৃত সংগঠন হিসেবে পরিচিত হই। প্রতিযোগিতা থেকে বিজয়ীরা এশিয়া বিটবক্স চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ার্ল্ড বিটবক্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সম্প্রতি বিশ্বের ২৩টি বিটবক্স কমিউনিটির সঙ্গে পার্টনারশিপ করেছি। অনলাইনে সবচেয়ে বড় বিটবক্স মাস্টারক্লাস আয়োজনে অংশ নিয়েছি। এর মাধ্যমে সংগৃহীত প্রায় দুই লাখ টাকা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার ফান্ডে ডোনেট করা হয়। ২০১৯ সালে ব্যাটলবক্সবিডি আয়োজনে আমেরিকান অ্যাম্বাসিকে পাশে পাওয়া ছাড়া আরেকটি বড় অর্জন ছিল সে বছরে তাইওয়ানে আয়োজিত এশিয়া বিটবক্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে পারা।
ক্যানভাস: আপনার ভিডিও পডকাস্ট শো ‘বিটস উইথ বাক্সো’-তে দেশের ও বাইরের অনেক আর্টিস্ট অতিথি হয়ে এসেছেন। এ বিষয়ে শুনতে চাই…
মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত: মূলত বিটবক্সার ও তাদের ব্যাপারে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে জানাশোনার অভাবকে কমানোর চিন্তা থেকেই বিটস উইথ বাক্সো শুরু করি। পডকাস্টটি বিটবক্স বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে নাগিব হকের স্পন্সরশিপ নিয়ে চালু হয়। এখানে বিভিন্ন দেশের বিটবক্সাররা গেস্ট হিসেবে আসেন। এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার টম থাম, যিনি বিটবক্সিং নিয়ে গবেষণার জন্য বিশ্বে খ্যাতিমান। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক মিউজিশিয়ান এই শোতে উপস্থিত ছিলেন। এই সিজনে মোট ৩১টি পর্ব ছিল। ২০২১ সালে আশা করি দ্বিতীয় সিজন শুরু হবে।
ক্যানভাস: বিটবাক্সো নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
মোকতাদীর দেওয়ান শান্ত: যদিও বিটবক্সিং মাথাতে নিয়েই বিটবাক্সোর শুরু, কিন্তু পরে আরও অনেক জনরাতেই পরিভ্রমণ করেছি। অরিজিনাল সিঙ্গেল রিলিজ করারও ইচ্ছা আছে।
করোনা প্যানডেমিকে বেশ কিছু একাপেলা অ্যারেঞ্জ করে আপলোড করেছি। পজিটিভ সাড়াও পাচ্ছি। সামনে আরও কিছু একাপেলা কোলাবোরেশন আসবে। যেমন নেপালের ব্যান্ড অ্যালবাট্রসের একটা অরিজিনাল গানে, ডাচ বিটবক্স চ্যাম্পিয়ন ইবারার সঙ্গে, কলকাতার জনপ্রিয় একটি ব্যান্ডের (নাম এখনই বলা যাচ্ছে না, সিক্রেট প্রজেক্ট), বামি ও শৌভিকের সঙ্গে একটা কভার গানে, গ্রুভট্র্যাপ ব্যান্ডের সিমিন সাইফুদ্দিনের সঙ্গে মাইকেল জ্যাকসনের একটা কভার গানে- এ রকম আরও কিছু। ২০২১ সাল জুড়ে একাপেলা কভার রিলিজ করব। একই সঙ্গে আমার কিছু অরিজিনালে দেখা যাবে পলবাশা, নাহার, দুর্জয় ও অন্য শিল্পীদের।
ইফতেখার ইনান
ছবি: সংগ্রহ